ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

ভ্রমণে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা

Daily Inqilab মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

২০ জুন ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২০ জুন ২০২৪, ১২:০৫ এএম

মহান রাব্বুল আলামিন আশরাফুল মাখলুকাতের জন্য সমগ্র পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের বিচরণেরও সুযোগ করে দিয়েছেন। সর্বপ্রথম এর প্রতিফলন ঘটেছে আদি পিতা ও আদি মাতার জীবনে। তারা তিনশত বছর পৃথিবীর সর্বস্থানে একে অপরকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। অবশেষে তাদের পরস্পর তাদের সাক্ষাত ঘটেছে আরাফার ময়দানে। আল্লাহ তায়ালা দুজনের পরিচয় বা মিলন ঘটালেন বহুদিনের ভ্রমণ বা সফরের পর। এতে বুঝা গেলো যে, মানুষকে পারস্পরিক পরিচিতি ও প্রয়োজন মেটাতে এভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন করতে হবে। আদি মাতা-পিতার মিলন স্থলের নামকরণই করা হল ‹আরাফা› বা পরিচিতি স্থান হিসেবে। সে থেকে আরম্ভ করে পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব পর্যন্ত এ ময়দানে ঘটতে থাকবে লক্ষ কোটি মানুষের মিলন। মানুষ ছুটে আসবে পৃথিবী বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।

মানুষ কেনো সফরে যায় : এ প্রশ্নের জবাব খুবই সহজ। মানুষের হাজারও কাজ। হাজারও সমস্যার সমাধানে তারা ছুটে যায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। প্রধানত মানুষ রিজিকের অন্বেষণে ঘুরে বেড়ায়। দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে এবং ধর্মীয় ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমনাগমন করে থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‹হে মানব ম-লী! তোমরা পৃথিবীর হালাল খাদ্যদ্রব্য থেকে ভক্ষণ করো, আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।› (সুরা বাকারা: ১৬৮)। আল্লাহ তায়ালা বৈধ, সিদ্ধ বা হালাল খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে ‹ফিল আরদি› শব্দ ব্যবহার করে বুঝিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবী তোমাদের রোজগার বা খাবারের স্থান। এখান থেকে তোমাকে শ্রম দিয়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে শয়তান থেকে সতর্ক থাকতেও সাবধান করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সকল সুবিধা মহান রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন। এ জন্য প্রথম মানব-মানবীকে দিয়েই পৃথিবীর আবাদ ও সফরের অভিজ্ঞতা জগতবাসীর সম্মুখে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন। হজরত সুলাইমান (আ.) কে আল্লাহ তায়ালা সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি দ্রুতগামী বাহনের সাহায্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ভ্রমণ করতেন। হজরত নুহ (আ.)- এর জীবনে কিস্তির সাহায্যে পৃথিবীর জলভাগে সফরের শিক্ষা রয়েছে। এভাবে পূর্ববর্তী নবী-রাসুলের জীবনে ভ্রমণ, সফর ও হিজরতের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা আমাদের সম্মুখে। আমাদের প্রিয়নবী (সা.) যেমনিভাবে একদেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করেছেন, তেমনি পৃথিবী ছেড়ে গিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে মহাপরিভ্রমণ করে মহান রাব্বুল আলামিনের দীদার বা মোলাকাত লাভে ধন্য হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ সফরের দ্বিতীয় কোনো নজীর নেই। কারণ তিনি তো মহাবিশ্বের মহান নেতা, সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তার সঙ্গে কারও কোনো তুলনা নেই এখানে। হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‹হালাল রোজগার করা অন্যান্য ফরজের মতোই একটি ফরজ। নবী-রাসুলগণ নিজ নিজ হস্তে রোজগার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। হাদিসে এ ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনা এসেছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‹হজরত আদম (আ.) ছিলেন কৃষিজীবী, হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন কর্মকার, হজরত শোইয়াব (আ.) গৃহে কর্মরত ছিলেন, হজরত ইদরিস (আ.) সেলাই কাজ করতেন। এমনিভাবে সকল নবী-রাসুল নিজ নিজ হস্তে কাজ করতেন। আমাদের প্রিয়নবী (সা.)- এর ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশুনা করতেন।

নিরাপদ সফর বা ভ্রমণের শিক্ষা : সমগ্র পৃথিবীকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য আবাদযোগ্য করে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণীর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখি তিনি বলেছেন, ‹সমগ্র পৃথিবীর বক্ষে বিচরণের সুবিধার্থে তিনি পৃথিবীকে তোমাদের জন্য সুগম করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা বিচরণ করো ও তার দেয়া রিজিক আহার করো।› (সুরা মুলক: ১৫)। এখানে দুইটি বিষয় লক্ষণীয়, প্রথমত পৃথিবীকে ভ্রমণোপযোগী করে দেয়া। দ্বিতীয়ত সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণ করে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত তথা রিজিক অন্বেষণ করা। ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের বিচিত্র দ্রব্যাদির উৎপাদন হয়। স্থলে, জলে ও মাটির গর্ভে এবং পাহাড়ে বহু মূল্যবান বস্তু রয়েছে, সেগুলো আহরণ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাজারজাত করার ইঙ্গিত আয়াতে রয়েছে। যেমন: সুরা জুমআর ১০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‹যখন তোমরা সালাত শেষ কর, তখন জমীনে ছড়িয়ে পড়ো এবং নিজ কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর দেয়া রিজিক অন্বেষন করো।› এখানে হিজরতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। পৃথিবীর পুরোটাই মুসলমানদের কর্মস্থল। সুতরাং কোথাও অসুবিধে দেখা দিকে অন্যত্র গিয়ে তারা আল্লাহর দাসত্ব করবে অর্থাৎ আল্লাহর বিধান মতে চলবে ও চলার ব্যবস্থা করবে।

মহান রাব্বুল আলামিন জ্ঞান অর্জনের জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে সফরের প্রতি গুরুত্বারোপ করে ইরশাদ করেছেন, ‹তারা এই উদ্দেশ্যে কেনো দেশ ভ্রমণ করেনি যে, তারা জ্ঞান সমৃদ্ধ হৃদয় ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে।› (সুরা হজ: ৪৬)। অর্থাৎ জ্ঞান সমৃদ্ধ হৃদয় ও শ্রবণশক্তির অধিকারী হওয়ার জন্য বিশ্বভ্রমণ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। উপরোল্লিখিত শিক্ষাসমূহ রাসুল (সা.)- এর ওপর ওহী নাজিলের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা জগতবাসিকে জানিয়ে দিয়েছেন। রাসুল (সা.) আল্লাহর দীনের প্রচার ও প্রসারের জন্য সর্বপ্রথম মক্কাবাসীদের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এক যুগ সময় অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরও খুব কম সংখ্যক লোক (মাত্র ৪০ জন) সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে ইসলামে দীক্ষিত হয়। বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে চরম শুক্রভাবাপ্নন সংখ্যাগরিষ্ঠ মক্কাবাসী, যারা প্রিয় নবীজিত অস্তিত্বকেই মেনে নিতে পারেনি। তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেললে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশে তিমি অলৌকিকভাবে মদিনায় হিজরত করেন। মহানবী (সা.)- এর মদিনায় হিজরত পৃথিবীর মানুষের কাছে এক ঐতিহাসিক শিক্ষারূপে কেয়ামত পর্যন্ত জাগ্রত হয়ে থাকবে। কুরআন বাণীর সত্যতা রাসুল (সা.)- এর হিজরতের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। মাহান রাব্বুল আলামিন একই কথা বলেছেন, কোনো স্থানে যদি আল্লাহর দাসত্ব করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমার পৃথিবী অনেক বিস্তৃত, প্রয়োজনে সেখানে গিয়ে আল্লাহর দাসত্ব কায়েম করো। মদিনার জীবনে রাসুল (সা.) লক্ষাধিক একনিষ্ঠ অনুসারী তৈরি করেছিলেন। যাদের তুলনা পৃথিবীতে আর কারও সঙ্গে হয় না। তাদেরকে তিনি সমগ্র পৃথিবীতে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিলেন এবং বললেন, ‹তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি কথা জানলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।› সাহাবায়ে কেরাম এ দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তারা পৃথিবীর সকল প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। দীন প্রচারের জন্য তাদের সফর, ভ্রমণ বা হিজরত অব্যাহত ছিলো।

সফরে গমনাগমনের ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)- এর উপদেশ : রাসুল (সা.) সাধারণত বৃহস্পতিবার দিন ছাড়া অন্য দিনে সফরে যেতেন না। এ ছাড়া তিনি দিনের প্রথমাংশে সফরে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ দিতেন। তিনি উম্মতকে দিনের প্রথমাংশে বরকত দান করার জন্য দোয়া করতেন। ছোট কিংবা বড় কোনো সেনাদল কোথাও পাঠালে তিনি দিনের প্রথমভাগে পাঠাতেন। প্রিয়নবী (সা.) সফরের ক্ষেত্রে উত্তম সঙ্গী নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি সফরে সঙ্গী-সাথীর সংখ্যা সম্পর্কে বলেছেন যে, একজন কিংবা দুজন সঙ্গীর চেয়ে তিনজন সঙ্গী অধিক উত্তম। তিনজনের সফরকে কাফেলা বলা হয়। (চলবে)

লেখক: প্রিন্সিপাল, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক মাদরাসা ঢাকা-১২০৪


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা