উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী প্রথম মুসলিম কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী
১৮ জুলাই ২০২৩, ০৩:৪৯ পিএম | আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৩, ০৩:৪৯ পিএম
গতকাল ১৭ জুলাই উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম মুসলিম কবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী'র ৯২তম প্রয়াণ দিবস। সিরাজী ছিলেন একজন বাঙালী লেখক, কবি, অনলবর্ষী বক্তা, রাজনৈতিক এবং সাংবাদিক। তিনি ১৯ শতকের শেষ থেকে ও ২০ শতকের ৩য় দশক সময়কালের বাঙালী মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রবক্তাদের একজন। তিনি মুসলিমদের জন্যে বিজ্ঞানসাধনা, মাতৃভাষাচর্চা, নারীদের শিক্ষা এসবের পক্ষে লেখালেখি করেন। তার অনল-প্রবাহ (১৮৯৯) কাব্যগ্রন্থটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। স্বাধীনতার জন্য লিখে উপমহাদেশের প্রথম কবি হিসেবে ৩ বার কারাবন্দী হন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় কবি হিসেবে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ডাক দেন। ব্রিটিশ সরকার তার জীবদ্দশায় ৮২ বার তার বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি করে। তিনি বাংলায় খিলাফত আন্দোলন (১৯২০) প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অবদান রাখেন। বলকান (১৯১২-১৩) যুদ্ধের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্যকে (১২৯৯-১৯২৪) অর্থের পরিমান প্রকাশ না করার শর্তে তিনি অর্থ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন।
সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ১৩ই জুলাই ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মস্থানের সম্মানে নামের শেষের 'সিরাজী' পদবী যুক্ত করেন। সৈয়দ শব্দটি তার আরব বংশকে বোঝায়। যা পূর্বপুরুষ খলিফা হজরত আলী (রা) সাথে সম্পর্কিত। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ আলী আজম ইরান থেকে বাংলায় পাড়ি জমান এবং মুঘল দরবারে চাকুরী লাভ করেন। আজম প্রথমে নদীয়া'র আমলাবাড়িতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তার বংশধরদের অনেকেই ইউনানি ওষুধের অনুশীলনকারী ছিলেন। সিরাজীর পিতা মৌলভী শাহ সৈয়দ আবদুল করিম খন্দকার (১৮৫৬-১৯২৪) ছিলেন একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর এবং ইউনানি অনুশীলনকারী। তার মা নূরজাহান খানম ছিলেন পশতুন বংশোদ্ভূত।
শৈশবে তিনি স্থানীয় পাঠশালা ও জ্ঞানদায়িনী মাইনর ইংরেজী স্কুলে পড়েন। এরপর তিনি সিরাজগঞ্জ বনোয়ারীলাল হাই স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সিরাজী পাঠশালায় ফার্সী এবং বাড়িতে সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন আর সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যের সাথে হিন্দুশাস্ত্র যেমন - বেদ, মনুস্মৃতি ও উপনিষদ প্রভৃতি অধ্যয়ন করেছিলেন।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বক্তা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তৎকালীন বাঙালী মুসলিমদের পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করতেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমিতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন। যেমন, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, স্বরাজ পার্টি, কৃষক সমিতি ইত্যাদি।
ছাত্রাবস্থায়ই সিরাজী কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং ধর্মবক্তা মুনশী মেহেরউল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) এর এক জনসভায় তার "অনল প্রবাহ" কবিতাটি পাঠ করেন। মুনশী মেহেরউল্লাহ কবিতা শুনে মুগ্ধ হন এবং নিজ ব্যয়ে ১৮৯৯ সালে কাব্যটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। পরে এটি ১৯০০ সালে পূর্ণ গ্রন্থকারে প্রকাশ পায়। ১৯০৮ সালের শেষদিকে বইটির বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। যা তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে আর তার প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সিরাজী তখন ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগরে গিয়ে ৮ মাস আত্মগোপন করে থাকেন। এরপর একপর্যায়ে তিনি পাহাড় এমনকি জঙ্গলেেও আত্মগোপন করেন। সেইসময় তিনি তার বহুল আলোচিত "রায়নন্দিনী" উপন্যাস-সহ আরো বেশ কিছু লেখা শেষ করেন। তার লেখা শেষ হলে আত্মসমর্পণ করেন। তবুও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তাকে দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
বলকান যুদ্ধ (১৯১২-১৩) এর সময় ভারতে ডাঃ মোখতার আহমদ আনসারী (১৮৮০-১৯৩৬) এর নেতৃত্বে "ইন্ডিয়ান রেড ক্রিসেন্ট" গঠিত হয়। এই সংগঠন একদল চিকিৎসকসহ 'অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল মিশন' প্রেরণ করে। সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) মিশনের বঙ্গীয় প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্কে যান। সেখানে তিনি তুর্কী স্বাস্থ্য দফতরের ইন্সপেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধ শেষে তুরস্ক সরকার তাকে "গাজী-এ বলকান" (১৯১৩) উপাধী দেয়। বলকান যুদ্ধে সিরাজী'র যোগদানের ইতিকথা পরবর্তীতে তুর্কী ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। যা বর্তমানে "আংকারা মিউজিয়াম"- এ সংরক্ষিত রয়েছে। তৎকালীন তুর্কী সরকার তাকে পুরস্কার স্বরূপ শাহী পোশাক, সোনার চাঁদ লাগানো তুর্কী টুপি এবং আরো অনেক উপঢৌকণ প্রদান করেন। সিরাজী তার তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০) গ্রন্থে এই সফরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। জানা যায়, ১৯১৪ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মেডিকেল টিম গঠন করে তুরস্ক গমন করেছিলেন।
১৯১৯ সালে সিরাজী মাসিক নূর নামে একটি পত্রিকা বের করেন। তার নিজের মহাশিক্ষা মহাকাব্য এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এর কয়েকটি গল্প এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে সিরাজী ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) এর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক "ছোলতান"। সিরাজীর অধিকাংশ প্রবন্ধই এই পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। পরবর্তীকালে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) এর "বিদ্রোহী" কবিতা প্রকাশিত হলে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) তার প্রতি খুশী হয়ে সেইসময় ১০ টাকা মানিঅর্ডার পাঠিয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
প্রাথমিকভাবে সিরাজী সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানি (১৮৩৮-১৮৯৭) এর প্যান ইসলামিজম সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। তবে তাকে মুসলিম পুনর্জাগরণের চিন্তায় বেশি প্রভাবিত করেন প্রায় সমসাময়িক শিবলী নোমানী (১৮৫৭-১৯১৪) এবং মহাকবি আল্লামা ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮)।
বাঙালী মুসলমানের গৌরব সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ১৯৩১ সালে ১৭ জুলাই আপনগৃহ বানীকুঞ্জে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী'র রাজনৈতিক আদর্শ সাহিত্যকর্মেও দৃশ্যমান। তার রচনাসমূহকে ইসলামী সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবে কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) মন্তব্য করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) এর বৈশিষ্ট্যসূচক "উগ্র জাতীয়তাবাদ" মুসলমানদের মধ্যে সিরাজীর রচনাতে প্রথম দেখা যায়। উল্লেখ্য, সিরাজী বঙ্কিমচন্দ্রের "দুর্গেশনন্দিনী"(১৮৬৫) এর প্রতিক্রিয়ায় তার "রায়নন্দিনী" (১৯১৫), লেখেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এর গীতাঞ্জলির প্রতিযোগী হিসেবে লেখেন প্রেমাঞ্জলি। তথাপি সময়োপযোগী হওয়ায় তখন তার উপন্যাস ও কবিতা পঠিত ও জনপ্রিয় হয়।
তার গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে, কাব্যগ্রন্থ: অনল-প্রবাহ (১৯০০), আকাঙ্ক্ষা (১৯০৬), উছ্বাস (১৯০৭), উদ্বোধন (১৯০৭), নব উদ্দীপনা (১৯০৭), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪), মহাশিক্ষা মহাকাব্য (১ম খণ্ড-১৯৬৯, ২য় খণ্ড-১৯৭১)। গান: সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), প্রেমাঞ্জলি (১৯১৬)। প্রবন্ধ: স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), স্বজাতি প্রেম (১৯০৯), আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯১৬), সুচিন্তা (১৯১৬), তুর্কী নারী জীবন (১৯১৩), মহানগরী কর্ডোভা, আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা। ভ্রমণ কাহিনী: তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০)। উপন্যাস: রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), ফিরোজা বেগম (১৯১৮), নূরউদ্দীন (১৯১৯), জাহানারা (১৯৩১), বঙ্গ ও বিহার বিজয় (১৮৯৯; অসমাপ্ত), বঙ্কিম দুহিতা। এছাড়াও বাংলা একাডেমী থেকে তার উপন্যাসসমূহ প্রকাশিত হয়েছে।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা