কবিতার আধুনিকতা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৬ পিএম
এক.
‘আধুনিক’ ‘অধুনা’ শব্দের বিশেষণ। অধুনা অর্থ সম্প্রতি, বর্তমানে, আজকাল, ইদানীং; আধুনিক অর্থ সাম্প্রতিক বা বর্তমান সময়ের। ফলে আধুনিকতা হলো তা-ই, বর্তমান সময়ের সাথে বা সাম্প্রতিক কালের সাথে যার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর কবিতার আধুনিকতা হলো কবিতার সাম্প্রতিকতা। অর্থাৎ যে-কবিতা সাম্প্রতিক সময়ের সমাজ, জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, রাষ্ট্র, ভাষা প্রভৃতি ধারণ করে থাকে, তাই আধুনিক কবিতা। এদিক দিয়ে বলতে গেলে পৃথিবীর সব দেশের, সব ভাষার সমস্ত কালের কবিরাই আধুনিক কবি। আধুনিক শব্দটি কেবল বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর কবিদের জন্য নির্ধারিত, এমনটি নয়।
গ্রিক কবি হোমার, ইসকিলাস, ইউরিপিডিস, সফোক্লিস, যাঁদের জন্ম যিশুখ্রিস্টের জন্মের কয়েক শ বছর আগে, অমর হয়ে আছেন তাঁদের যে অমূল্য সাহিত্যসম্ভারের কারণে, তার মধ্যেও আধুনিকতার সমস্ত লক্ষণ বিরাজমান। হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াডের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, প্রেম-ভালবাসা ও ধর্ম-দর্শনের যে-বর্ণনা আমরা পাই, তা হোমারের সময়কেই ধারণ করে আছে। সফোক্লিসের ইডিপাস রেক্স-এ ইডিপাসের করুণ জীবনকাহিনী, রাজনীতি, কূটনীতি, কুসংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অদৃষ্টবাদের যে-চিত্র আমরা পাই, তাও সফোক্লিসের সময়কালের প্রতিবিম্ব। জিওফ্রে চসার তাঁর কেন্টারবেরি টেলস-এ চতুর্দশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের সমাজচিত্রই তুলে ধরেছেন। একজন মৌলিক কবি, যে-দেশের বা যে-ভাষার হোন না কেন, তাঁর দেশ, মাটি ও মানুষকে হৃদয়ে ধারণ করেই তিনি তাঁর অমর কাব্য সৃজন করে থাকেন।
বিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়। ১৮৯৮ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে রচিত কবিতাবলিকে আধুনিকতাবাদী কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। টি এস এলিয়টকেই মনে করা হয় আধুনিক কবিতার জনক। এলিয়ট তাঁর হঠাৎ করে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতার মাধ্যমে নয়, মূলত তাঁর কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধাবলি দ্বারা আধুনিক কবিতার একটা নতুন সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, যা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। রোমান্টিক যুগের শ্রেষ্ঠ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, ‘কবিতা হলো শক্তিশালী অনুভূতিসমূহের একটি স্বতঃস্ফুর্ত অতিপ্লাবন।’ ‘এলিয়ট ওয়ার্ডসওয়ার্থের সংজ্ঞাকে খ-ন করে বলেন, ‘কবিতা আবেগের বাঁক নয়, বরং আবেগ থেকে মুক্তি; এটি ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়, বরং ব্যক্তিত্ব থেকে অব্যাহতি।’
বিংশ শতাব্দীতে এসে কবিতা হয়ে পড়ে বুদ্ধিজীবী-কবিদের চিন্তার ফসল। আবেগসর্বস্ব স্বল্পজ্ঞানীদের পঙক্তিসমূহ আর কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। আধুনিক কবিতার প্রথম লক্ষণ হয়ে ওঠে পুরাতন ঐতিহ্যের ধারা থেকে বের হয়ে আসা। আধুনিক কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এমন কবিতা হিসাবে, যা পুরাতন নিয়মকানুন ও প্রচলিত কবিতার বিষয়বস্তু থেকে বের হয়ে এসেছে। আধুনিকতাবাদী কবিতার মধ্যে মূলত বিংশ শতাব্দীর দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়।
আধুনিক কবিতার নানা লক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমূহ বিবেচিত হয় বিষয়ের বৈচিত্র্য, সমকালীন জীবনজটিলতা, অস্তিত্বের অনুসন্ধান, রাজনীতি, সামাজিক বিষয়াদি, প্রকৃতি, প্রেম, হতাশা, মানবিক অভিজ্ঞতা প্রভৃতি। তবে এটা ঠিক, তাত্ত্বিক দিকটা বারবার উচ্চারিত হলেও তার প্রায়োগিক চিত্র কিন্তু প্রায়সময়ই অদৃশ্য থেকে গেছে। অর্থাৎ কবিতা যেরকম ছিলো সেরকমই রয়ে গেছে, কেবল বদলে গেছে তার নাম।
দুই.
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার আমদানি ঘটে ইউরোপ থেকেই। ইউরোপে যেমন তাত্ত্বিক এলিয়ট যুক্তির মারপ্যাঁচে কবিতার চারিত্র্যকে পাল্টিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন, বাংলা ভাষাতেও কিছু কবির আবির্ভাব হলো, যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো প্রবল প্রভাবশালী দুজন কবিকে অনাধুনিক বলে বসলেন আর নিজেদেরকে জাহির করলেন আধুনিক কবি বলে। দীপ্তি ত্রিপাঠী নামক একজন সাহিত্যগবেষককে দিয়ে তাঁরা একটি তাত্ত্বিক কাহিনী দাঁড় করালেন আর নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলেন পঞ্চ পা-ব বলে। কুরুক্ষেত্রের এই পা-বরা কোন্ অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন? নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বিরুদ্ধে? কিন্তু পাঠকরা এঁদের তরবারির শান দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। তারপর আস্তে আস্তে এঁরা, কেবল জীবনানন্দ দাশ ছাড়া, কবি হিসেবে ম্রিয়মান হয়ে গেলেন।
সারা পৃথিবীতেই দেখা গেছে, তাত্ত্বিক কবিরা কবি হিসেবে দুর্বল হয়ে থাকেন, আওয়াজ করেই তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হতে চান সাহিত্যের ইতিহাসে। মৌলিক কবি যাঁরা এবং যাঁরা বড় কবি, তাঁরা নতুন নতুন সৃষ্টি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামানোর অবসর কই তাঁদের? ভাগ্যিস এলিয়টের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ছিলো, যেজন্যে টিকে গেলেন কবি হিসেবে, কিন্তু ডাব্লউ বি ইয়েটসকে দেখুন, কি বিপুল সৃষ্টি তাঁর, কত তাঁর অমর কবিতা ইংরেজি ভাষায়!
কোন্ যুক্তিতে রবীন্দ্রনাথ হলেন অনাধুনিক আর বুদ্ধদেব বসুরা আধুনিক, তার সুরাহা করতে পারেননি এঁরা। তিরিশের দশকের সমর সেনের মতো তুখোড় একজন কবিও এঁদের দ্বারা আধুনিক বলে স্বীকৃত হলেন না কারণ সমর সেন একবার বুদ্ধদেব বসুর একটি লেখার প্লেজারিজম হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, ফলে তিনি বাদ পড়ে গেলেন পঞ্চ পা-বের তালিকা থেকে। এভাবে চালাকি করে সাহিত্যের লং রেসে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা যায় না। রাজার শরীরে পোশাক না থাকলে, রাজার চাটুকাররা বলতে ভয় করলেও, একজন শিশুপ্রজা কিন্তু ঠিকঠিকই উচ্চকণ্ঠে বলে দেবে, রাজা ন্যাংটা!
মূলত তিরিশের কবিরা যে-কাজটা করতে চেয়েছিলেন, তা হলো, রবীন্দ্র-নজরুল থেকে ভিন্ন ধরনের কবিতা লিখতে। এটা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। ভিন্নতর কবিতা লিখতে না পারলে তো কবি হিসেবে টিকে থাকা যায় না। কিন্তু দেখা গেল, মুখে খুবই খৈ ফুটছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি; কাজীর গরু রয়ে গেছে কিতাবের মধ্যেই। এঁদের মধ্যে একমাত্র শক্তিশালী কবি জীবনানন্দ দাশ, তিনিও ইয়েটসের বাংলা-সংস্করণ হয়ে প্রকাশিত হলেন, ইয়েটস পাঠ না করা বাঙালিপাঠকদের দুচোখ ধাঁধিয়ে গেল জীবনানন্দের নতুনত্বে এবং এখনও পর্যন্ত ধাঁধিয়েই আছে। অজ্ঞতার অন্ধকার দূর না হওয়া পর্যন্ত এ ধাঁধা কখনো দূর হবে বলে মনে হয় না।
এক যুগের কবি পূর্ববর্তী যুগের কবি থেকে আলাদা ধরনের কবিতা লিখবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর কবিতায় আসবে নতুন বিষয়, নতুন ভাষা; আধুনিকতা বলতে তো আমরা এটাকেই বুঝি।
তিন.
বিংশ শতাব্দীতে এসে আধুনিক কবিতার মূল লক্ষণের মধ্যে বিবেচিত হলো আধুনিক মানুষের জীবনযন্ত্রণা, আধুনিক জীবনবোধ, সভ্যতার সংকট, দ্রোহ, সমাজসচেতনতা, হতাশা প্রভৃতি। এসব রবীন্দ্রনাথেও প্রচুর ছিলো, নজরুলেও ছিলো, শেক্সপিয়ারেও ছিলো, চসারেও ছিলো। চসার তাঁর দ্য প্রোলগ টু দ্য কেন্টারবেরি টেলস-এ তদানিন্তন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের চরিত্র এমন নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন যে, পাঠক যেন তাঁর চোখের সামনে চতুর্দশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডকেই দেখতে পান। মাদাম এগলান্টাইন নামক একজন নানের চরিত্র অংকন করেছেন চসার। কি নিপুণ তাঁর বর্ণনা! কবি বলছেন, এক ছিলো নান, সে ছিলো সদা হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী ও লাজুক। সে সবসময় দরবেশ এলয়ের নামে শপথ করতো। নানের নাম ছিলো মাদাম এগলান্টাইন। সে নাকি-সুরে চমৎকারভাবে স্বর্গীয় সঙ্গীত গাইতো। ফরাসী ভাষায় চমৎকার করে কথা বলতো সে। কিভাবে ডাইনিং টেবিলে বসে খানা খেতে হয়, তা সে জানতো এবং খাওয়ার সময় তার মুখ থেকে একটা খাদ্যকণাও কখনো খসে পড়তো না। সসের ভেতরে সে কখনো আঙুল ঢুকিয়ে দিতো না কিন্তু এত চমৎকারভাবে সে তার প্লেটের খাবার খেতো যে, কোনো কিছুই তার বুকের উপর পড়তো না। বিনয় প্রদর্শন করতে সে আনন্দবোধ করতো। সে তার উপরের ঠোঁটটা এমনভাবে মুছে ফেলতো, শরাব পান করার সময় পেয়ালায় কোনো তেলতেলে দাগ লাগতো না। সে এতই ধার্মিক ও দয়ালু ছিলো যে, সে যদি দেখতো কোনো ইঁদুর কোনো ফাঁদে পড়েছে, ফাঁদের ভেতর পড়ে সে মারা গেছে বা রক্তাক্ত হয়েছে, তাহলে সে কষ্টে সেই ইঁদুরটির জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দিতো। তার কিছু ছোট ছোট কুকুর ছিলো, যাদেরকে সে মাংস রোস্ট করে খাওয়াতো, সেইসাথে দুধ ও সুন্দর সাদা ধবধবে রুটি খেতে দিতো। এদের একটা কুকুরও যদি মারা যেতো কিংবা কেউ যদি লোহার লাঠি দিয়ে এদের গায়ে আঘাত করতো, সে কান্নাকাটি জুড়ে দিতো; তার হৃদয় ছিলো এমনই নরম। চসারের ভাষায়:
She was so charitable and piteous
That she would weep if she but saw a mouse
Caught in a trap, though it were dead or bled.
She had some little dogs, too, that she fed
On roasted flesh, or milk and fine white bread.
But sore sheÕd weep if one of them were dead,
Or if men smote it with a rod to smart:
For pity ruled her, and her tender heart.
[The Prologue to the Canterbury Tales, Geoffrey Chaucer]
এভাবে ব্যঙ্গবিদ্রূপের মধ্য দিয়ে চসার যে নানের চরিত্র এখানে তুলে ধরেছেন, তা তাঁর আধুনিকতাবোধেরই পরিচায়ক।
শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত কাব্যনাটকের একটি হ্যামলেট। এ নাটকের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে কবির নিপুণ শিল্পীসত্তা ও আধুনিকতাবোধ। একসাথে পিতা, সিংহাসন, মাতা ও প্রিয়তমাকে হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া হ্যামলেটের স্বগতোক্তিতে যে নৈরাশ্য ও জীবনদর্শন ফুটে উঠেছে, তা শাশ্বত ও অত্যাধুনিক। কবির কথায়:
Whether ‘tis nobler in the mind to suffer
The slings and arrows of outrageous fortune,
Or to take arms against a sea of troubles
And by opposing end them. To die—to sleep,
No more; and by a sleep to say we end
The heart-ache and the thousand natural shocks
That flesh is heir to: ‘tis a consummation
Devoutly to be wish’d. To
[Hamlet, William Shakespeare]
রবীন্দ্রনাথকে রোমান্টিক কবি হিসেবে চিহ্নিত করা বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিজীবী-কবিরা মনে করেছিলেন এভাবে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিকে অনাধুনিক বানিয়ে নিজেরা রাজত্ব করে যাবেন চিরকাল আধুনিক কবি হিসেবে। সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আছে, যেগুলো রোমান্টিসিজমের তীব্র আবহে আক্রান্ত; আবার এও সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা আছে, যেগুলো আধুনিকতাবোধকে ধারণ করে অমর হয়ে আছে বাংলা ভাষায়।
যদি ধরি ‘পৃথিবী’ কবিতার কথা, তাহলে কোন বোধ জেগে ওঠে পাঠকের মধ্যে? কবির কি অমোঘ উচ্চারণ-
আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো, পৃথিবী,
শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।।
মহা বীর্যবতী তুমি বীরভোগ্যা,
বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে,
মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি পুরুষে নারীতে,
মানুষের জীবন দোলায়িত কর তুমি দু:সহ দ্বন্দ্বে।
ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা,
বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র,
তোমার লীলাক্ষেত্র মুখরিত কর অট্টবিদ্রুপে;
দুঃসাধ্য কর বীরের জীবনকে মহৎ জীবনে যার অধিকার।
শ্রেয়কে কর দুর্মূল্য, কৃপা কর না কৃপাপাত্রকে।
[পৃথিবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
কিংবা যদি ধরি রবীন্দ্রনাথের পুনশ্চ কাব্যের ‘বাঁশি’ কবিতার কথা, তাহলে এরচেয়ে বড় আধুনিক কবিতা আর কয়টা মেলে বাংলা ভাষায়? যেমন এর ভাষার আধুনিকতা, তেমনি কি আধুনিক জীবনবোধ বিরাজমান সর্বত্র! কবির কথায়—
কিনু গোয়ালার গলি।
দোতলা বাড়ির
লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
পথের ধারেই।
লোনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
মাঝে মাঝে স্যাঁতা-পড়া দাগ।
মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
সিদ্ধিদাতা গণেশের
দরজার ‘পরে আঁটা।
আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব
এক ভাড়াতেই,
সেটা টিকটিকি।
তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
নেই তার অন্নের অভাব।
[বাঁশি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
নজরুলও প্রচুর রোমান্টিক কবিতা লিখেছেন বাংলা ভাষায়। তবে তাঁর রোমান্টিক কবিতার চেয়ে দ্রোহের কবিতাই বেশি, যার মধ্যে ফুটে উঠেছে দেশ, মাটি, মানুষ ও শাশ্বত জীবনের কথা। নজরুলের চেয়ে সময়সচেতন কবি, কেবল বাংলা ভাষাতে নয়, বিশ্বের অন্য কোনো ভাষায়ও দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। কবির একটি অসাধারণ কবিতা ‘সিন্ধু’। এ কবিতার পরতে পরতে কবির যে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও জীবনজিজ্ঞাসা ব্যক্ত হয়েছে, তা আধুনিকতাবাদিতার অনন্য উদাহরণ। কবির ভাষায়:
হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি,
এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি!
এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান,
বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরিল না প্রাণ?
দুরন্ত গো, মহাবাহু
ওগো রাহু,
তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকী!
সুরা নাই-পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকী!
সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ, কাজী নজরুল ইসলাম]
অতএব দেখা যাচ্ছে, কবিতার আধুনিকতা বিংশ কিংবা একবিংশ শতাব্দীর বিষয় নয়, এটা সর্বকালীন। হোমার, সফোক্লিস, দু ফু, গেটে, বোদলেয়ার কিংবা লুইস গ্লুক মহান এসব বিশ্বকবির কবিতা থেকেও প্রচুর উদ্ধৃতি দেওয়া যায় আধুনিকতার সপক্ষে।
চার.
তারপরও বাংলা আধুনিক কবিতা একটি নির্দিষ্ট আকার প্রাপ্ত হয়েছে, বলা যায়। তিরিশ নয়, চল্লিশের দশক থেকেই মূলত, এর অবয়বিক কাঠামো তৈরি হতে থাকে, পঞ্চাশের দশকে এসে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ বাংলা কবিতা মননে ও শরীরে অনেকটাই আলাদা হয়ে ওঠে এ সময়ে। আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমদ, সভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কবির হাতে এর যাত্রা শুরু। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কবি ফররুখ আহমদ। পিঞ্চাশের দশকের আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কবির হাতে বাংলা কবিতা পূর্ণ-আধুনিকতা প্রাপ্ত হয়, ভাষায় ও মননে।
এখন বাংলা আধুনিক কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়েছে ভাষার আধুনিকতা। সাধু ভাষার ব্যবহার তো নেই-ই, সাধু-চলিতের মিশ্র ব্যবহারও নিষিদ্ধ একেবারে। কবিতায় থাকা চাই বিশুদ্ধ চলিত ভাষা। ইংরেজি আর্কেয়িক ওয়ার্ডের মতো কিছু কিছু শব্দও অচল হয়ে গেছে। তব, মম, সম এসব শব্দ আর চলে না বাংলা কবিতায়; তব হয়ে গেছে তোমার, মম আমার, সম সমান। অর্থাৎ শিক্ষিত আধুনিক বাঙালীরা যে-ভাষা ব্যবহার করেন দৈনন্দিন জীবনে, তা-ই এখনকার কবিতার ভাষা।
ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও এসেছে আধুনিকতা। একসময় বাংলা কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ছিলো জয়জয়কার। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদদীন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কালিদাস প্রমুখ কবির হাতে প্রচুর অমর কবিতা রচিত হয়েছে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। এখন অক্ষরবৃত্তের যুগ। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে যাঁর ভালো দখল নেই, তিনি ভালো কবি হবেন কী করে? তবে এও সত্য, ছন্দবিহীন কবিতাও ভালো কবিতা হতে পারে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ ওয়াল্ট হুয়িটম্যান। হুয়িটম্যানের মেসেজধর্মী ও চিত্রকল্পপ্রধান কবিতাগুলো বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বাংলা ভাষাতেও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর মতো কবি অমর হয়ে আছেন স্রেফ গদ্য কবিতার কারণে।
যে কোনো বিষয় নিয়েই কবিতা হতে পারে, তবে তা হওয়া চাই শৈল্পিক ও সুলিখিত; ভাষার ও বোধের আধুনিকতার ছাপ যেন লেগে থাকে তার পরতে পরতে।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও অধ্যাপক
[email protected]
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাঙামাটির সাজেকে দিনভর গোলাগুলি: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জেলা প্রশাসনের
'বিপ্লবোত্তর ছাত্র ঐক্য' জবিতে ১২ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ
শেরপুরে সেনা সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : গ্রেপ্তার-৭
ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার
ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থাকারীরাই মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্বে
ভিভো ভি৪০ ফাইভজি, হালকা ওজনে শক্তিশালী ব্যাটারি
ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তি সম্প্রীতি চায় না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা
দিল্লী দিশেহারা হয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে: শাহীন শওকত
বাংলাদেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা জারি
সামরিক আইন জারি দক্ষিণ কোরিয়ায়
হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে উত্তরায় মশাল মিছিল
নকলায় ট্রাক চাপায় নাতি পরপারে শিশু নানী হাসপাতালে
ইফায় ১৫ বছরের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত
ভারতের সঙ্গে পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদী সরকারের করা সব গোপন চুক্তি প্রকাশ করা উচিত : হাসনাত আবদুল্লাহ
ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের ২ পদক
ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ভারতের স্বপ্ন ভেস্তে গেছে : হাজী ইয়াছিন
ভারত বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধ বাধানোর চক্রান্ত করছে বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ
পার্থিব ও ওহীর জ্ঞানের সমন্বয়ে গঠিত মাদরাসা শিক্ষা: অধ্যক্ষ শাব্বীর আহমদ মোমতাজী