হেলাল হাফিজের এক জীবনের জন্মজখম বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র স্বর
২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম
কবি হেলাল হাফিজ ‘লৌহ অভিমানী’ কবি। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই একটা বিশেষ লক্ষ্য অভিসারী। কবির ২০১৯ সালে প্রকাশিত কবিতা সমগ্র ‘এক জীবনের জন্মজখম’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত ৯০টি কবিতা পাঠ করে মনে হলো, এ এক বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র কাব্যস্বর। প্রেম-বিরহের বিরল গরল আখ্যান।
এক জীবনের জন্মজখম-বিরহের মহাকাব্য। ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রেমিকবর এর এক দহন জর্জরিত বিরহনামা। প্রেম বিপর্যয়ের অমৃত দলিল।
জন্মদাগ যেভাবে মানবশিশু সারাজীবন বয়ে বেড়ায়। কবির জন্মজখম প্রাণপ্রেয়সীকে সারাজীবন না পাওয়ার বেদনা বয়ে বেড়ানো। বোহেমিয়ান বা বাউ-ুলে ( মানস জগতে ভবঘুরে) জীবন যাপন। প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্কা না করে কবি চিরকুমার ব্রতে জীবন পার করলেন। যেমন বাংলাদেশে প্রয়াত কবি জাহিদুল হক। মানবতাবাদী মার্কিন জাতীয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ছিলেন চিরকুমার। হুইটম্যান ছিলেন প্রথা বিরোধী। তবে মানবতাবাদী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শাসক কর্তৃক নির্যাতিত। নজরুলকে হুইটম্যানের অনুসারী মনে করা হয়।
এবার কবির কবিতা রাজ্যে প্রবেশ লাভের চেষ্টা করি। প্রথমেই সুবিখ্যাত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ থেকে
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’।
ইচ্ছে ছিল শিরোনামে কবিতায় প্রেমের পরাজয় নাকি বিপর্যয়? যখন কবি উচ্চারণ করেন ঃ
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো/
তোমাকে স¤্রাজ্ঞী করে সা¤্রাজ্য বাড়াবো,/
আজ দেখি রাজ্য আছে /
রাজা আছে / ইচ্ছে আছে, / শুধু তুমি অন্য ঘরে।
কবির জীবনের জন্মজখম এখানেই।
প্রতিমা কবিতায় প্রথম পংক্তি:
প্রেমের প্রতিমা তুমি, প্রণয়ের তীর্থ আমার।
শেষ পংক্তি:
তুমি জানো,পাড়া- প্রতিবেশী জানে পাইনি তোমাকে / অথচ রয়েছো তুমি এই কবি সন্ন্যাসীর ভোগে আর ত্যাগে।
প্রেয়সীকে তীর্থ বানিয়ে কবির যে বিরহ সাধনা। তাই কি ভোগের সন্ন্যাস?
অন্যরকম সংসার কবিতায় বলা হলো, রানাকে নিয়ে অন্যরকম সংসারে গোলাপ বাগান তৈরি করে হারিয়ে যাবো। আমরা দুজন ফুরিয়ে যাবো।এরপর সরাসরি উদ্ধৃতি-
তুমি আমি থাকবো তখন / অনেক দূরে অন্ধকারে, অন্যরকম সংসারেতে।
এক আশ্চর্য নস্টালজিয়া, অত্যাশ্চর্য বিরহ কল্পনা।
আমার সকল আয়োজন-কবিতায় চিত্রকল্প:
আমার আরেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,/ অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,/ পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে / সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফটি- ম্যাচের মতো বুকে।
হিরণবালা-কবিতায়:
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ / তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?
এভাবে ‘পরানের পাখি’, আমার কী এসে যাবে, কবিতায় কবির সংগোপন নিবেদন আর ভয়াবহ অভিমানগুলো কার প্রতি?
অহংকার-কবিতায় এসে কবি অভিমান ভুলে ব্যর্থতা জয়ে প্রাণপ্রিয়াকেই বিজয়মালা পরিয়ে যাচ্ছেন। কে কবির এ মানসপ্রিয়া?
দু পংক্তির কবিতা ‘কোমল কংক্রিট’:
জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,/ কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।
এটা প্রেমসিক্ত কবির চুড়ান্ত অভিব্যক্তি। এ সান্তনা অন্বেষণ কবির জন্মজখম। ‘লাবণ্যের লতা কবিতায় এক প্রচ্ছন্ন মায়াজাল প্রসৃষ্ট হয়েছে উপমায়-চিত্রকল্পে:
ভালোবাসাবাসিহীন এই দিন সব নয়- শেষ নয়/ আরো দিন আছে, / ততো বেশি দূরে নয়/ বারান্দার মতো ঠিক দরোজার কাছে।
ভিন্ন মেজাজের একটি কবিতা ‘ভূমিহীন কৃষকের গান’। চিরকুমার কবি যেন যৌবনের সার্থকতা নিয়ে শংকিত:
একদিন দিন চলে যাবে মৌসুম ফুরাবে,/ জরা আর খরায় পীড়িত খাঁ খাঁ/ অকর্ষিত ওলো জমি/ কেঁদে - কেটে কৃষক পাবে না।
কবুতর নামের কবিতা পাঠককে পড়ে স্বাদ নিতে অনুরোধ জানাবো। কবির জীবনদর্শন প্রিয়তমাকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন কবুতরের কাঁধে। যেভাবে কালিদাস তাঁর প্রিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছাবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মেঘকে। ‘নেত্রকোনা’ কবিতায় রয়েছে নির্মল কাব্য ভাবাবেগ। এতে মরণকে অদ্ভুত বলে জীবনের প্রতি গভীর মমত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ক্যামোফ্লাজ ছদ্মবেশ ধারণ বা লুকিয়ে যাবার সূত্র। গোপনীয়তা রক্ষার্থে মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা। অস্ত্র লুকিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে স্বাভাবিক সাজার এ কৌশল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কবি উক্ত কবিতায় বলতে চান,জীবন মরণকে ক্যামোফ্লাজের মতো (ছদ্মাবেশের মতো) আড়াল করে রাখে। প্রিয় জন্মস্থান নেত্রকোনাকে আদরের বোনের সাথে তুলনা করে স্মৃতিতে আত্মস্থ করেছেন কবি।
অভিমান ভুলে প্রাণপ্রিয়ার সাথে মিলিত হবার প্রবল আকাঙ্খার চিত্রল পংক্তিগুচ্ছ ‘তুমি ডাক দিলে’। তাছাড়া, হিজলতলীর সুখ, রাখাল, ব্যবধান, কে,অমীমাংসিত সন্ধি,ক্যাকটাস,হৃদয়ের ঋণ, প্রস্থান, ডাকাত প্রভৃতি কবিতা পাঠক নন্দিত বহুল পঠিত কবিতা। বিরহ ও অভিসার আকাক্সক্ষার হৃদয়গ্রাহী কবিতা।
তৃষ্ণা নামক কবিতা কবির চির একাকীত্বের প্রতিধ্বনি।
চতুষ্পদী, একপদী কবিতাগুলোও তাৎপর্যপূর্ণ।
যেমন:
তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো!
(সতীন)
বাসনা নামে ত্রিপদী কবিতায় কবির নিজ সৃষ্টি নিয়ে আকাঙ্খা হচ্ছে ঃ
আগামী, তোমার হাতে / আমার কবিতা যেন/ থাকে দুধে - ভাতে।
বলা হয়, হেলাল হাফিজ অল্প লিখেও গল্প হয়েছেন।নারীকে উপজীব্য করে প্রেম- বিরহের কবিতা লিখে বাংলার অন্যতম প্রধান কবির আসন পোক্ত করেছেন। জার্মান কবি হাইনের সাথে হেলালের তুলনা খুঁজে পাওয়া যায়। হেলাল হাফিজ বলেছেন, কবিতাই আমার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং প্রণয়ের একমাত্র মাধ্যম। ‘ষাটের দশকের অপরাপর কবিরা হচ্ছেন সিকদার আমিনুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমদ্রগুপ্ত, ও আবুল হাসান। হেলাল হাফিজকে বলা হয় - বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রী, শেষ গন্তব্যে মানবতাবাদী।
হেলাল হাফিজ এর জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯৪৮ নেত্রকোনায়। তিনি সাংবাদিক ও সাহিত্য সম্পাদক। তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এর পূণমূদ্রন হয় ৩৩ বারেরও বেশি। ২৬ বছর পর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।
দুঃখবাদকে আত্মস্থ করে বিরহের জপমালা জপেছেন কবি। একাকীত্বের সাধনায় শিল্পসাধনায় উত্তরণের এক অত্যাশ্চর্য সাধক হেলাল হাফিজ। দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪) প্রমুখের সাথে জড়িয়ে যতোইনা এ কবির তুলনা খোঁজা হোক। হেলাল হাফিজ নিজেই নিজের তুলনা। স্বতোৎসারিত ঝর্ণার ন্যায় নিখুঁত। জীবন যাপনে এবং কাব্য চর্চায় উভয় ক্ষেত্রে তিনি একান্ত নিজস্ব বৃত্তভিত্তিক।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘণকুয়াশায় আরিচা-কাজিরহাট, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ
আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিএনপি তার বিপরীত কাজ করে সুন্দর সমাজ গড়বে- কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের নেতা ইয়াকুব চৌধুরী
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত