ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

মাহে রমজানের তাৎপর্য

Daily Inqilab রূহুল আমীন খান

১২ মার্চ ২০২৪, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪, ১২:১৬ এএম

রহমাত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রমজানুল মোবারক ফিরে এসেছে। এ মাস সিয়াম সাধনার। আত্মসংযমের। ধৈর্য, ত্যাগ, সহানুভূতি, সহমর্মিতা অর্জনের। মানবিক গুণাবলী অনুশীলনের। এ জন্য এ মাস অতি পবিত্র। মুসলিম জাতির জন্য তো বটেই অন্যান্য জাতির নিকটও এ মাসটি অতি পবিত্র, বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ মাসে মানব জাতিকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য যেমন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল হয়েছে, তেমনি অন্যান্য আসমানী কিতাবও নাজিল হয়েছে এ পবিত্র মাসেই। এ মাসের মধ্যে অবস্থিত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম কুরআনের নুজুল, তেমনি হযরত ইব্রাহীমের ছহিফা এ মাসের প্রথম কিংবা তৃতীয় তারিখে অবতীর্ণ হয়। অষ্টাদশ কিংবা দ্বাদশ তারিখে জবুর প্রাপ্ত হন হযরত দাউদ (আ.) ৬ষ্ঠ দিবসে তৌরাত পান হযরত মুসা (আ.)। দ্বাদশ কিংবা ত্রোয়দশ তারিখে ইঞ্জিল প্রাপ্ত হন হযরত ঈসা (আ.)। এরূপ সব আসমানী কিতাব এ মাসে নাজিল হওয়ায় সব জাতির নিকট এ মাস যেমন পবিত্র, তেমনি এর পবিত্রতা রক্ষার জন্য যত্নবান হওয়া উচিত প্রত্যেককেই। পবিত্রতা বা সম্মান রক্ষার অর্থ যার ওপর রোজা রাখা ফরজ তার রোজা রাখা, অধীনস্ত অন্যান্যের রোজা রাখানো। সব রকমের অন্যায়, অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনা, নোংরামী, চরিত্রবিধ্বংসী ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা ও অন্যান্যেরও বিরত রাখার চেষ্টা করা, রাস্তা-ঘাটে প্রকাশ্য দিবালোকে ধূমপানসহ সর্বপ্রকার পানাহার বন্ধ রাখা। ঝগড়া-ঝাটি, ফ্যাসাদ, কলহ-কোন্দল এড়িয়ে থাকা এবং তা যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। সব ব্যাপারে সংযমশীলতার পরিচয় দেয়া। কুরআন তিলাওয়াত, চরিত্র গঠনমূলক আলোচনা অনুষ্ঠান, ইবাদত-বন্দেগি ইত্যাদির মাধ্যমে মুত্তাকী হওয়ার জন্য সৎ ও ভালো হওয়ার সাধনায় ব্রতী হওয়াই এ মাসের দাবি। যত্নের সাথে দীর্ঘ একটি মাস যদি গোটা জাতি এই সাধনায় আত্মনিয়োগ করে তবে তার মনমানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব। রমজানের উদ্দেশ্য যাতে সফল হয়, এ জন্য সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা চালানো উচিত প্রতিটি লোকের। বিশেষ করে, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে পালন করা উচিত বিশেষ ভূমিকা। কারণ, আমাদের আর্থিক অভাব, অনটন আছে একথা সত্য, কিন্তু আজকে সবচেয়ে বড় অভাব হচ্ছে সততার, ন্যায়নিষ্ঠার, দায়িত্ববোধের, সৎ চরিত্রের, যার অভাবে একটা জাতি কখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। আমাদের জনগণ, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় সকলেই রমজানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এজন্য চেষ্টাও চালায়। কিন্তু একশ্রেণির অসৎ অতিলোভী ব্যবসায়ী, কিছু দায়িত্বহীন উচ্ছৃংখল, বখাটে যুবক এর পবিত্রতা বিনষ্টের জন্য যেন ইচ্ছাকৃতভাবেই তৎপর হয়। এ ধরনের হীন মানসিকতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের কথা অবশ্য আলাদা। লোভ তাদের পশুরও অধম করেছে। শকুন যেমন মড়া দেখলে খুশি হয়, তেমনি এরা মানুষের দুর্দশা দেখলে আনন্দিত হয়। একে মনে করে মুনাফা লোটার, স্ফীত হয়ে ওঠার একটা মোক্ষম মওকা। বানে, বন্যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অগণিত মানুষ যখন হাহাকার করে, তখন তারা মাল আটকে রেখে মওজুদারির মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করার ধান্ধায় থাকে। জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বাড়িয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় উঠে-পড়ে লেগে যায়। রমজানকেও এরা মোক্ষম সুযোগ মনে করে মানুষের রক্ত চোষার ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এদেরই কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম হু হু করে চড়ে যায়। চলে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। উপর দিয়ে ধার্মিকতার যতই ভড়ং দেখাক না কেন, এদের কাছে রমজানের আবেদন ব্যর্থ হয়ে যায়। আত্মশুদ্ধি বা কৃচ্ছতা নয়, লোভ-লালসাই বর্ধিত হয় এদের। আর চরিত্রহীন উচ্ছংখল যুবকেরা রমজানকে মনে করে মহাগজব। তাদের শয়তানি, বদমাইশি চালানোর সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ার ভয়ে তারা তৎপর হয়ে ওঠে। সমাজ ভালো হয়ে গেলে তাদের নষ্টামি আর নোংরামির অবারিত মওকা হারিয়ে যাবে। এ আতংকে তারা অস্থির হয়ে ওঠে রমজানের ডাক শুনেই।

রমজান মাস সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাস। রাসূলেপাক (সা.) একে আখ্যায়িত করেছেন শাহরুল মাওয়াছাত বা সমবেদনা ও সহমর্মিতার মাস বলে। গরিব-দুঃখী, দুস্থ, অনাথ, কাঙ্গালদের ব্যথা-কষ্ট দূর করার জন্য এ মাসে আরও অধিক যত্নবান হওয়া উচিত। কেবল ধনীরাই দান করবে, তা নয়। তারা তাদের মতো করবে, আমরাও পারি আমাদের মতো করতে। আমার ইফতারির জন্য ৫টা আইটেমের জায়গায় ৩টা আইটেম করে বাকি দুটো বা দুটোর পয়সা দিতে পারি আমাদের অভাবগ্রস্ত নিকট-প্রতিবেশীকে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, রাসূলে করিম (সা.)-এর সেই সাবধান বাণী, খোদার কসম, সে ব্যক্তি মোমেন নয়, যে পেট পুরে আহার করে আর তার প্রতিবেশী অনাহারী ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটায়। রাসূলে করিম (সা.) আরও বলেছেন, আর যদি না পারো তবে তোমাদের তরকারিতে একটু বেশি করে সুরওয়া বা ঝোল দিও এবং তা প্রতিবেশীকে পৌঁছিও। কত বাস্তব ও যুক্তিপূর্ণ একথা। আসলে লাখ টাকা দান করাই বড় কথা নয়, আমার যা আছে তা থেকে যতটা সম্ভব দেয়াই বড় কথা। এটা একটা মানসিকতা। আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ প্রতিবেশীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতাম, তবে সমাজে এ হাহাকার থাকতে পারতো না। নিজ বাড়ির আশপাশের ৪০ ঘর হচ্ছে প্রতিবেশী। প্রত্যেকেই যদি এ ৪০ ঘরের খোঁজ-খবর রাখে, সাধ্যানুযায়ী তাদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য সচেষ্ট হয়, তবে সমাজের অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। ধর্মপরায়ণতা প্রদর্শনীর ব্যাপার নয়, অন্তরের। তেমনি সওয়াব আড়ম্বরতার মধ্যে নেই, তা নিয়ত বা মননের মধ্যে। যিনি দোকানদার তিনি রোজাদারদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এই পবিত্র মাসের ফজিলতের প্রতি লক্ষ্য রেখে যদি যা ন্যায্যমূল্য তাই রাখে বা অন্য সময়ের তুলনায় একটু কম রাখে তবে অবশ্যই সে এর জন্য সওয়াব পাবে। এভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নিজ নিজ সাধ্যসীমার মধ্যে কিছু না কিছু অবশ্যই করতে পারে।

রমজান মাসে ভালো ভালো খাবার আর ভূরিভোজনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সারা দিন অনাহারে থাকার মাসুল সুদে-আসলে পুরিয়ে নেয়ার জন্য সেহরি ও ইফতারিতে অধিক আয়োজন ও খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলে। আসলে এতে রোজার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। এ মাস তো কৃচ্ছ্রতা সাধনের। সংযম সাধনার। রোজার মূল উদ্দেশ্য কামভাব ও প্রবৃত্তি দমন। কিন্তু অতিরিক্ত আহারের দ্বারা তা সফল হলো কোথায়? শেখ সাদী বলেছেন, পেট ও শরীর পূজারীরা অন্তর জ্ঞান ও সূক্ষ্মতন্ত্রের আলোক থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই অপচয় না করে বরং দৈনন্দিন রুটিন খাবার থেকে কিছু বাঁচিয়ে পাশের অনাহারী লোকদের মুখে যদি তা তুলে দেয়া যায় এর দ্বারাই রোজার মূল লক্ষ্য হাসিল করা সম্ভব। আল্লাহ পানাহার করেন না। নিদ্রা-তন্দ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি রাব্বুল আলামীন, মহান প্রতিপালক, রোজার মধ্যে দিয়ে তার এই গুণাবলী আত্মস্থ করার চেষ্টা চালানো হয়। তাই আজকে আমাদের প্রার্থনা, আমরা যেন রোজার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হই এবং রমজানের দাহনে সব পাপ-পংকিলতাকে ভস্মিভূত করে পবিত্র দেহ, মন ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা