খুব বেশি মনে পড়ে ইনকিলাবের দিনগুলো

Daily Inqilab খন্দকার হাসনাত করিম

০৩ জুন ২০২৩, ০৭:২৮ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০৩ এএম

এটা খুবই স্বাভাবিক, সব প্রতিষ্ঠানে কর্ম অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি সব সময় স্মরণ পথে দোলা দেয় না। তবে দৈনিক ইনকিলাবের কথা সত্যিই আলাদা। কারণ, এই পত্রিকা আমার শুধু একটি পেশাগত কর্মস্থলই ছিল না, ছিল অন্য রকম আবেগের জায়গা। ইনকিলাব শব্দের অর্থ বিপ্লব। এ ছিল কার্যতঃ তাই। একটি জাতির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন নানাবিধ আগ্রাসনের মুখে; একটি জাতির মানস দর্শন ও ঐতিহাসিক আত্ম-পরিচিতি যখন বিস্মৃতপ্রায়, একটি আলোকিত অতীতকে যখন পরিকল্পনা করে আঁধারে ঢেকে দেবার অপচেষ্টা চলমান, তখন বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ হয়ে লাখ লাখ পাঠকের চিত্ত আকাশে আগমন ঘটেছিল দৈনিক ইনকিলাবের। পৃথিবীর কোথাও কোনো দৈনিক প্রকাশনার অনতিকালের মধ্যে এত বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে কিনা, জানি না। তবে বাংলাদেশের ইনকিলাব ভূমিষ্ট হওয়া মাত্রই সর্ব মহলে একটা সাড়া ফেলে দিতে পেরেছিল। আজ এ দেশের রাজনৈতিক মানস দর্শনে জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধের যে জয়জয়কার, এই চিন্তাশক্তির মুখ্য জন্মপরিচয় ঘটেছিল দৈনিক ইনকিলাবের কলামের পর কলামের সুচারু বিন্যাসে। বাংলাদেশের সুপরিকল্পিতভাবে কোনঠাসা করে রাখা সংবাদপত্রসেবী এবং কলাকুশলীরা যে পারেন একটি নব ভূমিষ্ঠ দৈনিককে প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে নিয়ে যেতে, এর প্রমাণ রেখেছিলেন এই পত্রিকার পুরোধা কর্মীরা। পত্রিকার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি মাওলানা এম. এ. মান্নান ও তাঁর তরুণ তুর্কী পুত্রগণ পূর্বাপর নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন এত বড় একটি প্রকাশনা সা¤্রাজ্যের।

ব্যক্তিগতভাবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দৈনিক ইনকিলাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে একদল সুযোগ্য ও চৌকস সাংবাদিক এবং কলাকুশলীদের নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় ভূমিকা পালনের। প্রতিষ্ঠিত কাগজে কর্মে ইস্তফা দিয়ে নতুন পত্রিকায় যোগ দিতে অনেকের এবং তাদের পরিবার-পরিজনের মন সায় দেয়নি। আমাকে প্রথম দর্শনেই ¯েœহের ডোরে বেঁধে ফেলেন প্রবীণ সাংবাদিক এ. কে. এম. মহিউদ্দীন। এই বিরলপ্রজ মানুষটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক ও সংবাদশিল্প ব্যবস্থাপক। তাঁর সাথে আমার পরিচয়ের সূত্র অনিবার্যতঃই আমাদের সকলের পিতৃতুল্য অভিভাবক অধ্যাপক আবদুল গফুর। আর গফুর সাহেবকে আমার জন্য সুপারিশ করেছিলেন ‘কনসেপ্ট’ পত্রিকার প্রকাশক মরহুম মোশারফ হোসেন এবং সম্পাদক জাকিউদ্দীন আহমদ। দৈনিক ইনকিলাবের কাছে আমার যে হৃদয়ের ঋণ, তার একটা বড় কৃতিত্ব এই মানুষগুলোর।

আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় যশোরের মাহমুদুল হক সম্পাদিত ‘নতুন দেশ’ পত্রিকার মাধ্যমে। সেটা পাকিস্তান আমলের কথা। ১৯৭১-এ আমি ও আমার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মাজহারুল করিম (নান্টু) যশোর শহরের ম্যালেরিয়া অফিস থেকে সংগ্রহ করা একটা ‘সাইক্লেস্টাইল’ মেশিনে প্রথম শুরু করি ‘বাংলার মুখ’ পত্রিকার সম্পাদনা। আমি লক্ষ করি, আমার মেধাবী ভাইকে এক প্রকার গন্ডীবদ্ধ করল ছাত্রলীগের সেই অংশটিই, যারা মুক্তিযুদ্ধের মূল ¯্রােতে না থেকে ‘মুজিব বাহিনীতে’ নাম লেখাল, দেরাদুনে আলাদা ট্রেইনিং নিল এবং দেশ স্বাধীন হবার পর ‘জাসদ’ এর জন্ম দিল ও তারও পর গণবাহিনী গড়ে তুলে তথাকথিত ‘শ্রেণী বিপ্লব’ এর নামে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীলতা ছাড়া ইতিবাচক কিছুই দিতে পারল না। এদের সাথে যোগ দেবার আগেও যেমন আমি ন্যাপের রাজনীতিকে ভালবাসতাম, এই ¯্রােত থেকে সাবধানে নিজেকে গুটিয়ে রেখে এর পরও আমি ‘জাসদ’ রাজনীতির সমালোচনা থেকে বিরত হইনি। যদিও আমাকে বৈজ্ঞানিক ছাত্রলীগ বা জাসদপন্থী ছাত্রলীগের মাইকেল মধুসূদন কলেজ শাখার (যশোর) সাধারণ সম্পাদক করা হয় এবং জেলা জাসদ নেতা জনাব রবিউল আলমের সুপারিশে আমাকে ঢাকায় দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার রিপোর্টার হিসাবে চাকরি দেওয়া হয়।

সেই সুবাদেই আমি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য এবং ১৯৮০’র দশকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হয়ে ধন্য হই। ‘বাকশাল’ বা একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর আমার মতো হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েন। এরপর আমি যোগ দেই অলি আহাদ সম্পাদিত ‘ইত্তেহাদ’ সাপ্তাহিকে এবং তুর্কী সংবাদপত্র মিল্লিয়াত গেজেট এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হই। আমি ‘ওকাব’ এর প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৮৭ সালে যোগ দেই দৈনিক ইনকিলাবে। আমিই বোধ হয় দেশের তখন কনিষ্ঠতম সহকারী সম্পাদক। বলেছিলাম, আমি বরাবরই রিপোর্টিংয়ের মানুষ। কিন্তু ততদিনে ইনকিলাবে ছাপা হওয়া কয়েকটি লেখা পড়ে কর্তৃপক্ষ বললেন হাসনাত করিম সহকারী সম্পাদকই হোক। সাথে সাথে বিশেষ প্রতিনিধির মতো ‘এক্সক্লুসিভ’ রিপোর্ট বা বিদেশি বিটও করুক।

সম্পাদক এ. এম. এম. বাহাউদ্দীন আমাকে বিশেষভাবে গণ্য করতেন। দুই দুইটি মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাজীব গান্ধীর অন্তেষ্টিক্রিয়া, দুইবার ভারতীয় সাধারণ নির্বাচন, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, এ ধরনের ‘অ্যাসাইনমেন্টে’ বাহাউদ্দীন ভাই আমাকে মনোনীত করেন। আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এত স্মৃতি সম্পদের জন্য আমি ইনকিলাব সম্পাদক বাহাউদ্দীন ভাইয়ের কাছে ঋণী। একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। ’৯০ সালে স্বৈরাচার নিপাত যাবার পর একদল কুচক্রী ইনকিলাব ভবনে হামলা ও ইনকিলাব প্রেসে আগুন দিতে চড়াও হয়। আমি সহ্য করতে পারিনি আমার প্রাণপ্রিয় কর্মস্থলে দুর্বৃত্তদের সেই হানাদারী। ছাদে তখন নির্মাণ কাজ চলছিল। দৌড়ে ছাদে উঠে কয়েকটা মোটা লোহার রড সংগ্রহ করে একটা রড নিজে হাতে নিয়ে সেই যে কুচক্রীদের ধাওয়া করে মতিঝিল ছাড়া করলাম। শোকর খোদার, এর পর থেকে কোনো দুর্বৃত্ত দলের স্পর্ধা হয়নি ইনকিলাব ভবনে হামলা করার। সেদিন দেখেছি ইনকিলাবের তরুণ রিপোর্টার ও অন্যান্য সহকর্মী আমার সাথে একই সাহস ও শৌর্য নিয়ে হামলাকারীদের ধাওয়ায় অংশ নেন। এই হলো ইনকিলাব বা বিপ্লব। ইনকিলাব-এ আমার নিয়মিত কলাম স্পষ্টভাষীর মঞ্চে ময়দানে এখনো প্রবীণ পাঠকদের মনে জায়গা করে আছে। এটাই আমার প্রেরণা এবং প্রশান্তি।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা

বিষয় : year


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না

সাভারে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী কেউ ছাত্র ছিল না