একূল ওকূল

Daily Inqilab নাঈমুল হাসান তানযীম

২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৯ এএম

লোকটাকে অনেকদিন যাবত এলাকায় দেখি। কখনও হাঁটা অবস্থায়, কখনও চায়ের দোকানে, কাঁচা বাজারে। তবে অধিকাংশ সময়েই দেখি রিকশা চালানোরত।

সময়ে সময়ে মসজিদেও দেখা যায়। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, লোকটাকে যখনই যেখানে দেখেছি কোনো সময়েই তার মুখে হাসি ছিল না। হয়তো কারও সঙ্গে স্বাভাবিক আলাপচারিতায় কিংবা মুখ ভার।

এমনই মনে হয়েছে আমার।
লোকটার প্রতি দিনদিন কৌতূহল বেড়েই চলে আমার। শুনতে মন চায় তার জীবনের গল্প, যাপনের গল্প। সেদিন বিকেলে যখন মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলাম লোকটা আবারও সামনে পড়ল।

উদাসী মনে ধীরে ধীরে পা ফেলে হাঁটছে। আমার মনে হলো, এই মুহূর্তে লোকটার বিশেষ কোনো তাড়া নেই। কথা বলতে চাইলেও না করবে না। ঠিক তাই হলো। সাহস করে কাছে চলে এলাম।
‘আসসালামু আলাইকুম, চাচা কেমন আছেন?’

মনে হলো, আমার কথায় লোকটার গভীর ভাবনায় ছেদ পড়েছে। তবে বিরক্ত হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই সালামের জবাব দিলো।

‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ভালো আছি। আল্লাহ রাখছে ভালো।’
‘চাচাকে এই এলাকায় অনেকদিন ধরেই দেখি। মনে হয় রিকশা চালান। তাই না?’
‘হ, ভাতিজা।’

গম্ভীর কণ্ঠে লোকটার উত্তর।
‘আচ্ছা চাচা, কিছু মনে না করলে আসেন আমরা চা খাই। চা খেতে খেতে গল্পসল্প করি একটু।’
‘নারে বাবা, চা খাওয়ার মুড নাই এহন। চাইলে আসো একটু খোলামেলা জায়গায় হাঁটাহাঁটি করি।’

লোকটার কথামতো আমরা একটা শান্ত, নিরিবিলি জায়গা বেছে নিলাম। হাঁটতে লাগলাম আর প্রশ্ন করতে থাকলাম। লোকটি গম্ভীর অথচ স্বাভাবিক বলার ঢঙে বলে চলল জীবনের গল্প। আমি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকলাম।

‘আসলে ভাতিজা, আমি যতদিন এই শহরে আছি কোনোদিন কাউরে বলি নাই এসব। কেউ জানবারও চায় নাই। তুমিই প্রথম জানতে চাইলা। কিন্তু সত্যি কথা কি, মানুষ আসলে নিজের ব্যর্থতার গল্পটা সহজে কাউরে কইতে চায় না। কী-ইবা লাভ তাতে, বলো! শুধু দুঃখই বাড়ে। পুরানা কষ্টগুলা তাজা হয়া ওঠে। জীবনডারে চিরতরে শেষ কইরা দিতে মন চায় তহন। তয় শোনো, আজ থেইকা সাতাইশ বছর আগের কাহিনী এটা। আমি ছিলাম তখন শক্তসমর্থ যুবক। শিক্ষিত ছিলাম না যদিও, কিন্তু কিছু একটা কইরা রুটিরুজির গুজরান করা আমার জন্য কঠিন কিছু ছিল না। আমার দেশের বাড়ি তো ছিল সুনামগঞ্জে কিন্তু কর্মস্থল ছিল সিলেট ভোলাগঞ্জ। সেখানে আমি বিভিন্ন ভারী ভারী কাজ করতাম। টাকা পয়সাও পাইতাম ভালো। বাড়িতে ছিল শুধু আমার মা। বড় ভাই ছিল। কিন্তু সে আমার আর আমার মায়ের কোনো খোঁজখবর রাখত না। মা আর আমি আলাদা বাড়িতে থাকতাম। যে টাকা কামাইতাম তা দিয়া বেশ ভালোই কাইটা যাইত। একদিন আম্মা কইল কি, ‘জয়নাল, তোর লাইগা একটা বউ দেখছিরে বাপ, খুব সুন্দর একটা বউ! আমার সব পছন্দ হইছে। বাকি কাউরে এহনো কিছু জানাই নাই। ভাবলাম, তোর কাছে আগে পাড়ি কথাটা।’

আমি লজ্জায় পইড়া গেলাম। মায় এইডা কইল কি! শেষে লজ্জা ভাইঙা বইলাই ফালাইলাম। ‘মা! তোমার পছন্দ হইলে হেনে আমার কথার কিছু নাই। তুমি যা ভালা মনে করো।’ এর ঠিক সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই ধুমধামে আমাদের বিয়ে হয়া গেলো। আমাদের দুইজনের পরিবারে যুক্ত হইল তৃতীয় আরেকজন। তারে নিয়া আমার নতুন জীবন শুরু হইল। মনে হইল, আমার জীবনডা পূর্ণতা পাইছে। বেশ কিছুদিন বাড়িতে থাকার পরে আমি আবারও থিতু হইলাম আপন কর্মস্থলে। বাড়ি থেইকা শত মাইল দূরে। কিন্তু মনডা খালি আনচান করে বাড়ির লাইগা।

সময় গড়ায়া যায় নদীর মতোন। ছুটিতে ছুটিতে আমি বাড়িতে আসি। আবারও ফিইরা যাই ভোলাগঞ্জে। এইভাবেই কাইটা যায় অনেকগুলি বছর। এর ভিতরে নানা ঘটনা অঘটনা ঘইটা যায়। আমার দুইটা পুত্র সন্তান হয়। তারা বড় হইতে থাকে।

বন্যার কবলে পইড়া ঘরবাড়ি সব ডুইবা যায়। তবে সবচে বেদনাদায়ক এবং কষ্টের ঘটনা যেইটা ছিল সেইটা হইল আমার মায়ের মৃত্যু। সবকিছু সহ্য কইরা নিলেও মায়ের মৃত্যুটা কিছুতেই সহ্য করার শক্তি ছিল না আমার।

স্বাভাবিক, সুন্দর জীবনে তখন হঠাৎ একটা ছন্দপতন ঘইটা যায়। স্ত্রী সন্তানদের থেইকা ক্রমশ বাড়তে থাকে দূরত্ব। বাড়িতে যাই না। কারও খোঁজখবর রাখি না তেমন একটা। শহরেই পইড়া থাকি।

কী ভাইবা যেন গ্রামে আর ফিইরা যাই না। এরই মধ্যে আরেকটা খারাপ জিনিস ঘটায়া ফেলি, যার শেষ পরিণতি আমার বর্তমান অবস্থা। ঘটনাটা হইল, যে এলাকায় আমি কাজ করতাম ওই এলাকারই একটা মহিলারে বিয়া কইরা ফেলি।

মূলত ওই মহিলা ছিল অনেক টাকা পয়সার মালিক। চেহারা এতো সুন্দর না হইলেও তার ছিল অঢেল ধনসম্পত্তি। আর আমি তো ছিলাম সুঠাম দেহের যুবক। কেমনে জানি আমারে তার পছন্দ হয়।

আমি তখন আমার বিবাহিত জীবনের কথা গোপন কইরা রাখি। পুরান স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ কইরা দেই। নতুন স্ত্রীকে নিয়া নতুনভাবে সংসার পাতি। তবে এখন আর কষ্ট কইরা কাজ করতে হয় না।

স্ত্রী আমার দুই হাতে খরচ করতে থাকে। খুব স্বাচ্ছন্দ্যেই চলতে থাকে দিন। ওদিকে গ্রামে রইটা যায় আমি মারা গেছি। যেহেতু কারও সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখি নাই, তাই সবার মাঝে চাউর হয়া যায়, আমি বাঁইচা নাই।

তারই মধ্যে একদিন নতুন স্ত্রী বায়না ধরে, আমার গ্রামের বাড়ি থেইকা ঘুইরা আসবে। আমি তখন না করি শুধু আর বলি, কোনো একসময় যামু, কথা দিলাম। কিন্তু সে নাছোড়। যাবেই যাবে।

শেষমেশ কী ভাইবা জানি রওনা হয়া গেলাম গ্রামের বাড়ির দিকে। তখন মাথায় একটুও খেয়াল হয় নাই, বাড়িতে আসলে কী হইব না হইব।
গ্রামে যখন পৌঁছাই তখন ঠিক দুপুর দুইটা। পুরা এলাকায় বিদ্যুৎ গতিতে খবর ছড়ায়া যায়, ‘জয়নালে নতুন বউ নিয়া আইছে।’ বাড়ির সামনে আসতেই শুনি কান্নার আওয়াজ। আমার প্রথম স্ত্রী গড়াগড়ি কইরা কানতেছিল।

দ্বিতীয় স্ত্রী’র এ সবকিছু টের পাইতে বেশি সময় লাগে নাই। সে আমারে গুইনা গুইনা তিনটা থাপ্পড় মারল। তারপর ব্যাগটা নিয়া সেইখানেই সোজা উল্টা পথ ধরল। এলাকার নেতাগোছের মানুষজন একসাথে হইল। কী ঘটছে না ঘটছে সবকিছু শুনল। সবার মধ্যে ছিঃ ছিঃ রব উঠল। বন্ধুবান্ধব সবার মুখে মুখে একটাই কথা—‘জয়নাল, তুই এমনডা করতে পারলি!’

আমার প্রথম স্ত্রীর এক কথা। এমন বিশ্বাসঘাতক পুরুষের সঙ্গে সে আর একটা মুহূর্তও থাকতে চায় না। দুই চোক্কের সামনে দেখতে চায় না আমারে। সন্তানরাও আমার কাছে আসে না। আমি হয়া যাই সবখানে অগ্রাহ্য, অনাদৃত। কোনো জায়গাতেই আর আমার ঠাঁই হয় না শেষে। বাধ্য হয়া তাই আমি নিরুদ্দেশ হয়া যাই। এই যে তুমি আমারে চাইরটা বছর ধইরা এই এলাকায় দেখাতেছো এর মধ্যে কখনও দেখছো এই এলাকা ছাইড়া অন্য কোথাও যাইতে?

‘না তো।’
দুই শব্দে আমি চাচার কথার জবাব দিই। লোকটা তারপর আর কথা বলতে পারে না। বাঁধভাঙা অশ্রুতে বুক ভাসায়। তা দেখে আমার ভীষণ মায়া হয়। সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা খুঁজি। কিন্তু উপযুক্ত শব্দের অভাবে তা আর হয় না। কেবল বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটা দুঃসহ দীর্ঘশ্বাস।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

স্মৃতির করিডোরে
বাংলা সাহিত্যের অলঙ্কার মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য
নববর্ষের ঘোষণা
রক্তমাখা শার্ট
জেগে থাকো পূর্ণিমা : সমাজ বাস্তবতার আখ্যান
আরও

আরও পড়ুন

দেশে ব্যবসা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, নতুন সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা

দেশে ব্যবসা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, নতুন সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা

পাকিস্তানে গ্যাসের ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নিহত ৬, আহত ৩১

পাকিস্তানে গ্যাসের ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নিহত ৬, আহত ৩১

মহাখালীতে পরিবহন শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজট

মহাখালীতে পরিবহন শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ, তীব্র যানজট

সাড়ে ১৬ বছর কারাভোগের পর, বাড়ি ফিরলেন উখিয়ার সাবেক বিডিআর সদস্য ইউসুফ

সাড়ে ১৬ বছর কারাভোগের পর, বাড়ি ফিরলেন উখিয়ার সাবেক বিডিআর সদস্য ইউসুফ

ডাকাতি কালে ভারতীয় ৩ দস্যুকে ধরে কোস্ট গার্ডে দিলো জেলেরা

ডাকাতি কালে ভারতীয় ৩ দস্যুকে ধরে কোস্ট গার্ডে দিলো জেলেরা

‘সেনাবাহিনীকে বণিক সমিতি বানিয়েছে হাসিনা, এর সংস্কার করতে হবে’

‘সেনাবাহিনীকে বণিক সমিতি বানিয়েছে হাসিনা, এর সংস্কার করতে হবে’

তাবলীগের সাদপন্থিদের প্রধান মুরব্বিসহ ২৩ জনের জামিন বহাল

তাবলীগের সাদপন্থিদের প্রধান মুরব্বিসহ ২৩ জনের জামিন বহাল

বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকস্তরে পাঠ্যপুস্তক সরবারহের হার হতাশাব্যঞ্জক

বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকস্তরে পাঠ্যপুস্তক সরবারহের হার হতাশাব্যঞ্জক

কোকোর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, এ রহস্য উদঘাটন করা হবে : ডা. জাহিদ

কোকোর মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না, এ রহস্য উদঘাটন করা হবে : ডা. জাহিদ

নীলক্ষেতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন

নীলক্ষেতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন

অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প-কলম্বিয়া সম্পর্কের টানাপোড়েন

অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প-কলম্বিয়া সম্পর্কের টানাপোড়েন

কঙ্গোতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিরাপদ রয়েছেন : আইএসপিআর

কঙ্গোতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা নিরাপদ রয়েছেন : আইএসপিআর

আলোচনায় থাকতেই ক্যান্সারের ভান অভিনেত্রী হিনার

আলোচনায় থাকতেই ক্যান্সারের ভান অভিনেত্রী হিনার

এস. কে. সুরকে নিয়ে যা বললেন আসিফ নজরুল

এস. কে. সুরকে নিয়ে যা বললেন আসিফ নজরুল

যুবদল নেতা রাসেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ উপজেলাবাসী,  কারণ দর্শানোর নোটিশ

যুবদল নেতা রাসেলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ উপজেলাবাসী, কারণ দর্শানোর নোটিশ

ঢাবির পর এবার সাত কলেজের পরীক্ষা স্থগিত

ঢাবির পর এবার সাত কলেজের পরীক্ষা স্থগিত

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন- শেরপুরের পুলিশ সুপার

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন- শেরপুরের পুলিশ সুপার

আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন পরীমণি

আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন পরীমণি

বাংলাদেশে একটি বড় হাসপাতাল করে দেবে চীন : পররাষ্টা উপদেষ্টা

বাংলাদেশে একটি বড় হাসপাতাল করে দেবে চীন : পররাষ্টা উপদেষ্টা

জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নাইজেরিয়ায় নিহত ১৮

জ্বালানি ট্যাঙ্কার বিস্ফোরণে নাইজেরিয়ায় নিহত ১৮