ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

Daily Inqilab ফজিলা ফয়েজ

০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৩ এএম | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৩ এএম

চল্লিশ দশকের বিদ্রোহী ও কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৫ আগস্ট, ১৯২৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যা তখন ব্রিটিশ ভারতের একটি অংশ ছিল। তাঁর পিতা নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন একজন প্রকাশক এবং একটি লাইব্রেরীর মালিক সেই সুবাদে সুকান্তের বিশ্বদৃষ্টি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

কৈশোর থেকেই তিনি সাম্যবাদী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। সুকান্ত ছোটবেলা থেকেই বিস্তৃত ধারণা ও দর্শনের সাথে পরিচিত। লেখালেখি ও কবিতার প্রতি সুকান্তের আবেগ প্রথম দিকেই বিকশিত হয় এবং শীঘ্রই তিনি নিজেকে একজন প্রতিভাবান ও প্রসিদ্ধ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর কবিতা সাহসী এবং বিপ্লবী চেতনার অধিকারী। সুকান্তের বিপ্লবী লেখা তাকে ব্যাপক পরিচিতি ও প্রশংসিত করেছিল। তার কবিতা শ্রেণী, ধর্ম, জাতিগত বাধা অতিক্রম করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে অনুরণিত হয়েছিল।

বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী কবি। চল্লিশের বিশ্ব যুদ্ধের তা-ব ও মরণ ছোবলের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন কবি সুকান্ত। দেশ বিভাগের সহিংসতা এবং রক্তপাত প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা নিপীড়িত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য লড়াই করেন।

যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষে ঝাঁঝরা হলেও মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকেছিল বাংলাদেশ। দুর্ভিক্ষে লাশ হওয়া মানুষের কঙ্কালের উপর দিয়ে চলল বৃটিশের যুদ্ধের অভিযান। মৃত্যু মানুষের হার গুড়িয়ে চললো ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া আযানের বহর। সেই বিচূর্ণ হারের ভেতর থেকে জ্বলতে থাকল আগুন। জ্বলে উঠলো প্রতিরোধের দাবানল। কোটি শিখা হয়ে দিকে দিকে জ্বললো স্বাধীনতার মশাল। সেদিনের সেই নব জাগ্রত বাংলাদেশকে বিপ্লবী কবি সুকান্ত দেখেছেন তার তিমির বিদারী উদার অভ্যুদয়ের এক রক্তিম সূর্যালোক। ‘দুর্মর’ শিরোনামের কবিতায় এই জাগরণকে নন্দিত করে তিনি লিখলেন:

‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছাসে;
সেই কোলাহলে রুদ্ধ রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ্য
জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।’
এর পরের স্তবকে লিখেলেন:

‘হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান;
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে-
আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ’

শেষে রক্তের হরফে আগাম বিজয়ের ঘোষণা রাখলেন বিপ্লবী তরুণ এই কবি:

‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী তাকিয়ে রয়:
জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়
এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে সোনালী নয়তো রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।’
মহৎ কবিরা আগামী দিনকে ধারণ করে তাদের অনুভবে। চল্লিশ দশকের শেষ দিকে কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ভবিতব্যের মতো।
দুই দশক পরে সত্তরে এসে জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়া বাংলাদেশের মাঠ থেকে আমরা তুলেছি স্বাধীনতার ফসল। আর সেই ফসল ছিল রক্তধোঁয়া।
কারণ ত্রিশ লক্ষ শহীদের খুন রাঙা ছিল আমাদের মাঠের সেই ধান।

তার কবিতাগুলি স্বাধীনতার জন্য একটি মিছিলকারী আর্তনাদ ও জনসাধারণের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা জাগিয়ে তোলে।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বাংলাদেশের প্রাণ
কেনো ঘরে ঘরে গড়ে উঠলো এত রণাঙ্গন?
কেনো এত রক্ত বিসর্জন?
সুকান্ত এই প্রশ্নের উত্তর লিখেছিলেন:

‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
চলে যাবো তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ’

প্রাণপনে পৃথিবীর সারাবো জঞ্জাল অঙ্গীকার ঘোষণা করে বলেন:
এ বিশ্বকে,
এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি;
নব জাতকের কাছে আমার দৃঢ় অঙ্গীকার করে লেখেন:
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুরে- করে যাবো আশীর্বাদ’
তারপর হবো ইতিহাস।

কি আশ্চর্য মিল সুকান্তর এই পঙ্গক্তিগুলোর সঙ্গে সত্তর দশকের যুদ্ধের সাথে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে আগামী দিনের শিশুদের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যৎ রচনার প্রত্যয় জাগিয়ে তুলেছে ন এই নতুন প্রজন্মের কবি।
উচ্চকিত সরে গাইছেন:
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি;
মোরা একটি শিশুর মুখে হাসি ফোটাবো বলে যুদ্ধ করি’

১৯৭১ সালে, যখন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে সুকান্তের লেখাগুলো ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়। তার বাণী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বাঙালির সম্মিলিত চেতনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের তার কালজয়ী কবিতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অটল অঙ্গীকারের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। তাঁর কবিতাগুলি সামাজিক পরিবর্তন আনতে শিল্প ও সাহিত্যের শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ
আত্মবেদনার করুণ কাহিনী ‘বিবি কুলসুম’
কুয়াশার চাদরে ঢাকা হেমন্ত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর তৈলতত্ত্ব ও আমাদের সাহিত্য সমাজ
জলের ঘ্রাণ
আরও

আরও পড়ুন

শহীদদের রক্তের সঙ্গে যাতে বেঈমানি না হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা থাকবে : নতুন সিইসি

শহীদদের রক্তের সঙ্গে যাতে বেঈমানি না হয়, সুষ্ঠু নির্বাচনে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা থাকবে : নতুন সিইসি

খালেদা জিয়াকে ১২ বছর সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখা হয়েছে : মির্জা ফখরুল

খালেদা জিয়াকে ১২ বছর সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখা হয়েছে : মির্জা ফখরুল

সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস ফিরে আনতে হবে  -আল-কাউসার পরিষদ বাংলাদেশ

সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস ফিরে আনতে হবে -আল-কাউসার পরিষদ বাংলাদেশ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কুশল বিনিময়

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কুশল বিনিময়

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি

শিখ নেতা হত্যা, মোদীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ কানাডার

শিখ নেতা হত্যা, মোদীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ কানাডার

দলীয় ভিত্তিতে প্রশাসন সাজিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না: এ এম এম বাহাউদ্দীন

দলীয় ভিত্তিতে প্রশাসন সাজিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না: এ এম এম বাহাউদ্দীন

আদানির সঙ্গে জড়িত মোদিও: রাহুল গান্ধী

আদানির সঙ্গে জড়িত মোদিও: রাহুল গান্ধী

আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ২৫ ন‌ভেম্বর ঢাকায় আস‌ছেন

আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ২৫ ন‌ভেম্বর ঢাকায় আস‌ছেন

সোহেল-টুকু-হেলালসহ খালাস পেলেন বিএনপির ২২ নেতাকর্মী

সোহেল-টুকু-হেলালসহ খালাস পেলেন বিএনপির ২২ নেতাকর্মী

ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি

ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি

প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন

প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন

বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ

বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ

নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার

নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার

সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ

সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ

মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি

মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি

বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি

অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি

কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু

কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু

ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার

ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার