ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা
০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০৩ এএম
আল্লাহর বাণী: প্রত্যেকের জন্য তাদের কাজ অনুসারে মর্যাদার স্তর। তাদের কাজের প্রতিফল তাদের দিয়ে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না। (সূরা: আহকাফ-১৯)
১৮৮৬ সালের ১মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজ ৮ ঘন্টা বিশ্রাম ৮ ঘন্টা বিনোদনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমেছিল। অথচ পুলিশি আক্রমণে সেদিন হে-মার্কেট রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো। এ রক্তে রঞ্জিত দিনটিকে স্বরণ করেই আজ দেশে দেশে মে দিবস পালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ব্যতীত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই মহান মে দিবস সরকারি ছুটির দিন। সভ্যতার প্রতিটি ইট, বালু ও পাথরে যাদের ঘাম ও রক্ত জড়িয়ে আছে, যে শ্রমিকরা ছাড়া কখনোই সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না, এখনো নয়। সেই শ্রমিকরা আজ অবহেলিত, লাঞ্জিত ও শোষিত ! ১০-১২ ঘন্টা কাজ করত কিন্তু মুজুরী পেত সামান্য! শ্রমিকরা সর্বপ্রথম মুখ খুললো ১৮৬০ সালে! কিন্তু শ্রমিক সংগঠন না থাকায় এ দাবী জোরালো করা সম্ভব হয় নি! আন্দোলনে ১৯ জনের মত প্রাণ বিসর্জন দেয় ও ০৬ জনেরমত ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে আন্দোলনের নেতা আগষ্ট স্পিজ বলেছিলেন। আজ আমাদের এ নি:শব্দতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা শক্তিশালী হবে। ১৮৯১ সাল থেকে দিবসটি বিভিন্ন দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো পালন শুরু করে! ১৯০৪ সালে জাতিসংঘ আই.এল ও কনভেনশনে (Internatinal Labour Oriented Convention) এর মাধ্যমে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে থেকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মহান মে দিবস পালিত হচ্ছে, মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় ও বিজয়ের প্রতিক হিসেবে। এ যাবত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৮০টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু খোদ আমেরিকা আজো এ সনদে স্বাক্ষর করেনি। এমনকি আমেরিকা ও কানাডা এ দিবসটি পালনও করে না বরং তারা সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার জাতীয় শ্রমিক দিবস পালন করে থাকে। যে দেশগুলো আই.এলও কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি তাদের মধ্যে জাপান অন্যতম।
ইসলাম মানবজীবনের জন্য রহমত! জাহেলি যুগে আরবে যখন দাস-দাসী ও গরিব শ্রমিকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হতো তখনই রাসুল (সা:) নিয়ে এসেছিলেন মানবতার বার্তা। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে ইসলামের। এর পর শ্রমিক ও মালিকের সৌহার্দমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক বিধানের প্রচলন করেছে ইসলাম যেখানে দুর্বল শ্রেণিকে শোষণ-নিপীড়নে পিষ্ঠ করার জঘন্য প্রবণতা নেই। কেননা ইসলাম হচ্ছে সাম্য ও মানবতার ধর্ম! ইসলাম সমাজে এ কথা বাস্তবায়ন করেছে যে, আল্লাহর বান্দা হিসেবে সবাই সমান। এতে কোনো ভেদাভেদ নেই! এ জন্য বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজি (সা:) বলেছেন, অনারবের ওপর আরবের আর আরবের ওপর অনারবের এবং শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের ও কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই! শ্রেষ্ঠত্ব শুধু আল্লাহভীতি ও ধর্ম পালনের দিক দিয়েই বিবেচিত হতে পারে (মুসনাদে আহমদ-২২৯৭৮)
ইসলাম হলো প্রকৃতির ধমর্, আল্লাহর নিকট আত্মসম্পর্পণ: ইংরেজীতে ইসলাম (The Arabic name of the religion of peace. Submiting of the will of Allah/Making peace with the creator) শ্রম অর্থ পরিশ্রম, মেহনত, দৈহিক খাটুনি। এর ইংরেজী শব্দ হলো Labour. Effort. Hard work. Exertion etc.
পরিভাষায় শ্রম হলো, উপার্জনের উদ্দেশ্যে মেধা, সময় ও শক্তি বিনিয়োগ করা।
শ্রমিক: যিনি শ্রম দেন বা পরিশ্রম করেন। মজুর, মজদূর যে শরীর খাটিয়ে খায়। শ্রমজীবী, মেহনতি, শ্রমী যে পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করে! পরিশ্রমী, শ্রমশীল, শ্রমোপজীবী পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা নির্বাহ কারী।
শ্রম ও শ্রমিকের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পারিশ্রমিক। পারিশ্রমিক হলো শ্রমের বিনিময়, মজুরী, মজদুরী।
পারিশ্রমিক (১) সাধারণ কর্মচারী বা শ্রমিকের ক্ষেত্রে বলা হয় মজুরী (Wage) (২) চাকুরীজীবী সাধারণ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে বলা হয় বেতন (Salary) এবং (৩) উচ্চপদস্থ বা সম্মানিতদের ক্ষেত্রে বলা হয় সম্মানী (Honarium) আরবীতে বলে আজরুন, উজরাতুন। পবিত্র কুরআনে এসেছে ফাতুহুন্না উজুরাহুন্না ফারিদাতুন। আর তোমরা তাদেরকে তাদের নির্ধারিত বিনিময় দিয়ে দাও। (সূরা: নিসা-২৪) হযরত মুছা (আ:) ৮-১০ বছর কাজ করে তার বিনিময়ে হযরত হাজেরা (রা:) কে পেলেন এটি তার কাজের বিনিময় বা প্রতিদান। তাই তার নাম হয়েছে আজর (আজেরা বিনিময়) যা পরিবর্তিত উচ্চারনে হাজেরা হয়েছে। পারিশ্রমিক শ্রমিকের জীবনে জীবিকার প্রদান অবলম্বন।
শ্রমিকের প্রতি মমতা : ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন অন্ন-বস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছে। যাতে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়। একজন স্বাধীন ব্যক্তির যেমন বাসস্থান পাওয়ার অধিকার রয়েছে, তেমনি একজন শ্রমিকেরও বাসস্থান পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ইসলাম মালিক শ্রমিক উভয়কেই সমান অধিকার প্রদান করেছে। রাসুল (সা:) এ সম্পর্কে বলেন: যে আমাদের কোনো দায়িত্বের নিযুক্ত হলো অথচ তার কোন ঘর নেই, তাকে সে যেনো আবাসিক ঘর বানিয়ে দেয়। অথবা যার স্ত্রী নেই, সে যেন বিয়ে করে নেয় অথবা যার কোনো ভূত্য নেই, সে যেন ভূত্য গ্রহণ করে অথবা যারা বাহন নেই, সে যেন একটি বাহন করে নেয়। (আল মুসনাদ: হাদীস নং ১৭৩২৯)
রাসুল (সা:) বলেছেন: প্রতি আদম সন্তানের জন্য এ বস্তুগুলোর মধ্যে অধিকার রয়েছে। বাসস্থ’ানের জন্য ঘর, লজ্বাস্থান ঢাকার জন্য বস্ত্র, স্বাভাবিক খাদ্য পানীয়। (তিরমিযী ২য় খন্ড পৃ:৫৯)
অন্যত্র রাসুল (সা:) বলেছেন: তারা তোমাদের ভাই! আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই-ই খাওয়ায় যা সে খায়! সেই কাপড় পরিধান করায় যা সে নিজে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যর অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে। (বুখারী : ৫৬১৭) উপরোল্লিখিত হাদিসসমূহে শ্রমিক ও মালিক পরোস্পরের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ সাধন করা হয়েছে।
শ্রম ও শ্রমিক : শ্রমিকের সাথে মালিকের সম্পর্ক আচার-ব্যবস্থার কি রকম হবে, সে সম্পর্কে ইসলামের সুন্দর নীতিমালা রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক-শ্রমিক ভাই ভাই! তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততাপূর্ণ। শ্রমিক ছাড়া মালিক যেমন অচল, তেমনি সবাই মালিক হয়ে গেলো তখন শ্রমিক বলতে কেউ থাকবে না। তা ছাড়া এটা মানুষের বিশেষত্ব যে, কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়! তাই মানুষ বলতেই সবাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ এভাবেই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য কেউ চাইলেও কারও সহযোগিতা ছাড়া জীবন চালাতে পারবে না । কার ও না কারো সাহায্য তাকে নিতেই হবে। এখান থেকেই শ্রম ও শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ কারনেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে চলতে বাধ্য! কেননা মানুষ সামাজীক জীব।
শ্রমের মর্যাদা : ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল কাজে ও হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ মোটেই লজ্বার ব্যাপার নয়, বরং এ হচ্ছে নবী- রাসুলদের সুন্নত! প্রত্যেক নবী রাসুলই কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমনকি উপার্জনের প্রতি স্বয়ং আল্লাহ উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, সালাত শেষ হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পর এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। (সূরা: জুমা-১০)। মিকদাদ (রা:) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (রা:) বলেন, এর চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জনের মাধ্যমে ক্রয় করে। নবী দাউদ (আ:) নিজ হাতে উপার্জনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। (বোখারী-২০২৭)। হযরত ইদ্রিস (আ:) সেলাই কাজ করতেন। জিন্দাপীর খ্যাত স¤্রাট আওরঙ্গজেব বা বাদশাহ আলমগীর নিজ হাতে টুপি সেলাই করে বিক্রয় করে জীবিকা উপার্জন করতেন। হযরত শুআইব (আ:) এর খামারে হযরত মুসা (আ:) ৮-১০ বছর চাকুরী করেছেন। আমাদের প্রিয় নবীজি (সা:) ও মা খাদিজার কোম্পানীতে চাকুরী করেছেন। শ্রমের অনেক ধরন রয়েছে, যদিও মানুষের প্রয়োজনীয় কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। মুচি জুতা সেলাই করে, দর্জি কাপড় সেলাই করে, নাপিত চুল কাটেন, জেলে মাছ ধরেন, ধোপা কাপড় পরিস্কার করেন, ফেরিওয়ালা জিনিসপত্র বিক্রি করেন, তাঁতি কাপড় বোনেন, কুমার পাতিল বানান, এসব কাজ এতই জরুরী যে, কাউকে না কাউকে অবশ্যই কাজগুলো করতে হবে। এখন এসব কাজে যদি কেই এগিয়ে না আসতেন তাহলো মানবজীবন অচল হয়ে পড়ত। এ জন্য শরিয়ত সমর্থিত কোনো কাজই নগণ্য নয় এবং যারা এসব কাজ করেন তারাও হীন বা ঘৃণ্য নন। (চলবে)
লেখক: শিক্ষাবিদ, ইসলামী গবেষক, কলামিষ্ট।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন
টেকসই উন্নয়নের কথা মাথায় রেখেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য নীতি করার তাগিদ
লোকসংগীত শিল্পী নিপা আহমেদ সারাহ্ এর একক সঙ্গীত সন্ধ্যা