রাশিয়ার আওয়ামীসুলভ বক্তব্য গণতান্ত্রিক অনুভূতিতে আঘাত করেছে : বিএনপি

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম

নির্বাচন নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ও আওয়ামীসূলভ বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে একথা বলা হয়। এর আগে “ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে বিএনপির বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি দাবি করেন, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে নির্বাচিত করেছে এবং ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে, যাদের অধিকাংশ ভোট দিয়েছে আওয়ামী লীগকে।

বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়, তাঁর এই অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ও আওয়ামীসূলভ বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অনুভূতিতে আঘাত করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বলয়ের বাইরের সকল বাংলাদেশি নাগরিক আজ, নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতা হারিয়ে, নিজ দেশে পরাধীন। গত ১৫ বছর ধরে, গণবিদ্বেষী সরকার যে দুর্নীতি-দুঃশাসন ও দমন-দুর্বৃত্তায়ন চালিয়েছে, সমাজের প্রতিটি শ্রেণী ও পেশার মানুষ তাতে বৈষম্য, অবিচার ও নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন। এটি স্পষ্টত প্রমাণিত, ৭ জানুয়ারি যে প্রহসনমূলক ডামি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার উদ্দেশ্য জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা বা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ছিল না। বরং, নির্বাচনের নামে এটি ছিল জাতির সঙ্গে একটি সহিংস প্রতারণা, যার উদ্দেশ্য নিশিরাতের ভোটে অবৈধভাবে, অনৈতিকভাবে ও অসাংবিধানিকভাবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের স্বার্থবাদী, কর্তৃত্ববাদী অনুগত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সহায়তা ও সমর্থনে কুক্ষিগত ক্ষমতার মেয়াদ বৃদ্ধি করা।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে, ভোট ডাকাতির অভিনব সব পন্থা অবলম্বন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে কলঙ্কিত ইতিহাস তৈরি করে তারই ধারাবাহিকতায় ডামি প্রার্থী, ডামি দল, ডামি ভোটার ও ডামি পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে ডামি নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর অংশ হিসেবে, যে ভোট পড়েছে বলে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন, তার বিপরীতে, সারা দেশের ভোটকেন্দ্রগুলো থেকে প্রাপ্ত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও, তথা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, সত্যিকার অর্থে শতকরা ৫ ভাগেরও কম ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়েছেন। ভাগ-বাঁটোয়ারার এই কারসাজির নির্বাচনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার রক্ষাকবচ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল জনগণ প্রমাণ করেছে, বিএনপি ও ৬২টি গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক তথা গণআকাক্সক্ষার প্রতিফলন।

এতে উল্লেখ করা হয়, শীর্ষ নেতৃত্বসহ প্রায় ২৫ হাজার বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের গ্রেফতারে তথাকথিত এই নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত ফলাফল ঘোষণার পর, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার হতাশা পোষণ করেন। সকল বাংলাদেশিদের ভবিষ্যত হুমকির মুখে মন্তব্য করে তিনি আহ্বান জানান, বাংলাদেশের বর্তমান গতিপথ পরিবর্তন করে, একটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির। একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষত সব বড় রাজনৈতিক দল অংশ না নেওয়ায়। সেই সঙ্গে, সকল নির্বাচনি অনিয়মের সময়োপযোগী ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নিশ্চিত করার আহ্বানও জানায় তারা।

নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি বলে অন্য পর্যবেক্ষকদের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সহমত পোষণ করে যুক্তরাষ্ট্র। হাজারো বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর গ্রেফতার এবং নির্বাচনের দিন নানা ধরণের অনিয়মের খবরে উদ্বেগের পাশাপাশি, নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করতে না পারায় তারা হতাশা ব্যক্ত করে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য বিবৃতি দেয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচন যে বিশ্বাসযোগ্য, মুক্ত ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার ওপর নির্ভর করে, বাংলাদেশে তার কোনো মানদণ্ড মানা হয়নি। নির্বাচনে সব দল অংশ না নেয়ায় বাংলাদেশের মানুষের ভোট দেয়ার জন্য বিকল্প ছিল না বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করে।

একই ধারাবাহিকতায় কানাডা হতাশা ব্যক্ত করে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়া গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মূলনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একটি কার্যকর বিরোধী দল, স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শক্তিশালী এবং সুস্থ গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানায় তারা। অন্যদিকে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে অস্ট্রেলিয়া বলে, এটি দুঃখজনক যে, নির্বাচন এমন একটি পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দলসমূহ অর্থবহ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশে অংশ নিতে পারেনি। তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানায়, যেন তা মানবাধিকার সুরক্ষা, আইনের শাসন এবং উন্নয়নের প্রচারকে সমর্থন করে।

পাশাপাশি, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দেয় সাতটি খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক সংগঠন। নির্বাচন যথাযথ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়নি জানিয়ে রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলে, এমন বহু খবর ও তথ্য-প্রমাণ আছে, যেগুলো নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন ব্যাপক অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে। এর মধ্যে ভোটারদের চাপ প্রয়োগ এবং ভোটের ফলাফলে কারচুপির মতো বিষয়ও রয়েছে, যা গুরুতরভাবে গণতন্ত্রের মূল নীতিসমূহ ক্ষুন্ন করে।

বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়, বস্তুত, ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ায় একটি নতুন ও অর্থবহ নির্বাচন আয়োজন আজ বাংলাদেশের জনগণের গণদাবি। সেই সর্বজনীন লক্ষ্য অর্জনে, গণতন্ত্রের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে, যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে, জনগণের লুণ্ঠিত ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার তথা নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে, চলমান এই শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনে প্রেরণা জোগাচ্ছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের আকাক্সক্ষা অভিন্ন ও এক সূত্রে গাঁথা। সেই অভিন্ন লক্ষ্য হলো, একটি নির্বাচিত ও জবাবদিহিতামূলক সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রত্যাশা, সুতীব্র এই গণআকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে রাশিয়া, ভারত, চীন, বা অন্য কোনো রাষ্ট্র, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের গণবিরোধী অপশাসনকে অযাচিত সমর্থন করবে না।

বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যবসা, বাণিজ্য, জ্ঞান ও অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের ভিত্তিতে উল্লেখ করে বলা হয়, বিএনপি বিশ্বাস করে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনেই দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক সাফল্য নিহিত। তাই বিএনপি রাশিয়াকে আহ্বান করছে, বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, তথা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বাধীনতার সংকল্প ও মহান আত্মত্যাগের প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের জন্য।##


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল পালিত

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল পালিত

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

রঙচটা বাস চলছেই

রঙচটা বাস চলছেই