হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি
২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৫ এএম
বিশ্ব-ইতিহাস পর্যালোচনায় একথা সুস্পষ্ট হয় যে, প্রতিটি যুগ ও শতাব্দিতে সৃষ্টির সেরা মানবজাতি যখন নানাবিধ গোমরাহী বা পথ ভ্রষ্টতার শিকার হয় তখন মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টির প্রতি দয়া পরবশ হয়ে মহান হাদী বা সঠিক পথের দিশারীদের প্রেরণ কিংবা সৃষ্টি করে মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। এ পথ প্রদর্শকদের শীর্ষে রয়েছেন সম্মানিত নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম। এ নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর শুভাগমনের ধারা পরিপূর্ণতা লাভ করে নবী ও রসূলকুল শ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পৃথিবীপৃষ্ঠে শুভাগমনের মাধ্যমে। তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-রসূল। তাঁরপর আর কোন নবী ও রসূল পৃথিবী পৃষ্ঠে আসেননি, আসবেনও না। আর এ শেষ যামানায় নবীর প্রতিষ্ঠিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ পরিপূর্ণ দ্বীন-ইসলামকে আসল রূপে প্রতিষ্ঠিত রাখার দায়িত্ব বর্তানো হয় এ উম্মতের হাক্কানী রব্বানী ওলামা-ই কেরামের উপর। এমন হক্বক্বানী-রব্বানী ওলামা-ই কেরামের একজন হলেন হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহ্। তিনি একাধারে একজন সৈয়দ বংশীয় যুগশ্রেষ্ঠ সুন্নী আলিম-ই দ্বীন, মুর্শিদে কামিল, অকৃত্রিম খোদাপ্রেমিক ও আশেক্ব-ই রসূল, গণ-মানুষকে জান্নাতের পথে আনার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আন্তরিক, সর্বোপরি একজন অসংখ্য কারামতসম্পন্ন ওলী-ই কামিল ছিলেন। এ কারণেই তিনি সমসাময়িক যাবতীয় বাতিলের সাথে সফল মোকাবেলা করে ইসলামের সঠিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অকল্পনীয়ভাবে সফল হয়েছিলেন।
শাহানশাহে সিরিকোটের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : তিনি ইমাম হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ৩৭তম অধঃস্তন পুরুষ। তাঁর আসল নাম ‘আহমদ’। তাঁর নামের আগে ‘সৈয়্যদ’ শব্দটি বংশীয় উপাধি আর ‘শাহ্’ শব্দটি জাতিগত উপাধি হিসেবে সংযোজিত হয়। তাই তিনি সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি’ নামে সমধিক খ্যাত। ‘সিরিকোট’ তাঁর জন্ম ও বাসস্থান। তিনি খাঁটি সাইয়্যেদ বংশের এক প্রসিদ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সাইয়্যেদ সদর শাহ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। অধিকাংশের মতে তিনি ১৮৫৭ ইংরেজি সালে জন্মগ্রহণ করেন। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সিরিকোট গ্রাম তাঁর জন্মস্থান। তিনি অল্প বয়সে পবিত্র ক্বোরআন হিফয করেন। স্থানীয় বিদ্যাপীঠে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য হিন্দুস্থানে গমন করেন। তিনি ১২৯৭হি. মোতাবেক ১৮৮০খ্রিস্টাব্দে উচ্চতর ডিগ্রীর সর্বশেষ সনদ অর্জন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দির নব্বইর দশকে বিবাহ্ করেন। অতঃপর ব্যবসার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় গমন করেন। সেখানে সূতা ব্যবসায় যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে চলে আসেন। দেশে এসে ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বার মহান পীর, মা‘আরিফে লাদুনিয়ার প্র¯্রবণ ও উলুমে ইলাহিয়ার ধারক হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহর বরকতময় হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। ১৯২০ ইংরেজি সালে আপন পীরের নির্দেশে প্রায় ৬৩ বছর বয়সে বার্মায় গমন করেন এবং ত্বরীক্বা-ই ক্বাদেরিয়া সম্প্রসারণের প্রয়াস পান। পরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ত্বরীকার প্রচার-প্রসারে বহুমুখী অবদান রাখতে সক্ষম হন। অবশেষে ১৯৬১ সালে ওফাত বরণ করেন।
দ্বীন ও মাযহাবের বড় বড় খিদমত : এ নিবন্ধে শাহানশাহে সিরিকোটের কতিপয় ঐতিাহিসক অবদানের কথা উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
এক. দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপটাউন, মোম্বাসা ও জাঞ্জিবারের বিভিন্ন জনপদে শাহানশাহে সিরিকোটের হাতে অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।
[সূত্র. ড. ইব্রাহীম এম. মাহদী লিখিত এ্যা শর্ট হিস্ট্রী অব ইসলাম ইন সাউথ আফ্রিকা]
দুই. ১৯১১ইংরেজি সালে তাঁর নিজের অর্জিত অর্থে আফ্রিকার প্রথম জামে মসজিদটি তাঁর হাতেই নির্মিত হয়। [সুত্র. প্রাগুক্ত]
তিন. ১৯০২ ইংরেজি সনে হরিপুর বাজারে প্রতিষ্ঠিত ‘দারুল উলূম ইসলামিয়া রহমানিয়া’ হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহর বরকতময় হাতেই বিশাল মারকায (কেন্দ্র) হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে।
চার. ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রেঙ্গুনে শুভ পদার্পণ করেন। এখানে তিনি ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ ২১-২২ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি তৎকালীন বার্মায় হাজার হাজার অমুসলিমকে মুসলমান বানিয়েছেন এবং অসংখ্য বিপথগামী মুসলমানকে বানিয়েছেন সাচ্ছা (সুন্নী) আক্বীদার পরহেযগার বান্দা। [সূত্র. সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট, আঞ্জুমানে শূরা-ই রহমানিয়া, রেঙ্গুন, ৬ অক্টোবর, ১৯৩৫ইং]
পাঁচ. তিনি রেঙ্গুন গমন করে প্রথমে ক্যাম্পবেলপুরে মাওলানা সুলতানের মাদরাসায় এবং পরবর্তীতে রেঙ্গুনের বিখ্যাত বাঙালী সুন্নী জামে মসজিদের খতীব ও ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর তা’লীম তারবিয়াত এবং হিদায়তের ফলে অনেক সৌভাগ্যবান বান্দা ইনসান-ই কামিল, এমনকি ওলী-বুযুর্গে পরিণত হন।
ছয়. হযরত খাজা চৌহরভী নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁর লিখিত ৩০ পারা সম্বলিত দুরূদ শরীফ গ্রন্থ ‘মাজমূ‘আহ্-ই সালাওয়াত-ই রসূল’ ছাপানোর কাজ এবং দারুল উলুম রহমানিয়া মাদরাসা পরিচালনার জন্য কোন বিহিত ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি রেঙ্গুনেই অবস্থান করেন। সুতরাং তিনি ১৬ বছর পর স্বদেশে যান। ইতোমধ্যে তিনি ১৯৩০ সনে এত বিশাল পরিসরের কিতাবটির রেঙ্গুন থেকেই প্রথম সংস্করণ প্রকাশের কাজ সুসম্পন্ন করেন ও রহমানিয়া মাদরাসার দ্বিতল ভবন নির্মাণ করান। এমনকি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আবাসন এবং শিক্ষকদের নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থাটাও তিনি রেঙ্গুন থেকে করেছেন।
সাত. আনজুমান প্রতিষ্ঠা : ১৯২৫ ইংরেজির ১৫ই ফেব্রুয়ারি রেঙ্গুনের সুলে পেগোড়া সড়কের বাঙালী সুন্নী জামে মসজিদে বসে তাঁর বিশাল দ্বীনী মিশনে নিজের মুরীদরেকে কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘আনজুমানে শূরা-ই রহমানিয়া’। এ আনজুমান ২৯ শে আগস্ট ১৯৩৭ ইংরেজি হতে প্রথমে রেঙ্গুনের চট্টগ্রাম শাখা হিসেবে এবং পরে ১৯৪২ ইংরেজি হতে কেন্দ্রীয় সংগঠনের ভূমিকা পালন করে চট্টগ্রামে। এটা এ নামে কাজ করে দীর্ঘ ৩০ বছর। পরে ২২ জানুয়ারী ১৯৫৪ ইংরেজি সনে ‘আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ প্রতিষ্ঠা করা হয় নতুন মাদরাসা বাস্তবায়নের জন্য। এরপর এ দু’ আনজুমান যুক্ত হয়ে ‘আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে (১৮ই মার্চ, ১৯৫৬ইং) এ নামে খ্যাত হয়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’। এ আনজুমানের অধীনে ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’সহ দুই শতাধিক মাদরাসা পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’ প্রতি বছর আয়োজিত হচ্ছে। মাসিক তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আলমগীর খানকাহ্ শরীফসহ অগণিত খানক্বাহ্, মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে। এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ আধ্যাত্মিক সংগঠন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’ দ্বীন ও মাযহাবের অসাধারণ খিদমত আনজাম দিচ্ছে। ‘আনজুমান রিসার্চ সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও পরিচালিত হচ্ছে এবং প্রতি বছর অগণিত অতি জরুরী ইসলামি গ্রন্থ পুস্তক প্রকাশিত হচ্ছে। (চলবে)
লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি আর হাসিনার ভরসা ভারতে -দুলু
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন
২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত বিএনপির যুগপৎ সঙ্গীদের
ঢাকায় ‘হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিশ্বের নারীদের আদর্শ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
চার ভাগে ফিরবেন ক্রিকেটাররা
চাঁদাবাজদের ক্ষমতায় আসতে দেবেন না: হাসনাত
এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের বরাদ্দ পেল বাফুফে
ইজতেমা মাঠকে যারা খুনের মাঠে পরিণত করেছে তারা সন্ত্রাসী
আসছে ভিভোর এক্স সিরিজের নতুন ফ্ল্যাগশিপ
বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ২ ভারতীয় নাগরিককে স্বদেশে ফেরত
মুন্সীগঞ্জে বিএনপি’র দু পক্ষে সংঘর্ষ,৩ জন গুলিবিদ্ব সহ আহত ১০
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাকিব-তামিমকে পাওয়া যাবে: ফারুক
ইজতেমা মাঠে হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করুন
কলাপাড়ায় অটোরিকশা উল্টে শিশুর মৃত্যু
আগামীকাল পঞ্চগড়ে বিএনপির জনসমাবেশ
ব্যাক্তিস্বার্থ পরিহার করে, দেশ ও দলের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে: ইলিয়াস পাটোয়ারী
সখিপুরে বিদ্যুৎষ্পৃষ্টে ডিস ব্যবসায়ীর মৃত্যু
যারাই সুযোগ পেয়েছে তারাই দেশের সাথে বেঈমানী করেছে: ডা. মু. তাহের
পঞ্চমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো মৌমাছি ও মধু সম্মেলন
শীতের দিনে ঝিরঝিরে বৃষ্টি স্থবির খুলনা শহুরে জীবন