কুরআন একটি স্বচ্ছ আয়না
২২ মার্চ ২০২৩, ০৮:৩৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪২ এএম
যে আয়নায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজ নিজ চেহারা দেখে নিজেদের মর্যাদা ও অবস্থান নির্ণয় করতে পারে) সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবী (রাহ.) বলেন, আমি আমার এক প্রিয়বন্ধুর মুখে সূরা আম্বিয়া- এর তিলাওয়াত শুনছিলান। এ সূরার একটি আয়াত, যা গভীর চিন্তার দাবি রাখে, নিজের মধ্যে গভীর শিক্ষার উপকরণ ধারন করে, আমার চিন্তায় অসংখ্য অর্থের দুয়ার খুলে দিল। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেনÑ ‘আমি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছি এমন এক কিতাব, যার ভেতরে তোমাদের আলোচনা রয়েছে। তোমরা কেন চিন্তা করো না?’ (সূরা আম্বিয়া : ১০)
এ আয়াত আমাদের বলে, কুরআন একটি পরিষ্কার, স্বচ্ছ, সত্য ও বিশ^স্ত আয়না। যে আয়নায় প্রত্যেক মানুষ নিজের চেহারা-সূরত দেখতে পারে। সমাজে নিজ অবস্থানও নির্ণয় করতে পারে। আল্লাহ পাকের নিকটও নিজ মর্যাদার ধারণা পেতে পারে। কুরআনে উত্তম ও আর্দশ মানুষের নমুনা যেমন আছে, তেমনি আছে অধম ও মন্দ লোকের নমুনাও। আল্লাহ উপরোক্ত আয়াতে বলেছেন- ‘এ কিতাবে তোমাদের আলোচনা আছে ’। তোমাদের অবস্থা ও বৈশিষ্ঠ্যাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতের এমন অর্থ অনেক আলেমই করেছেন। আমাদের পূর্বসূরী উলামায়ে কেরাম কুরআনকে একটি জীবন্ত সবক, জীবনঘনিষ্ঠ কিতাব মনে করতেন। তাদের দৃষ্টিতে কুরআন কোন ঐতিহাসিক ও প্রতœতও¦ীয় জিনিস নয়, যা কেবল অতীত ও প্রাচীনকালের লোকদের নিয়ে আলোচনা করে। জীবিত মানুষ সম্পর্কে যার কোন বক্তব্য নেই। এবং সদা পরিবর্তনশীল মনুষ্য যিন্দেগী নিয়ে এবং অগণিত অসংখ্য মানুষ যারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করছে তাদের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের পূর্বসূরী বুজুর্গগণ নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিজের ভেতরের মানুষটি সর্ম্পকে সম্যক ধারনা রাখতেন। প্রতিটি বিষয়ই তাদের সম্মুখে উজ্জ্বলরূপে উদ্ভাসিত হত। তাঁরা এ কুরআনের সাহায্যেই পথ চলতেন।
এই বিরল - বিষ্ময়কর কিতাবেই নিজেদেরকে খুঁজে বেড়াতেন। নিজ রুচি ও প্রকৃতির আসল রূপ এখানেই খুঁজতেন এবং খুব সহজেই এ কিতাবে নিজেকে আবিষ্কার করতেন। নিজেকে চিনে নিতেন।
কুরআনের আলোকে নিজেকে কল্যাণসিক্ত দেখতে পেলে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করতেন। নেতিবাচক কিছু দেখলে তাওবা ও ইস্তিগফার করে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করতেন।
হযরত আহনাফ বিন কায়েস (রাহ.)-এর ঘটনা:
এ আয়াতের তিলাওয়াত শুনে আমার হৃদয়পটে হযরত আহনাফ বিন কায়েস (রাহ.)-এর কাহিনী জেগে উঠলো। হযরত আহনাফ বিন কায়েস (রাহ.) বিখ্যাত তাবিঈনের অন্তর্ভূক্ত। সাইয়্যেদুনা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাযি.)-এর বিশিষ্ট শিষ্যদের অন্যতম। এতদসত্তে¡ ও যখন ক্রোধান্বিত হতেন, তখন তার আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বকীয়তার ঘুমন্ত সিংহ জেগে ওঠতো। আরবের লোকেরা বলতো ‘যখন আহনাফ ক্রোধান্বিত হয়, তখন এক লক্ষ তরবারীও ক্রোধান্বিত হয়’।
ঘটনাটি এই যে, একদিন হযরত আহনাফ বিন কায়েস (রাহ.) বসেছিলেন, এ সময় উপরোক্ত আয়াত এক ব্যক্তিকে তেলাওয়াত করতে শুনলেন। এ আয়াত শুনে তিনি চমকে উঠলেন। বললেন, আমার আলোচনা আছে ? আচ্ছা! কুরআনুল কারীম আনো, দেখি আমি তাতে নিজ আলোচনা খুঁজে পাই কি না ? দেখি তো আমি কাদের সঙ্গে। কাদের সাথে আমার সাদৃশ্য!... তিনি যখন কুরাআন খুললেন তখন নি¤েœাক্ত আয়াতটি তার নজরে পড়ল। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত এবং তারা সাহরীর সময় ইস্তিগফার করত। তাদের ধন-সম্পদে যাচক ও বঞ্চিতের (যথারীতি) হক থাকত।’ (সূরা যারিয়াত : ১৭-১৯)
অতঃপর এ আয়াতে দৃষ্টি পড়লো- ‘(রাতের বেলা) তাদের পাশর্^দেশ বিছানা থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা নিজ প্রতিপালককে ভয় ও আশার (মিশ্রিত অনুভূতির) সাথে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে।’(সূরা সাজদা : ১৬)
অতঃপর একদল লোকের আলোচনা তার চোখে পড়লো, যাদের পরিচয় এভাবে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন ‘সে দিন জান্নাতবাসীদের বাসস্থান হবে উৎকৃষ্ট এবং বিশ্রামস্থল হবে মনোরম।’ (সূরা ফুরকান : ২৪)
এরপর তিনি এমন লোকদের মুখোমুখি হলেন, যাদের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদের ভালবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩৪)
এরপর তার সামনে এমন কিছু মানুষের চিত্র এলো যাদের আলোচনা কুরআন এভাবে করেছেÑ ‘তারা নিজেদের উপর প্রাধাণ্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে। যারা স্বভাবের কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে, তারাই তো সফলকাম।’ (সূরা হাশর : ৯)
এরপর তাঁর সামনে এই আয়াত এলো : এবং যারা বড় বড় গোনাহ ও অশ্লীল কর্ম পরিহার করে এবং যখন তাদের ক্রোদ জাগে, তখন ক্ষমা প্রদর্শন করে। এবং যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দিয়েছে, নামায কায়েম করেছে এবং যাদের কাজকর্ম পারষ্পরিক পরামর্শক্রমে সম্পন্ন হয় এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকর্মে) ব্যয় করে।’ (সূরা আশশূরা : ৩৭-৩৮)
তিনি থেমে গেলেন এবং বললেন, হায় আল্লাহ! আমি তো এখানে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না। এরপর তিনি অন্যত্র নিজেকে খুঁজতে লাগলেন। তখন তিনি একদল লোকের আলোচনা দেখতে পেলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘তাদের অবস্থা তো ছিলো এই যে, তাদেরকে যখন বলা হত, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তখন তারা অহমিকা প্রদর্শন করত। এবং বলত, আমরা কি এমন যে, এক উম্মাদ কবির কারণে আপন উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব ?’ (সূরা আসসাফফাত ৩৫Ñ৩৬)
এরপর ঐ সকল লোকের আলোচনা দেখতে পেলেন যাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, ‘কোন জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে দাখিল করেছে ? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম না। আমরা মিসকিনদেরকে খাবার দিতাম না। আর যারা অহেতুক আলাপÑআলোচনায় মগ্ন হত, আমরাও তাদের সঙ্গে তাতে মগ্ন হতাম। এবং আমরা কর্মফল দিবসকে অবিশ^াস করতাম। পরিশেষে সেই নিশ্চিত বিষয় আমাদের সামনে এসেই গেল।’ (সূরা মুদ্দাসসির : ৪২Ñ৪৭)
তিনি এ আলোচনা পাঠ করা মাত্রই থেমে গেলেন এবং বললেন, আয় আল্লাহ! আমি তোমার নিকট এ সকল লোক থেকে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করছি।
এরপরও তিনি কুরআনুল কারীমের পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে যখন এ আয়াতে দৃষ্টি পড়লো, যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘‘অপর কিছু লোক এমন, যারা নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। তারা এক সৎকাজের সাথে অন্য অসৎকাজ মিলিয়ে ফেলেছে। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’
(সূরা তাওবা : ১০২)তখন তিনি বলে উঠলেন, ইয়া আল্লাহ! আমি তো এদেরই দলভুক্ত। আসুন আমরাও নিজেদেরকে খুঁজি,আসুন আমরাও আমাদের আলোচনা, ধীরস্থিরভাবে বিশ^স্ততার সাথে অনুসন্ধান করি। কুরআন যেহেতু সুসংবাদদাতা এবং ভীতি Ñ প্রদর্শনকারী নেককার ঈমানদারের আলোচনা যেমন এতে আছে, কাফের Ñমুশরেকের আলোচনাও আছে। কুরআন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয় আলোচনাই করেছে। সকলের বিবরণই এতে দেখা যায়।
মানবীয় বৈশিষ্ট্যের শাশ^ত নমুনা, মানবÑবৈশিষ্ট্যের এ শাশ^ত নমুনা কুরআনুল কারীমে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে বর্ণিত হয়েছে। কোথাও কোন স্বৈরাচারী শাসকের নামে, যেমন ফিরআউন। কোথাও কোন দুষ্ট মন্ত্রী বা নেতার নামে, যেমন হামান। আবার কোথাও অহংকারী ও কৃপণ পুঁজিপুতির নামে, যেমন কারুন। কোথাও আবার কোন অবাধ্য অত্যাচারী সম্প্রদায়রূপে, যেমন ‘আদ সম্প্রদায়’। আবার কোথাও কোন কারিগরিবিদ্যায় পারদর্শী জাতিরূপে, যেমন সামুদ সম্প্রদায়। এ সবই মানবÑবৈশিষ্ট্যের এ শাশ^ত নমুনা। যদিও এসকল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নির্ধারিত ভূখÐে নির্ধারিত সময়ে ছিলো কিন্তু কুরআন তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যখন উল্লেখ করেছে, তখন তারা সময় ও ভূখÐের সাথে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং এ সকল নমুনা সর্বযুগের সকল ভূখÐের মানুষের মানবীয় নানা দুর্বলতা ও অবনতির প্রতিনিধিত্ব করেছে। কুরআনুল কারীম এ সকল ব্যক্তি ও গোষ্ঠির পরিণতি নিয়েও আলোচনা করেছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছে যারাই এদের পদঙ্ক অনুসরণ করে চলবে এবং এদেরকে নিজের নেতা ও আদর্শ বানাবে, তাদের পরিণতিও এদের মতোই ভয়াবহ হবে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে কুরআনুল কারীমের এ স্বচ্ছ আয়নায় আতত্মদর্শন করে সংশোধিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাসচিব মদিনাতুল উলুম তা’লিমুল কুরআন মাদরাস। শ্রীরামপুর, রায়পুরা, নরসিংদী।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত
প্রাক বড়দিন পালন করলে গারো পাহাড় সীমান্তে খ্রীষ্টানরা
আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে জাতির জন্য কঠিন নির্বাচন
ভারত বিরোধী স্লোগানে উত্তাল খুলনা
রেকর্ডের মালা গেঁথে বাংলাদেশের সিরিজ জয়
মমতা ব্যানার্জির জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাবটি বাস্তবতা বিবর্জিত গালগল্প
গত সাড়ে ১৫ বছর এ জাতি জিম্মি দশায় ছিল- জামায়াত আমির ডা.শফিকুর রহমান
বেনাপোলের বিএনপির সহ-সভাপতি দ্বীন ইসলামকে হত্যা, সাবেক তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা
গ্যাস লাইন সংযোগ সহ ১০ দফা দাবিতে সিলেটের জৈন্তাপুরে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের সাথে মতবিনিময়
৬ দফার ভিত্তিতে মাসব্যাপী কর্মসূচি জাতীয় নাগরিক কমিটির
সব ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে হাইকোর্টে রিট
উইন্ডিজ শিবিরে নাহিদের জোড়া আঘাত
আন্তবিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন জবির ফিন্যান্স বিভাগ
আগরতলা হাইকমিশনে ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ
বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ ১২ আলেমের বিরুদ্ধে সাদপন্থীদের মামলা
নেতাদের ভুল শুধরে নিয়ে জনগণের পাশে থাকার আহবান তারেক রহমানের
‘বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করতে জাতিসংঘে সেনাবাহিনীর আহবান করেছে মমতা ব্যানার্জি’
‘উগ্রহিন্দুদের আট দাবিতে বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ বানানোর পরিকল্পনা চলছে’
ফুটবল মাঠে সংঘর্ষ, ৫৬ জন নিহত
বিগ ব্যাশে খেলবেন না রিশাদ