ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

১০ জুলাই, ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র ১৩৯তম জন্মবার্ষিকী

Daily Inqilab আকাশ হাসান

১২ জুলাই ২০২৪, ০৮:০৭ এএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ০৮:০৭ এএম

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজ থেকে ১৩৯ বছর আগে ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার নাম ছিল মুহম্মদ ইব্রাহীম। পরবর্তীকালে তার মায়ের স্বপ্নে প্রাপ্ত নাম মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাখা হয়। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। তিনি ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। তিনি ভাষাবিজ্ঞানে পড়াশোনায় আগ্রহী ছিলেন। আর্থিক অনটনের কারণে খ্রিস্টান কলেজে ভর্তির আবেদন না করে হিন্দু কলেজে ভর্তির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ভালো ফলাফল থাকা সত্বেও মুসলিম ছাত্র হিসেবে হিন্দু কলেজে ভাষাবিজ্ঞানে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তিনি ১৯১০ সালে সিটি কলেজ (কলকাতা) থেকে সংস্কৃতে সম্মান-সহ বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) ডিগ্রী অর্জন করেন। এ ছাড়াও, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় (প্যারিস) থেকে পি.এইচডি ডিগ্রী (১৯২৮) লাভ করেন।

কর্মজীবনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯০৮ সালে যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বেদ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তারপর সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) এর সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসী ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করেন। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন। তিনি প্রায় ৪০টি ভাষা জানতেন। যার মধ্যে ১৮টি ভাষায় বলতে, লিখতে এবং পড়তে পারতেন। জানা যায়, তিনি বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি, ইংরেজি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলী, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানী ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমীতে যোগদান করেছিলেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমীর ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমী কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমীর পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়। শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি এবং উর্দু অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক ছিলেন। তার সম্পাদনা ও প্রকাশনায় মুসলিম বাংলার প্রথম শিশুপত্রিকা "আঙুর" (১৯২০) আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ইংরেজী মাসিক পত্রিকা "দি পীস" (১৯২৩), বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা "বঙ্গভূমি" (১৯৩৭) এবং পাক্ষিক "তকবীর" (১৯৪৭) সম্পাদনা করেন।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – সিন্দবাদ সওদাগরের গল্প (১৯২২), ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১), বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৩৬), দীওয়ান-ই-হাফিজ (১৯৩৮), শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ (১৯৪২), রুবাইয়াত-ই-উমর খইয়াম (১৯৪২), Essays on Islam (১৯৪৫), আমাদের সমস্যা (১৯৪৯), পদ্মাবতী (১৯৫০), বাংলা সাহিত্যের কথা ১ম খন্ড (১৯৫৩), বিদ্যাপতি শতক (১৯৫৪), বাংলা আদব কী তারিখ (১৯৫৭), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (১৯৫৭), বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৫৯), Buddhist Mystic Songs (1960), কুরআন শরীফ (১৯৬৩), অমরকাব্য (১৯৬৩), বাংলা সাহিত্যের কথা ২য় খন্ড (১৯৬৫), সেকালের রূপকথা (১৯৬৫) মহররম শরীফ, টেইল ফ্রম দি কুরআন, Hundred Sayings of the Holy Prophet ইত্যাদি। তাঁর সম্পাদিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এক বিশেষ কীর্তি। মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) এর সঙ্গে তাঁর যুগ্ম-সম্পাদনায় রচিত Traditional Culture in East Pakistan (১৯৬১) একখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর Buddhist Mystic Songs (১৯৬০) গ্রন্থটি চর্যাপদের অনুবাদ ও সম্পাদনা কর্ম। তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন যে চর্যাপদ সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় রচিত। এর ধর্মতত্ত্ব নিয়েও তিনি আলোচনা করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে ক’জন ব্যক্তি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানিই প্রশস্ত হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক ”নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স” দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পদক’ (১৯৫৮) ও ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) এবং ২০০২ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) দেওয়া হয়। তিনি ‘চলন্ত শব্দ কল্পদ্রুম’ বলেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। তার স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘’শহীদুল্লাহ হল’’। এছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা