উস্তাযুল হুফ্ফাজ হাফেজ হাফিজুল্লাহ (রহ.)-এর বর্ণাঢ্য জীবন
১৫ মার্চ ২০২৩, ০৮:০৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৩১ এএম
লন্ডনের অফার প্রত্যাখ্যান: নরসিংদীর বাজার মসজিদে প্রতি রমজানে খতমে তারাবী পড়াতেন। ১৯৭৭/১৯৭৮ সালে লন্ডন থেকে একটি তবলিগের জামাত ওই মসজিদে অবস্থান করে। জামাতের সাথিরা তিন দিন হুজুরের পিছনে তারাবী নামাজ পড়ে মুগ্ধ হন। দোভাষীর মাধ্যমে জানতে পারলেন তিনি একটি মাদরাসার পরিচালক ও ধার্মিক পরিবারে সন্তান। তারা প্রস্তাব করলেন যদি হুজুর আমাদের দেশে যেতে সম্মতি দেন, তাহলে আমরা হুজুরকে স্বপরিবারে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব এবং সেখানে একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে দিব। যেন তিনি দেশে পিতা-মাতা ও ভাই-বোনদের নিয়ে স্বাচ্ছন্দে চলতে পারেন। এ প্রস্তাব শুনে হুজুর সরাসরি জানিয়ে দিলেনÑ ‘উনারা যদি আমার দক্ষিণ মির্জানগর মাদরাসার সমস্ত ছাত্রসহ লন্ডনে নিতে পারে তাহলে আমি ওই দেশে যেতে রাজি আছি।’ দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ উপার্জনের প্রতি তিনি কত নির্লোভ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা এর প্রতিদান আখেরাতে দিবেন। কোরআনের একনিষ্ঠ খেদমতের কারণে দুনিয়াতেই দিয়েছেন অনেক সম্মান ও যশ-খ্যাতি।
কোরআনের খেদমতে নিবেদিত প্রাণ : তিনি ছিলেন একজন নিভৃতচারী কোরআনের সাধক। সর্বদা তাঁর যবানে জারি থাকত কোরআনের শ্রুতিমধুর তেলাওয়াত। সাদাসিধে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। কথা বলতেন স্মিত হেসে। ছাত্রদেরকে নিজ সন্তানের মতো আদর-সোহাগ, ¯েœহ-ভালোবাসায় আগলে রাখতেন। দরদমাখা কণ্ঠে আদর্শ জীবন গড়তে মূল্যবান নছিহত করতেন। ছাত্রদের হৃদয়ের কিশলয়ে ঈমানী হাওয়া বইত। জীবনের বাঁকে বাঁকে চলার পথে সেই নসিহা প্রেরণা যোগাই। তিনি ছিলেন চিন্তা-চেতনায়, চরিত্র-সুষমায় আকাবিরদের জীবন্ত নমুনা। স্বভাব-চরিত্র যেন শিশির¯œাত সাদা গোলাপের পাপড়ি! পৌড়ত্বেও চেহারায় গাম্ভীর্যতার ছাপ সুস্পষ্ট ছিল। তার জ্যোতির্ময় চেহারা থেকে অদ্ভূত এক নূরাণী আভা ঠিকরে পড়ত। ছাত্রদের প্রতি মায়া-মমতা সুশাসন ও সুনিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত যতœশীল। আদর্শ ছাত্র গড়ার কলা-কৌশল খুব ভালো বুঝতেন। এমন উস্তাদ এ যুগে বিরল।
তাঁর জীবনের বড় একটা মিশন ছিল কিভাবে কোরআনের খেদমতকে ব্যাপক করা যায়।পাড়ায় পাড়ায় কোরআন শিখার জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর কাছে হাফেজ হয়েছেন লক্ষাধিক হাফেজে কোরআন। যারা আজ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত সুনামের সাথে কোরআনের খেদমত করে যাচ্ছেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র রাজধানী ঢাকার প্রসিদ্ধ মাদরাসাগুলিতে হিফজুল কোরআন বিভাগে খেদমতে রত আছেন। তাছাড়া তারই হাতে গড়া ছাত্ররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেরাআনের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে মসজিদ-মাদরাসায় কোরআনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। উজ্জ্বল করেছেন দেশের মুখ। তিনি ছিলেন হাজারো হাফেজ-কারীদের ইলমি রাহবার। তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মাঝে নিজ সন্তানকে কোরআনের হাফেজ বানানোর প্রতিÑ অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৬ সালে কোরআনের খেদমতে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহসিক দস্তারবন্দী সম্মেলন। পরম ¯েœহের হাজার হাজার ছাত্রদের মাথয় পাগড়ী পরিয়ে দেন। হাফেজ হাফিজুল্লাহ (রহ.) কোরআনের যে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে থাকবে। এর ‘সদকায়ে যারিয়ার সওয়াব কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর কবরে পৌঁছতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
শারীরিক অসুস্থতা : মাদরাসার উন্নতি দিন দিন এগিয়ে চলছে। এরই মাধ্যে ১৯৯৯ সালে নভেম্বর মাসে এক সভায় বক্তৃতারত অবস্থায় ব্রেনস্ট্রোক করেন। ঢাকা শরমিতা হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। ডাক্তারদের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ভক্তদের মন রক্ষা করতে বিভিন্ন দ্বীনি মাহফিলে আলোচনা করতেন। বছর দু’য়েক অতিবাহিত হওয়ার পর একবার খোদাদিলা গ্রামে বয়ান করা অবস্থায় পুনরায় স্ট্রোক করেন। ওই সময়ও শরমিতা হাসপাতালে ২৫ দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকার পর জ্ঞান ফিরে আসে। ৭৬ দিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়েছেন কিন্তু বামপার্শ^ অকেজো হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনার পর বিশ্রামে থাকার কথা। কিন্তু তিনি শুধু বলতেন আমাকে মাদরাসায় নিয়ে যাও, না হয় আমি বাঁচব না। সর্বক্ষণ চিন্তা-ফিকির শুধু একটাই মাদরাসা। ২০০২ সালে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ২২ বছল হুইল চেয়ারে বসে চলাফেরা করতেন। এভাবে শত কষ্ট, ত্যাগ আর মুজাহাদার মাধ্যমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি। মৃত্যুর বছর দু’য়েক পূর্বে তিনি বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বিছানায় সহ্যাসায়ী ছিলেন। দেহ বিছানায় থাকলেও মনটা সবসময় পড়ে থাকত মাদরাসায়। এত অসুস্থতার মাঝেও বিছানায় শুয়ে থেকে মাদরাসার খোঁজ-খবর রাখতেন। তিনি যখন অনুভব করলেন জীবন হয়ত বেশিদিন সঙ্গ দিবে না এই জন্য তিনি জীবদ্দশাতেই বড় সাহেবযাদা কাতারের র্ধর্ম মন্ত্রলয়ের ইমাম-খতিব ও কাতার জাতীয় রেডিও চ্যানেলের কারী হাফেজ মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ বিন হাফিজ-এর উপর মুহতামীমের দায়িত্ব অপর্ণন করেন।
মৃত্যু: কালজয়ী কোরআনের এই সাধক ১৪৪৩ হিজরী মুতাবিক ২০২২ সালের ৯ জুন শনিবার রাতে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারের যাত্রী হয়ে গেলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়ে ছিল ৭৮ বছর। রেখে গেছেন এক স্ত্রী, তিন ছেলে, চার কন্যা। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত ও মুহিব্বীনদের রেখে পাড়ি জামালেন জান্নাতের পথে। মৃত্যুর সংবাদ মুহুর্তেই ছড়িয়ে পরে সারাদেশে। একনজর দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকে হাজার হাজার হাফেজ, আলেম, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সর্বস্তরের ভক্তবৃন্দ। এমন একজন নিভৃতচারী কোরআন প্রেমিক অভিভাবক হারিয়ে সেদিন নরসিংদীবাসী হয়ে ছিল শোকাহত ও অশ্রুসিক্ত। জীবনের দীর্ঘ ৬০ বছর তিনি লাগাতার কোরআনের খেদমতে ব্রত ছিলেন। কোরআনের তরে পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন। দুনিয়ার জীবনে এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী হতে পারে!
জানাযা ও দাফন : উস্তাযুল হুফ্ফাজের প্রতি ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের কী পরিমাণ ভালোবাসা অন্তরে লালন করতÑ এর দৃষ্টান্ত তাঁর জানাযার নামাযে উপস্থিতির সংখ্যা। দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ উপস্থিত হয়েছেন। ঘটনাক্রমে সেদিনটি ছিল নয় জিলহজ¦ অধিকাংশ মানুষÑ‘ইয়াউমে আরাফা’র রোজা রেখে ছিলেন। পরের দিন ‘ঈদুল আযহা’ দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষগুলো আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবেÑ এ দিক বিবেচনা করে অতিরিক্ত কাউকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। উপস্থিত ছিলেন অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান (পীর সাহেব দেওনা) বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মাহফুযুল হক। দারুল আরকাম মাদরাসার মোহতামিম মাওলানা সাজেদুর রহমান। জামেয়া কাসেমিয়া গাবতুলি মাদরাসার অধ্যক্ষ কামালুদ্দীন জাফরীসহ আরও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম। জানাযা পূর্ব আলোচনায় মাওলানা মাহফুযুল হক বলেন, ‘শাইখুল হাদিস (আল্লামা আযিযুল হক) রহ. এর সাথে হুজুরের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আছরের নামাজের পর মাদরাসার পশ্চিম দিকে বিশাল চকের মধ্যে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। পরামর্শক্রমে জানাযা পড়ানোর দায়িত্ব অর্পিত হয় বড় সাহেবযাদা হাফেজ কারী মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ বিন হাফিজÑএর উপর। মত্যুর সংবাদ পেয়ে কাতার থেকে রাতেই ফ্লাইটে রওনা হন। আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে সকাল ৯.৩০মি. বাংলাদেশ বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন। তিনি জানাযার নামায পড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে প্রথম তাকিবর দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একেতো পিতার মৃত্যুশোক, দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি এবং প্রেসারও কমে গেছে, সব মিলিয়ে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেননি। সাথে সাথে জানাযার নিয়ত ছেড়ে দিতে মাইকে এলান করা হয়। পরক্ষণে মরহুমের বিয়াই, বড় সাহেবযাদার শ^শুর হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব জানাযার নামজ পড়ান। জানাযা শেষে মাদরাসার পূর্বপাশে হুজুরের জীবদ্দশায় ক্রয়কৃত জমিতে লাশ দাফন করা হয়। আল্লাহ যেন কোরআনের এই সাচ্চা খাদেমকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচ্চ মাকাম দান করেন এবং কবরটাকে স্বীয় রহমত বর্ষণে শীতল করে রাখেন।
লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল : মদিনাতুল উলুম তা’লিমুল কোরআন মাদরাসা।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মাগুরার শালিখায় অজ্ঞাত বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন