রহস্যময় ঠাণ্ডা
০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম
ঢাকা শহরের কোনো এক ছোট্ট গলির গভীরে বসে একা চা খাচ্ছে আরিফ। ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা প্রবাহ মাঝে মাঝে তার মুখে এসে লাগে। মধ্যরাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে আশপাশের সবকিছুই যেন থমকে গেছে। তবে আরিফের মনের ভিতরে ঠিক উল্টো, উত্তাল এক সমুদ্রের মতো কিছু একটা দমবন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিছুদিন ধরে এই অস্বস্তি তাকে ছাড়ছে না, বিশেষত যখনই রাত গভীর হতে থাকে।
সত্যি বলতে, এই অস্বস্তি কেবল আরিফের মাথায় থাকা অযথা চিন্তা নয়। বিষয়টা শুরু হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে। সেই রাতেও এমন শীতল বাতাস বইছিল। সেদিনও রাত গভীর ছিল, আরিফ তখনও চা খাচ্ছিল, ঠিক আজকের মতোই। হঠাৎ তার ফোনে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। প্রথমে ভেবেছিল অচেনা কারো ভুল কল হবে। কিন্তু ধরা মাত্রই তার মনের ভেতর এমন একটা অদ্ভুত শীতল ভাব এসে পড়ল, যে সে ঠিক বোঝে উঠতে পারল না, কী ঘটে যাচ্ছে।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা ঠাণ্ডা, শীতল কণ্ঠ ভেসে এলো “তুমি কি জানো, তোমার পাশেই একজন অপেক্ষা করছে?” আরিফ ভ্রƒকুঁচকে তাকাল, গলার সুরটা যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তার স্নায়ুগুলোকে। কোন পাশের কথা বলা হচ্ছে? কিসের অপেক্ষা? সেদিন সেই কণ্ঠের আর কোনো কথা হয়নি। ফোনটা কেটে গিয়েছিল।
পরদিন সকালে আরিফ এটাকে এক ধরনের প্র্যাঙ্ক কল ভেবে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, এটা এখানেই শেষ হয়নি। প্রতিদিন রাত গভীর হলেই সেই একই কণ্ঠ থেকে একই ধরনের ফোন আসতে থাকে। প্রতিবারই যেন একটা শীতল বাতাস তার রক্ত হিম করে দেয়। ফোনের কণ্ঠটা কখনো তাকে প্রশ্ন করে, কখনো কিছু না বলেই কেটে দেয়। কিন্তু একদিন, সেই কণ্ঠ বলল, ‘তুমি কি জানো, তোমার ঠাণ্ডা লাগবে... খুব বেশি।’
আস্তে আস্তে এই ফোন কলের ঘটনাগুলো এত বেশি অদ্ভুত হয়ে উঠল যে আরিফ কৌতূহল দমাতে পারল না। কিছু একটা খুঁজতে শুরু করল সে। কোথা থেকে আসছে এই ফোন, কেন এই কণ্ঠ এমন রহস্যময়?
আরিফ একদিন তার এক বন্ধুকে নিয়ে পুরো বিষয়টা তদন্ত করতে শুরু করল। প্রথমে তারা ফোন নম্বর ট্রেস করতে গিয়ে একটা পুরনো বন্ধ হয়ে যাওয়া বাসার অবস্থান পায়। বাসাটা দেখতেই ভয়ানক, চারদিকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে আর পুরনো দেয়াল থেকে যেন কুয়াশার মতো কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ছে। ভিতরে ঢোকার সাহস হয়নি তাদের, কিন্তু আশপাশের লোকজন জানাল, এই বাসাটা বছর দশেক ধরে বন্ধ, সেখানে নাকি কোনো এক শীতের রাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল।
আরিফ সেই ঘটনার খোঁজ করতে লাগল। খোঁজ নিয়ে জানল, এই বাসার এক পরিবার এক রাতে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে শুধু তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়, আর মৃত্যুর কারণ অজানা। লোকমুখে শোনা যায়, সেই রাতের পর থেকেই বাসাটার চারপাশে রহস্যময় ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা অদ্ভুত খেলা শুরু হয়, যেন সেখান থেকে কেউ বেঁচে ফেরেনি।
আরিফ বুঝতে পারল, এই ঠাণ্ডার মধ্যে একটা অদৃশ্য রহস্য লুকিয়ে আছে। ঘটনা যতোই সামনে এগোচ্ছে, তার জীবন ততোই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তার ঘরের জানালা দিয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়া, ফোনের কণ্ঠস্বর, সেই পুরনো বাসার রহস্য সব মিলিয়ে একটা ভয়াবহ সত্য সামনে আসতে শুরু করল।
এক রাতে সেই অদ্ভুত ফোনের কণ্ঠ তাকে বলল, “তোমার সময় ফুরিয়ে আসছে... এই ঠাণ্ডা তোমাকেও নিতে আসছে।” কথাটা শুনেই আরিফের শরীর শিউরে উঠল। কিন্তু সে আর পিছু হটতে চায়নি। এবার সে সেই পুরনো বাসায় ঢোকার সিদ্ধান্ত নিল।
রাতের অন্ধকারে, ঠাণ্ডা বাতাসের শিহরণ বুকে নিয়ে সে বাসার দরজা খুলল। চারপাশে কুয়াশার মতো একটা ঘন আবরণ, বাতাসের সাথে মিশে থাকা শীতলত্ব যেন তার শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। ভেতরে ঢুকেই সে দেখতে পেল, একটা পুরনো মোমবাতির আলোয় বসে আছে একটা ছায়ামূর্তি। সেই মূর্তি ধীরে ধীরে তার দিকে তাকাল, আরিফকে কাঁপিয়ে দিলো তার শীতল দৃষ্টি। এই মূর্তিই সেই কণ্ঠের উৎস, সেই ভয়াবহ কণ্ঠ, যা প্রতিদিন ফোনে আরিফকে ডেকে নিয়ে আসছিল।
আরিফ জানতে পারল, এই মূর্তি আসলে আরিফের সামনে সেই ছায়ামূর্তির মুখে একটা বিকৃত হাসি ফুটে উঠল। সেই ঠাণ্ডা, শীতল কণ্ঠ আবারো ভেসে এলো “তুমি এসেছো, ঠিক যেমনটা আমি ভেবেছিলাম।” আরিফের শরীরটা যেন জমে গেল। সে বুঝল, এবার পালানোর কোনো পথ নেই।
ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে এলো। আরিফ পেছনে পা ফেলতে গিয়েও স্থির দাঁড়িয়ে রইল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে না। সেই মূর্তির কাছে এসে দাঁড়ালেই আরিফ হঠাৎ বুঝতে পারল, এই পুরো ঘটনা কেবল প্রতিশোধের নয়, বরং এই মূর্তি তাকে বেছে নিয়েছে তার নিজের দুর্বলতা আর অপরাধবোধের কারণে।
প্রতিদিন রাতের শীতল বাতাসে যে অস্বস্তি ছিল, তা আসলে তার নিজের ভেতরের এক ধরনের অপরাধবোধ। আরিফের জীবনের কিছু ভুল আর উপেক্ষিত সিদ্ধান্ত তাকে এই রহস্যের দিকে টেনে এনেছে। সেই মূর্তি আসলে আরিফের মনস্তাত্তিক প্রতিচ্ছবি, যে তার জীবনের ঠাণ্ডা, নির্জন দিকগুলোকে চিহ্নিত করছিল।
ছায়ামূর্তি হঠাৎ বলল, “তোমার দোষ কেউ জানে না, তবে তুমি জানো। তোমার পাপ তোমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, আর তা থেকেই তৈরি হচ্ছে এই শীতলতা।” কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল। মোমবাতির আলো নিভে গেল, আর ঘরটা গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল।
আরিফ বুঝতে পারল, এই রহস্যময় ঠাণ্ডা কেবল বাইরের প্রকৃতি নয়, বরং তার নিজের মনের ভিতরের অন্ধকার। তার ভুল, তার সিদ্ধান্ত, তার উপেক্ষা, সবকিছু মিলে এই রহস্যময় শীতলতার জন্ম দিয়েছে। এবং এই ঠাণ্ডা তাকে ছাড়বে না যতক্ষণ না সে তার জীবনের এই অপরাধবোধের মুখোমুখি হয়।
রাতটা কাটল গভীর চিন্তায়। আরিফ জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, শীতল বাতাস ধীরে ধীরে কমে আসছে। এই প্রথমবার সে বুঝল, নিজের জীবনের গভীর সত্যকে সামনে এনে তাকে মেনে নেয়াই তার মুক্তির একমাত্র পথ।
সকালে, সূর্যের আলো ঘরে ঢুকে পড়তেই আরিফ যেন নতুন আলো দেখতে পেল। জীবনের এই অন্ধকার, এই ঠাণ্ডা কাটানোর জন্য এবার তাকে নিজের মনের দিকগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে। আজকের দিনটা আরিফের জীবনে নতুন শুরু, নতুন চ্যালেঞ্জ। এই রহস্যময় ঠাণ্ডা আর তাকে আর ভয় দেখাতে পারবে না, কারণ সে এখন জানে এই ঠাণ্ডা কেবল তার মনের সৃষ্টি, আর সে তা জয় করতে প্রস্তুত।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গোয়ালন্দে ৩ টি বিদেশী পিস্তল- গুলি ও খালি ম্যাগাজিন উদ্ধার
গাজায় বর্বর হামলায় নিহত আরও অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানা থেকে হত্যা মামলার আসামি পলায়ন
চিরনিদ্রায় সাহিত হলেন এফডিইবি'র কেন্দ্রীয় সভাপতি প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন
ডাকসু নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে টানা কর্মসূচি ঘোষণা
গভীর রাতে উত্তাল ঢাকা আলিয়া
সংঘর্ষের পর দুটি বাস ও অ্যাম্বুলেন্সে আগুন, নিহত ৪
টানা তৃতীয়বারের মতো সুপার কাপের ফাইনালে বার্সালোনা
ইন্দোনেশিয়ার নতুন কোচ ক্লাইভার্ট
কোপ দেলরের শেষ ষোলোতে কে কার মুখোমুখি
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন গাপটিল
পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি লাখো মানুষের
ভোগান্তিতে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ
আদমদীঘিতে ফসলি জমিতে ফের কোল্ড স্টোর নির্মাণ
পদ্মার চরে শিকারিদের কবলে অতিথি পাখি
বাগেরহাটে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ ৮ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, আহত ২০
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি সোসাইটির নতুন কমিটি গঠন
বিপন্ন প্রজাতির হনুমান পাচারকালে ২ জনের কারাদ-
মিরপুরে তুরাগ নদী এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান
৪৮ ঘণ্টা পরও লাশ ফেরত দেয়নি বিএসএফ