আজ ২৭ সেপ্টেম্বর সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ৮ বছর পূর্বে আজকের দিনে মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী সাহিত্যিক। কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটক, ছোটগল্প, অনুবাদ তথা সাহিত্যের সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে 'সব্যসাচী লেখক' বলা হয়। তার সাহিত্যজীবন প্রায় ৬৫ বছর ব্যাপী বিস্তৃত। সৈয়দ শামসুল হক মাত্র ৩১ বছর বয়সে ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সী এই পুরস্কার অর্জনকারী ব্যক্তি।

বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় সৈয়দ শামসুল হক জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এবং মা হালিমা খাতুন। বাবা পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে সবার বড়। সৈয়দ শামসুল হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম ইংলিশ হাই স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে সৈয়দ শামসুল হক ম্যাট্রিক (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সৈয়দ শামসুল হকের বাবার ইচ্ছা ছিল তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। বাবার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ১৯৫১ সালে বম্বে চলে যান। সেখানে তিনি বছর-খানেকের বেশি সময় এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। ঐ বছর প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ "তাস"। স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সনে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। সেই বছর প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস "দেয়ালের দেশ"।

সৈয়দ শামসুল হক তার বাবা মারা যাবার পর মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়েন। পারিবারিক অর্থকষ্ট দূর করতে জড়িয়ে পড়েন চলচ্চিত্রের সাথে। শুরু করেন চিত্রনাট্য লেখা। ১৯৫৯ সালে তার চিত্রনাট্যে "মাটির পাহাড়" চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এরপর চলচ্চিত্র যথাক্রমে- তোমার আমার (১৯৬১), শীত বিকেল (১৯৬৪), কাঁচ কাটা হীরে (১৯৭০), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), মাটির মায়া (১৯৭৬), বড় ভাল লোক ছিল (১৯৮২), পুরস্কার (১৯৮৩), অভিযান (১৯৮৪) সহ আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং গান লিখেন। বড় ভাল লোক ছিল ও পুরস্কার নামে দুটি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। "হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস", "চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা"সহ অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা তিনি।

১৯৬৫ সালে তিনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে তিনি লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসির বাংলা খবর পাঠক হিসেবে চাকুরী গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসর্মপণের খবর পাঠ করেছিলেন। পরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণের মধ্যে পরিচিতি লাভ করেন।

সৈয়দ শামসুল হকের রচিত প্রথম পদ ছিল "আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপরে দুটি লাল পাখি বসিয়া আছে"। টাইফয়েড আক্রান্ত এই ২টি লাইন তিনি লিখেছিলেন ১১-১২ বছর বয়সে। এরপর ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে ব্যক্তিগত খাতায় ২০০টির মতো কবিতা রচনা করেন।

ফজলে লোহানী সম্পাদিত 'অগত্যা' পত্রিকায় সৈয়দ শামসুল হকের "উদয়াস্ত" নামে একটি গল্প প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে। তার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ "তাস" (১৯৫৪)। এছাড়াও রয়েছে শীত বিকেল (১৯৫৯), রক্তগোলাপ (১৯৬৪), আনন্দের মৃত্যু (১৯৬৭), জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০) প্রভৃতি। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- একদা এক রাজ্যে (১৯৬১), বিরতিহীন উৎসব (১৯৬৯), বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা (১৯৭০), প্রতিধ্বনিগণ (১৯৭৩), অপর পুরুষ (১৯৭৮), পরাণের গহীন ভিতর (১৯৮০), নিজস্ব বিষয় (১৯৮২), অগ্নি ও জলের কবিতা (১৯৮৯), কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে (১৯৯০), আমি জন্মগ্রহণ করিনি (১৯৯০), ধ্বংসস্তূপে কবি ও নগর (২০০৯) প্রভৃতি। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে - দেয়ালের দেশ (১৯৫৬), এক মহিলার ছবি (১৯৫৯), অনুপম দিন (১৯৬২), সীমানা ছাড়িয়ে (১৯৬৪), নীল দংশন (১৯৮১), স্মৃতিমেধ (১৯৮৬), স্তব্ধতার অনুবাদ (১৯৮৭), স্বপ্ন সংক্রান্ত (১৯৮৯), বারো দিনের শিশু (১৯৮৯), বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল (১৯৮৯), ত্রাহি (১৯৮৯), তুমি সেই তরবারী (১৯৮৯), নির্বাসিতা (১৯৯০), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৯০), খেলারাম খেলে যা (১৯৯১), ইহা মানুষ (১৯৯১) প্রভৃতি। নাটকের মধ্যে রয়েছে - পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), গণনায়ক (১৯৭৬), নুরলদীনের সারাজীবন (১৯৮২), এখানে এখন (১৯৮৮), কাব্যনাট্য সমগ্র (১৯৯১) এছাড়াও তার "ঈর্ষা", "বাংলার মাটি বাংলার জল", "নারীগণ" নামে আরো ৩টি নাটকের নাম জানা যায়। প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে - হৃৎ কলমের টানে (১ম খণ্ড; ১৯৯১, ২য় খণ্ড; ১৯৯৫), মার্জিনে মন্তব্য। শিশু সাহিত্য- সীমান্তের সিংহাসন (১৯৮৮), আনু বড় হয়, হডসনের বন্দুক প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে অন্তর্গত (কথাকাব্য), প্রণীত জীবন (আত্মজীবনী)। অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- শ্রাবণ রাজা (১৯৬৯), ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, এক নারীর জীবন প্রভৃতি।

তিনি সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৬) ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (১৯৮৪), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০০), আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৯), অলক্ত স্বর্ণপদক (১৯৮২), আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), টেনাশিনাস পদক (১৯৯০), মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কার (২০১১), ব্র্যাক ব্যাংক- সমকাল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১) সহ অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন।

২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল সৈয়দ শামসুল হকের ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিলে লন্ডন নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে পরীক্ষায় তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেয়। চার মাস চিকিৎসার পর ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ (১২ আশ্বিন ১৪২৩ বঙ্গাব্দ) ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন চ্যানেল আই টেলিভিশনের তেজগাঁও চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং এবং নিজগ্রাম কুড়িগ্রামে জানাজা শেষে, তার মৃতদেহ কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পাশে দাফন করা হয়।