ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

মাওলানা মান্নান (রহ.) এর অনন্য কীর্তি ইনকিলাব

Daily Inqilab মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী

০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাঁর পিতা মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইয়াসীন (রহ.) এবং তাঁর নানা আব্দুল মজীদ (রহ.) উপমহাদেশের বিখ্যাত সাধক ফুরফুরা শরীফের পীর হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দীকী (রহ.)-এর সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি নিজে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, সংগঠক ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অবিসংবাদী সভাপতি। তিনি একজন সুদক্ষ সংবাদপত্র সেবী হিসেবে যে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ তার প্রকৃষ্ট এবং উজ্জ্বল প্রমাণ। এখানে আমরা কেবল তার সংবাদপত্র সেবার ওপর কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। একটি সময় ছিল যখন আলেম সমাজ আধুনিক, শিক্ষিত মহলে নিন্দিত ও তিরষ্কৃত ছিলেন। তাদেরকে মোল্লা-মৌলভী অখ্যায়িত করে সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা কম করা হয়নি। তখন মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী নিন্দুকদের জবাব দিয়ে ছিলেন। তারা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন কিন্তু আলহাজ এম এ মান্নান সেটা করেছেন পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। মোল্লা-মৌলভীরা সুযোগ পেলে ভালো অনেক কিছুই করতে পারেন, মাওলানা এম এ মান্নান তার ইনকিলাবের মাধ্যমে তাই প্রমাণ করেছেন। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে দৈনিক আজাদের অবিস্মরণীয় অবদানের কথা বলা হয়। এই পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার সাড়ে তিন বছর পর মাওলানা ইসলামাবাদী আধুনিক শিক্ষিতদের অভিযোগের জবাব দিয়েছিলেন। তার সেই জবাব হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সম্পূর্ণ প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাহিত্যচর্চা, সংবাদপত্র প্রকাশনা, পরিচালনা, সাংগঠনিক তৎপরতা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে অবহেলিত-উপেক্ষিত আলেম সমাজের ভূমিকাই ছিল শীর্ষে।

১১ এপ্রিল ১৯৩৯ সাল। কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে নিখিল বঙ্গ মৌলভী এসোসিয়েশনের বার্ষিক অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তার প্রদত্ত অভিভাষণে আলেম সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করে গেছেন, তা এত বছর পরও সমান গুরুত্ব বহন করে। তার এই ঐতিহাসিক অভিভাষণ পরবর্তীকালে ‘কোরআনে স্বাধীনতার বাণী’ শিরোনামে পুস্তিাকাকারে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। মাওলানা ইসলামাবাদী তার অভিভাষণে আলেমগণের দান সম্পর্কে বলেন: ‘বর্তমান জমানায় অনেকের বিশ^াস, বিশেষত আমাদের নব্যশিক্ষিত বন্ধুবর্গের ধারণা, মৌলভী-মোল্লাদের দ্বারা সমাজের কোনোরূপ মঙ্গল সাধিত হওয়াতো দূরের কথা বরং তাহারা উন্নতির পথে অন্তরায়। তাহারা ইংরেজি পড়িতে নিষেধ করেছিলেন, এখনও কোনো কোনো আলেম নিষেধ করিয়া থাকেন। তারা দুনিয়া ছাড়তে বলেন, কথায় কথায় কোফরের বুলি আওড়ান ইত্যাদি। উত্তরে বলিব, হয়তো ঐরূপ কয়েকজন আলেমের জন্য যে সমস্ত আলেম সমাজের প্রতি দোষারোপ করিতে হইবে ইহা যুক্তিসঙ্গত নহে। আরও এক কথা, কীরূপ অবস্থায় ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধ বলিয়া ফতওয়া দিয়েছিলেন তাহাও একবার চিন্তা করিয়া দেখা আবশ্যক...।’

অতঃপর মাওলানা ইসলামাবাদী সাহেব উলামায়ে কেরামের এক দীর্ঘ তালিকা পেশ করেন, ‘যাঁরা সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এবং এদেশে ইসলামী পূর্ণ জাগরণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। মোল্লা-মৌলভীদের যারা তিরষ্কার করতে অভ্যস্ত এবং তাদের অবদান-ভূমিকাকে যারা বাঁকা চোখে দেখেন, তাদের সামনে মাওলানা ইসলামাবাদী দালিলিকভাবে প্রমাণ করেছেন যে, ইসলামের মহান খেদমতের সাথে সাথে আলেম সমাজ সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজসেবা, সাংগঠনিক তৎপরতা, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ^াসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আজাদী আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। তাই মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে তখনও এক শ্রেণির নব্যশিক্ষিত লোক অপপ্রচারণায় থাকত এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর সাথে তাদের সমাজের অপদার্থ আখ্যায়িত করে মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা তুলে দেয়ার জন্য তৎপর হতে থাকে। এহেন তৎপরতার পরিচয় সব যুগেই দেখতে পাওয়া যায়। মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে কোথাও কোনো প্রকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেলে তাদের আনন্দের সীমা থাকে না।’

মাওলানা ইসলামাবাদীর পর সাবেক পাকিস্তান আমলে যখন মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে টিটকারী বিদ্রুপ শুরু হয় এবং মাদরাসা শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই, বন্ধ করে দেয়া হোকÑ এহেন মন্তব্য ও বক্তব্য পেশ করা হয়। তখন আলেম ও মাদরাসা ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। তখন বিখ্যাত লেখক মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমীসহ অনেকে পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধবাদীদের প্রতিবাদে লেখালেখী করতে থাকেন। এই সময় আজমী সাহেবের একটি প্রবন্ধ ‘মাদরাসা শিক্ষ কি ব্যর্থ হয়েছে?’ শিরোনামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জাগতিক ও পারলৌকিক কাজে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের স্মরণীয় অবদানের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন: ‘এছাড়া সংবাদপত্রের সেবাকেও যদি এ কাজের মধ্যে গণ্য করা হয় তাহলে বলেতে হবে যে, মাদরাসা শিক্ষা এ ব্যাপারে শীর্ষস্থান অধিকার করে রয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে মাওলানা আজমী খ্যাতনামা সংবাপত্র সম্পাদকদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন যে, আলেমগণের সংবাদপত্র সেবার কথা কে অস্বীকার করতে পারে?

আজমী সাহেবের পরে আরো অনেকে সংবাদপত্র ও সাহিত্যে সেবায় আলেম সমাজের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। এসব রচনায় বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অপপ্রচার অব্যাহত থাকে। মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে পরিচালিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বলিষ্ঠভাবে সকল বিরোধিতা ও অপপ্রচারের জবাব দিয়েছে এবং একই সাথে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন সংস্কার এবং পাঠ্যসূচির আধুনিকায়নে দূরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের এই বৃহত্তর সংগঠনের সভাপতি হিসেবে মাওলানা এম এ মান্নানের যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ পরিচালনা একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়। তবে তিনি দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে দেশ ও জাতির এবং আলেম সমাজের যে মহাউপকার সাধন করেছেন তার বিশদ বিবরণ দান করা এখানে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলতে চাই, মাওলানা এম এ মান্নান দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশ করে কেবল এদেশের সমগ্র জনগণেরই উপকার করেননি, বিশেষত মুসলিম সমাজের কল্যাণ-অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ইসলাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুসলিম সংস্কৃতি, উলামা-আওলিয়া, পীর-মাশায়েখের জীবন, ইসলামী অর্থনীতি প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান ছাড়াও মুসলিম উম্মাহ, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জোরদার করা ছাড়াও ইসলামের নামে বিরাজমান অনাচার, কুসংস্কার, অন্ধবিশ^াস, ইসলাবিরোধী প্রচারণা, ইসলামের অবমাননা প্রভৃতি বন্ধের জন্য জোরালো ভূমিকা রাখেন এই পত্রিকার মাধ্যমে। শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ উন্নয়নে ইনকিলাব দিশারী হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। জাতীয় সংহতি জোরদার করে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী এবং দেশের অখণ্ডতা সুরক্ষার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা ইনকিলাবের প্রধান ভূমিকা। এসবই সম্ভব হয়েছে মাওলানার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও পরিচালনায়। তার পরামর্শ ও নির্দেশানা পত্রিকাটির মূল শক্তি হিসেবে কাজ করতে থাকে।

আধুনিক যুগে আধুনিক একটি উন্নতমানের বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করা ছিল মাওলানা এম এ মান্নানের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করে ১৯৮৬ সালের ৪ জুন দৈনিক ইনকিলাব নামে তাঁর জীবদ্দশায়। তিনি সরাসরি এই পত্রিকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে আধুনিক শিক্ষিত সাংবাদিকদের এক বিরাট কর্মীবাহিনী-এর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন। তাছাড়া আধুনিক শিক্ষিতদের বিভিন্ন পেশার অসংখ্য দক্ষ লেখক ইনকিলাবের নিয়মিত লেখক। আলেম সমাজের বিপুল সংখ্যক লেখক হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেছেন। পত্রিকার নিত্যনতুন ফিচার, প্রবন্ধ ইত্যাদি ছাড়াও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর সবধরনের লেখা-সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছে। নতুন নতুন অনেক বিষয় অন্যান্য পত্র-পকিায়ও অনুসৃত হতে দেখা যায়।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা