ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

কুমিল্লার খাদি শিল্প

Daily Inqilab মিজানুর রহমান

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

উৎসব এলেই, বিশেষ করে পয়লা বৈশাখের মতো উৎসবে খাদি কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায়। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে মধ্য বয়সের সবার পছন্দের তালিকায় রয়েছে খাদি। পাঞ্জাবি ছাড়াও এখন খাদির শাড়ি, বিছানার চাদর, থ্রি-পিসও পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনের সুবিধায় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে খাদি। অফ হোয়াইট রংয়ের মোটা কাপড়, ১৬ আনা দেশীয় সুতায় তৈরি মানসম্মত এ পোশাক। একবার পরলে বার বার পরতে ইচ্ছে করবে। তীব্র তাপদাহে খুব আরামদায়ক, শীতেও সহনীয় পোশাকটি সুশীল সমাজেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এক সময় খাদির শাল রাজনৈতিক নেতাদের কাঁধে শোভা পেত। বেশ ভালোও লাগত। এখন তা ব্যবহারে এসেছে বৈচিত্র্য। ফতুয়া, শার্ট, থ্রি-পিস, শাড়ি, বিছানার চাদর ও লুঙ্গিতে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজাইনে পরিবর্তন এসেছে। দেশীয় নামীদামী ফ্যাশন শপে খাদি কাপড় আরও বৈচিত্র্য ও আকর্ষণীয় করে বাজারজাত করা হচ্ছে।

খাদি কাপড়ের ইতিহাস আমাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। এটি মাটি ও মানুষের দেশজ শিল্প হিসেবে বিবেচিত। দ্রুততার সাথে কাপড় তৈরির জন্য মাটির নিচে গর্ত করে পায়ে চালানো প্যাডেল দ্বারা দেশীয় সুতায় এ কাপড় তৈরি করা হয়। খাদে বা গর্তে বসে যে কাপড় তৈরি করা হতো সেটাই হচ্ছে খাদি। খাদ থেকে খাদি শব্দটি এসেছে। আবার অনেকে বলেন, খাদি বা খদ্দর শব্দটি গুজরাট থেকে এসেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে খাদি কাপড়ের প্রচলন অনেক আগে থেকেই। খাদির সাথে জড়িয়ে আছে ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলন ও বাঙালি ঐতিহ্য। শতবর্ষের ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হিসেবে পরিচিত খাদি বস্ত্র। অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লার খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য ডাক উঠে। সর্বত্র একই আওয়াজ ‘মোটা কাপড় মোটা ভাত’।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তৎকালীন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খাঁন কুমিল্লা খদ্দরের মানোন্নয়নে অম্বর চরকা ব্যবহারের মাধ্যমে দেশি উন্নত মানের সুতায় খদ্দর উৎপাদনের প্রচেষ্টা নেন। পরবর্তীতে ড. খাঁন এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খাঁন নুনের সহযোগিতায় ‘দ্য খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েসন লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৭ সালের দিকে ড. খাঁনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভারত থেকে তিনটি অম্বর চরকা ও একজন প্রশিক্ষিত কারিগর আনা হয়। অম্বর চরকা খাদি বস্ত্র উৎপাদনে ভালো ফল দেয়ায় একটি প্রকল্পের আওতায় সে সময় প্রায় ৪০০ অম্বর চরকা ভারত থেকে আমদানি করে খাদি সমিতিকে দেয়া হয়। চান্দিনা অঞ্চলে এই শিল্পের হাল ধরেন শৈলেন গুহ এবং তার ছেলে বিজয় গুহ। চান্দিনাতে এ শিল্পের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এ কাজের জন্য শৈলেন বাবুর খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কুমিল্লা অঞ্চলে শৈলেন গুহ খাদিবাবু নামে তখন পরিচিত। মূলত তার হাত ধরেই এ অঞ্চলে খাদি শিল্পের উত্থান ঘটে এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কুমিল্লার চান্দিনায় ঐতিহ্যবাহী খাদি বাঁচিয়ে রাখতে এবং এর উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লার খাদি শিল্প তার গুণগত মানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময় খাদি শিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বস্ত্র কলগুলো তখন বন্ধ। বস্ত্র চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভর দেশে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের উপর প্রচুর চাপ পড়ে। দেশের মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদির উৎপাদন ব্যাপক না হলেও চান্দিনা বাজারকে কেন্দ্র করে আশেপাশের গ্রামগুলোতে তাঁতীরা চাদর, পর্দার কাপড়, পরার কাপড় তৈরি করতে শুরু করেন। কুমিল্লার ময়নামতি চান্দিনা, গৌরীপুর, মুরাূনগর, কুমিল্লা সদরের বানাসুয়া গ্রামসহ বেশ কিছু এলাকায় খাদির কাপড় বুনার জন্য বিখ্যাত ছিল। ময়নামতিতে তখন রঙিন কাপড়ের লুঙ্গি ও শাড়ি তৈরি হতো।

যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও ইউরোপের কিছু দেশসহ প্রায় ১০টি দেশে কুমিল্লার খাদি কাপড় রপ্তানি হতো। এছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণে আসা পর্যটক ও কুমিল্লার প্রবাসীদের পছন্দ ছিল খাদি পোশাক। নব্বই দশকের পর থেকে রপ্তানি কমতে থাকে। খাদির পরিবর্তে অধিক লাভজনক তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাক্ষী কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড়ের দেশ-বিদেশে যে সমাদর ছিল তা ডিজিটাল যন্ত্রপাতির কাছে হার মেনে এরই মধ্যে বন্ধ হতে বসেছে। ক্রমেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন হাতে তৈরি খাদি কারখানার মালিকরা। আর জীবিকার তাগিদে পেশা পাল্টাচ্ছেন শ্রমিকরা। তারপরও প্রায় ১৫০০ পরিবার এ পেশায় জড়িত আছে। কুমিল্লা শহরেই শুধু খাদি কাপড় বিক্রি করে এমন দোকান প্রায় ৪০০টি আছে। প্রসিদ্ধ দোকানগুলো মধ্য অন্যতম হলো খাদি ঘর, খাদি বিতান, আদি খাদি বস্ত্রালয়, খাদি কুটির শিল্প এবং শুভেচ্ছা খাদি বিতান। খাদি ব্যবসা ও ঐতিহ্য টিকেয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা