হজ ব্যবস্থাপনা-২০২৩ : সউদী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ ৫

মুযদালিফা হতে জামারায় নিদারুণ হয়রানি

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

০৯ আগস্ট ২০২৩, ১১:১০ পিএম | আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম

ঠিক হল, একটু সুবিধা চাওয়া লোকদের জন্য স্পেশাল গাড়ী আসবে। বলা হল, মাগরিবের নামাযের পর থেকে প্রত্যেককে সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হবে। মুয়াল্লিমের সাধারণ গাড়ী যথারীতি এসে হাজীদের নিয়ে গেল। মিনা থেকে ফোন এল আমরা পৌঁছে গেছি। কিন্তু স্পেশাল গাড়ীর খবর নাই। মুনাযযিমদের দৌড়ঝাঁপ কে দেখে। অপেক্ষার পর অপেক্ষা। এ সময় কাফেলার মুখরা লোকেরা বাংলাদেশি মুনাযযিম বা হজ এজেন্সীর মালিকদের ব্যাপারে কী কী ভাষা ব্যবহার করতে পারে সহজে অনুমেয়।

আমি শামিল হয়েছিলাম ৭৩ নং মুয়াল্লিমের অধীন একটি কাফেলায়। সেখানে অনেক আগে থেকে ভাড়া করা স্পেশাল গাড়িটি দেরিতে হলেও আসল। মধ্যরাতে আমাদের পৌঁছে দিল মীনায় তাঁবুতে। মেপে দেখলাম, ২০ ইঞ্চি প্রস্থ, ৬ ফুট লম্বা এক চিলতে করে ফোম প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ। সাথে ফোমের বালিশও দেয়া আছে। তাঁবু ব্যবস্থাপনার কথা সময় হলে আলাদাভাবে বলতে হবে।

পরের রাতে অর্থাৎ ৮ যিলহজ দিবাগত রাতে ‘স্পেশাল’ এসে আমাদের নিয়ে গেল আরাফাতের একই রকম তাঁবুতে। সেখানে থাকতে হবে পরের দিন ৯ যিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। এটিই মূল হজ। খাবার ও পানির এন্তেজাম সরাসরি মুয়াল্লিমের দফতর মকতব হতে হচ্ছে। ৯ যিলহজ সূর্যাস্তের পর মুযদালিফার উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। যত দেরিই হোক মুযদালিফায় পৌঁছেই মাগরিব ও ইশা নামায একসঙ্গে আদায় করতে হবে। মুয়াল্লিমের গাড়ীগুলো একের পর এক হাজীদের নিয়ে ছুটতে লাগল মুযদালিফার উদ্দেশ্যে। আমি ভিআইপিদের সঙ্গে অপেক্ষায় রইলাম স্পেশালের আশায়। রাত যত গভীর হচ্ছে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কারণ মুযদালিফায় রাত কাটাতে হবে। ফজরের নামায পড়ে মিনার উদ্দেশ্যে মুযদালিফা ত্যাগ করতে হবে। এখন যদি মুযদালিফায় অবস্থান করার সময় আরফাতে থাকতেই ফুরিয়ে যায় হজের কী হবে।

রাত আড়াইটা নাগাদ স্পেশালের দয়া হল। তিনি এলেন। আমাদের হালকা বিছানাপত্র তুলে নিলেন। অনেকটা ফাঁকা রাস্তায় মুযদালিফায় পৌঁছাতে দেরি হল না। মাগরিব-ইশা পড়ে যৎসামান্য খাবার মুখে দিয়ে পাথরকণা সংগ্রহ করলাম তিনদিন তিন শয়তানকে মারার জন্যে। যথানিয়মে বিশ্রাম না নিতেই ফজরের সময় হয়ে গেল। নামায শেষে সবাই প্রস্তুত। মুনাযযিম সামান্য ব্রিফিং দিলেন। বললেন, স্পেশাল গাড়ীটি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আসতে নাকি দেরি হবে। আপনারা বিছানাপত্রগুলো এক জায়গায় জড়ো করে রাখেন দেরিতে হলেও গাড়ি এসে তুলে নেবে। মক্কায় আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দেবে। এখানে আমার লোক পাহারায় থাকবে। তিনি গাড়ী নিয়ে নৈরাজ্যের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, এই অভিযোগ আল্লাহর কাছে ছাড়া দায়ের করার জায়গা আর কোথাও নেই। কারণ হজের পর যে যার জায়গায় চলে যাবে। অভিযোগ শোনার কেউ থাকবে না।

সিদ্ধান্ত হল, পায়ে হেঁটে জামারায় যেতে হবে। দূরত্ব কম করে হলেও ৫ কিলোমিটার। আগের দিন ও রাতের ক্লান্তি নিয়ে এই সংবাদটিতে যারা আঁতকে উঠল আমি তাদের একজন। কারণ আমার সঙ্গে একজন দুর্বল হাজী আছেন, যার জন্য হুইল চেয়ার সাথে রেখেছি। মুনাযযিম পরামর্শ দিলেন, মালপত্রের সঙ্গে তাকে মক্কায় নিয়ে যাওয়া হবে। আপনি চলেন তার হয়ে পাথর নিক্ষেপ করবেন। দোটানার মধ্যে পড়ে গেলাম। হোটেলে রেখে আসতে হলেও গাড়ীর দরকার। সেখান থেকে জামারার দূরত্ব নাকি মুযদালিফা থেকে দূরত্বের প্রায় সমান। আল্লাহই পথ দেখিয়েছেন। তাকে উন্মুক্ত মাঠে রেখে আসলে মক্কায় হয়ত লাশটাই যেত। কারণ, সেই মালপত্র গেছে তিনদিন পর।

হুইল চেয়ার ঠেলে ছুটলাম কাফেলার সঙ্গে। সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। কুরআন মজীদে আছে, (সূরা আরাফ :৫০) দোযখীরা বেহেশতিদের বলবে, তোমরা আমাদের দিকে একটু পানির ছিটা দাও...। এই পানির ছিটায় শান্তির কতখানি পরশ আছে তা আঁচ করার জন্য মুযদালিফা থেকে জামারার উদ্দেশ্যে হাঁটার অভিজ্ঞতা কাজ দিতে পারে। পূর্বাকাশে সূর্য উঁকি দেয়ার সময় সউদী নিরাপত্তা রক্ষীরা চোখে মুখে পেছনে গর্দানে পানির ছিটা দিচ্ছিল পিচকারি দিয়ে। মনে হচ্ছিল আরামের সুশীতল পরশ। উঁচুনিচু মসৃণ পথ ঠেলে জামারার কাছে গিয়ে দেখি দুর্বল হাজী পুরোদস্তুর সবল। নিজ হাতে ৭টি কঙ্কর ছুঁড়ে মারলেন। ততক্ষণে মূল কাফেলা হারিয়ে আমরা পরিবারের চারজন বিচ্ছিন্ন ও একেলা হয়ে গেলাম। দেশীয় পরিচ্ছনতাকর্মীদের পরামর্শ নিলাম। হেঁটে যেতে ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগবে। টেক্সিতে গেলে পুলিশের বাধার কথা বলে কোথায় নামিয়ে দেবে ঠিক নেই। এই পথ আগে পায়ে হেঁটে গেছি। কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন। একজন টেক্সিওয়ালা দয়া করে কথা বলতে রাজি হল। জনপ্রতি ১৫০ রিয়াল দিতে হবে। চার জনে মোট ১৮ হাজার টাকা। সাহস করতে পারছিলাম না। আরেকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পরামর্শ চাইলাম। বলল, ৫ মিনিট হেঁটে এগিয়ে যান। ওখানে বাস পাবেন সম্পূর্ণ ফ্রি, সরকারি। সরাসরি হারামের কাছে নামিয়ে দেবে।

আল্লাহর শোকর মক্কায় পৌঁছে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর তাওয়াফ ও সায়ী শেষ করতে রাত হয়ে গেল। রাতেই মিনায় গিয়ে রাত্রী যাপন হানাফী মাযহাব অনুযায়ী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। কিন্তু মুয়াল্লিমের বা স্পেশাল গাড়ীর অভাবে রাতে মিনায় যাওয়া সম্ভব হল না।

মাঝখানে কুরবানীর কথা তো বলিনি। আগে একবার নিজ হাতে কুরবানী করতে গিয়ে ভীষণ অবস্থার সম্মুুখীন হয়েছিলাম। সেই ভয়ে সউদী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে চাইলাম। পরে মুনাযযিমদের মনোনীত অদৃশ্য লোকদের ওপর ছেড়ে দিলাম এতবড় একটি ইবাদতের দায়িত্ব।

পরদিন মুনাযযিম একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করলেন। আমরা জামারায় তিন শয়তানকে পাথর মেরে মিনায় চলে গেলাম। রাত যাপন করে পরদিন আবারো তিন শয়তানকে পাথর মারার সুযোগ হল। ফিরে এলাম মক্কায়।

মিনা, মুযদালিফা, আরাফাতে যানবাহন সরবরাহে এই প্রতারণা এক দুইজন নয়, অধিকাংশ মুয়াল্লিমই করে। প্রশ্ন হল, হাজী সাহেবান কি মুয়াল্লিমদের এই স্বেচ্ছাচারিতা প্রতি বছর মেনে নেবেন। এর কি কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিকার অবশ্যই আছে। প্রথমত মুয়াল্লিমদের এ প্রতারণার চিত্র সউদী কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে হবে। যাতে সরকার পরিবহন মালিকদের মুযদালিফা থেকে জামারা ও হারামে হাজীদের পরিবহন সেবা প্রদান করতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত মিনা মুযদালিফা আরাফাতকে মেট্রো সার্ভিসের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এখন যে ট্রেন আছে তা তো সোনার হরিণ। মোস্তফা কামাল ভাই বললেন, জাপানে চলন্ত ট্রেন থেকে নামার জন্য স্কেলেটরের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এখানেও তা অনুসরণ করা যায়।ঢ়


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সম্প্রীতির জন্য রাখাইন রাজ্যে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অপরিহার্য: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নাম বদলে হলো ‘যমুনা রেলসেতু’
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পঙ্গু করে ফেলছে : শিক্ষা উপদেষ্টা
উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুতে সোমবার রাষ্ট্রীয় শোক
আরও

আরও পড়ুন

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ১

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত- ১

কামালপুর সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে মরণফাঁদ চরম  দুর্ভোগে পথচারীরা

কামালপুর সড়কের ব্রিজ ভেঙ্গে মরণফাঁদ চরম  দুর্ভোগে পথচারীরা

মেয়েদের ক্রিকেটে যুক্ত হলো যেসব সুযোগ-সুবিধা

মেয়েদের ক্রিকেটে যুক্ত হলো যেসব সুযোগ-সুবিধা

বাড়ছে শীতের প্রকোপ, সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়

বাড়ছে শীতের প্রকোপ, সাধারণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়

জকিগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে যুবলীগ নেতা গ্রেফতার

জকিগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলার অভিযোগে যুবলীগ নেতা গ্রেফতার

খালিশপুরে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন

খালিশপুরে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন

যুব এশিয়া কাপজয়ীরা পাচ্ছেন আর্থিক পুরস্কার

যুব এশিয়া কাপজয়ীরা পাচ্ছেন আর্থিক পুরস্কার

আদমদিঘীতে বিএনপি কার্যালয় উদ্বোধন

আদমদিঘীতে বিএনপি কার্যালয় উদ্বোধন

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

গোপালগঞ্জে বিএনপির বহিস্কৃত ও আ. লীগ কর্মীদের নিয়ে বিএনপির ২ জেলা কার্যালয়

গোপালগঞ্জে বিএনপির বহিস্কৃত ও আ. লীগ কর্মীদের নিয়ে বিএনপির ২ জেলা কার্যালয়

কালীগঞ্জে ভাইরাল চিতাবাঘ হত্যার ঘটনায় দুইজন গ্রেপ্তার বন বিভাগ ও প্রশাসনে তোলপাড়

কালীগঞ্জে ভাইরাল চিতাবাঘ হত্যার ঘটনায় দুইজন গ্রেপ্তার বন বিভাগ ও প্রশাসনে তোলপাড়

আশুলিয়ায় স্ট্যান্ডে চাঁদার দাবীতে হামলার অভিযোগ; আহত-১৩

আশুলিয়ায় স্ট্যান্ডে চাঁদার দাবীতে হামলার অভিযোগ; আহত-১৩

সউদী আরবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দুই নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

সউদী আরবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য দুই নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

শুটিংয়ে গিয়ে আপত্তিকর আচরণ করায় নির্মাতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা

শুটিংয়ে গিয়ে আপত্তিকর আচরণ করায় নির্মাতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা

সালাম মুর্শেদীর ৪ মামলার জামিন নামঞ্জুর

সালাম মুর্শেদীর ৪ মামলার জামিন নামঞ্জুর

সম্প্রীতির জন্য রাখাইন রাজ্যে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অপরিহার্য: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সম্প্রীতির জন্য রাখাইন রাজ্যে টেকসই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অপরিহার্য: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

গবিসাসের নতুন সভাপতি সানজিদা, সম্পাদক ইভা

গবিসাসের নতুন সভাপতি সানজিদা, সম্পাদক ইভা

গাজীপুরের শ্রীপুরে কারখানার গুদামে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

গাজীপুরের শ্রীপুরে কারখানার গুদামে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৭ ইউনিট

খুবির উৎকর্ষ সাধনে পাশে থাকবে ইরান

খুবির উৎকর্ষ সাধনে পাশে থাকবে ইরান

বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নাম বদলে হলো ‘যমুনা রেলসেতু’

বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নাম বদলে হলো ‘যমুনা রেলসেতু’