ঢাকা   রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

পানির জন্য হাহাকার রূপ নিচ্ছে দুর্যোগে

Daily Inqilab শফিউল আলম

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৭ এএম

 গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচণ্ড গরম, খরা-অনাবৃষ্টির প্রবণতা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপদাহ প্রতি বছরের সমস্যা হয়ে জেঁকে বসছে। বলতে গেলে গ্রীষ্মকাল আসার আগেই চৈত্র মাস থেকে তাপদাহ চরমে পৌঁছে যাচ্ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের হার অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। তখন গরম হয়ে উঠে ভ্যাপসা, অসহনীয়। আবার শীতকালে শীতের কামড় থাকে অত্যধিক মাত্রায়। তবে শীতের ব্যাপ্তিকাল থাকে অল্প কিছুদিন। ভরা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে কম। বরং সেই তুলনায় বর্ষার আগে-পরেই ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হচ্ছে। তাতে আকস্মিক পানিবদ্ধতা, ঢল-বানের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটছে। ‘বসন্তকাল’ এবং শরৎকাল ও হেমন্তকাল সীমাবদ্ধ কেবল পঞ্জিকার পাতায়। আবহমান বাংলার এই তিনটি ঋতু এখন তেমন অনুভব করা যায় না।

আবহাওয়া-জলবায়ুর এহেন নেতিবাচক ধারায় পরিবর্তনশীল প্রবণতাকে ‘চরম-ভাবাপন্ন আচরণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটা আবহাওয়া-জলবায়ুর এক ধরনের খ্যাপাটে বৈশিষ্ট্য। আবহাওয়া-জলবায়ুর খেয়ালিপনা কিংবা খ্যাপাটেপনার কারণে বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন ও অপ্রতুল বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে করে মাটি ও মাটির তলদেশ পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। বিশেষ করে বৃষ্টির পানিতে পুনর্ভরণের (রিচার্জ) তুলনায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বা লেয়ার ক্রমাগত নিচের দিকেই নামছে, যা উদ্বেগজনক এবং একই সঙ্গে বিপজ্জনকও বটে। এই পরিস্থিতিতে পানির জন্য হাহাকার ক্রমাগত বাড়ছেই এবং তা আরো বৃদ্ধি পাবে। সুপেয় মিঠা পানিসহ নিত্য ব্যবহার্য, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই পানির জন্য শুধুই হাহাকার নয়; পানির সঙ্কটে নানামুখী জনদুর্ভোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

লবণাক্ততার গ্রাসে কৃষিজমি ও পানি
উচ্চ তাপদাহের কারণে উপকূল অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানির আগ্রাসন উজানের দিকে বিস্তৃত হয়েছে। এতে করে খাবার পানি লোনায় আক্রান্ত এবং ফল-ফসলি বিস্তর জমি লোনা কবলিত ও অনাবাদী হয়ে পড়ছে। গত দু’য়েক বছরেই সমুদ্রের লোনা পানি জোয়ারে হালদা নদী পর্যন্ত উঠে আসছে। লোনার কবলে দেশের একমাত্র মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র ‘বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ’ ঘোষিত হালদার রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশসহ বিভিন্ন জাতের বড় মাছের বিচরণ, প্রজনন ও উৎপাদনশীলতা হুমকির মুখে। হালদা পাড়ে কৃষি-খামার সঙ্কটাপন্ন। তাছাড়া হালদা নদীর পানি থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসার বড়সড় পানি উত্তোলন ও পরিশোধন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। লবণাক্ত হয়ে পড়েছে ওয়াসার পানি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানির সঙ্কট ফের বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশ লোনায় গ্রাস করে ফেলেছে। ফল-ফসল, জনস্বাস্থ্য হচ্ছে বিপর্যস্ত।

আবহাওয়া-জলবায়ু-প্রকৃতির এই চরম-ভাবাপন্নতার কারণ অনেকটা প্রাকৃতিক; আবার অনেকাংশে সেটা মানুষের সৃষ্ট। বলা চলে ‘মনুষ্য-আগ্রাসনের কালো হাত’! আবহাওয়া-জলবায়ু, পানিসম্পাদ ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান পানি সঙ্কটের মূলে রয়েছে প্রধান ৫৪টি অভিন্ন তথা আন্তর্জাতিক নদ-নদীসহ ছোট-বড় অনেকগুলো নদীর উৎসমুখে উজানে বাঁধ, ব্যারাজ, বিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প, জলাধার ইত্যাদি নির্মাণসহ নানাবিধ অপকৗশলে পানিসম্পদের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ আরোপ, যা মোদ্দা কথায় ভারতের নির্মম পানি আগ্রাসন। এ কারণে বাংলাদেশে পানির সঙ্কট ও হাহাকার অবস্থা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।

উজানে ভারতের পানি নিয়ন্ত্রণ ও আগ্রাসন

বৈরী আবহাওয়া কিংবা জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন ও বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে উজানের প্রতিবেশী দেশ ভারত বেপরোয়াভাবে পানি আগ্রাসনের মাধ্যমে পানির প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক স্বততঃ ধারায় প্রবাহকে আটকে দিচ্ছে। বিভিন্ন অপকৌশলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেই চলেছে। বাংলাদেশমুখী নদ-নদীমালা থেকে উজানে ভারত বেশিরভাগ পানির প্রবাহ একচ্ছত্রভাবে নিজের দিকেই প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভারতের বহুবিধ উপায়ে নদ-নদীমালা, উপনদীসমূহের ক্রমাগত পানি শুষে নেয়ার কারণে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পানির সঙ্কট ও হাহাকার অবস্থা প্রকৃতপক্ষে দুর্যোগে রূপ নেবে। এমন আশঙ্কা ও সতর্কবাণী ব্যক্ত করছেন আবহাওয়া-জলবায়ু, পরিবেশ-প্রকৃতি ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞগণ।

ভাটির দেশ বাংলাদেশ। হাজারেরও বেশি (নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যানুযায়ী নদ-নদীর সংখ্যা এক হাজার ৮টি) নদ-নদী, উপনদী ও শাখানদী বাংলাদেশের উপর দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এরজন্য বাংলাদেশকে বলা হয় ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’। তাছাড়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ এই দেশ। এক হাজার ৮টি নদ-নদীর মধ্যে প্রধান ৫৪টি অভিন্ন তথা আন্তর্জাতিক নদ-নদী। যেগুলো মূলত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। ‘ভাটির দেশ’, ‘ব-দ্বীপ’ এবং ‘নদীমাতৃক দেশ’ হিসেবে ভৌগোলিক ও ভূ-প্রকৃতিগতভাবেই লাভবান এবং নদ-নদীতে সুসমৃদ্ধ থাকার কথা বাংলাদেশের। অথচ, ভারতের একতরফা ও যথেচ্ছ অপকৌশলে পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত এবং স্বার্থহানির শিকার।

ভারত উজানের দেশ। আন্তর্জাতিক আইন-বিধি, নীতিমালা ও কনভেনশন অনুযায়ী ভারত ভাটির দেশের অভিমুখী অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানিকে আটকে রেখে অথবা বাঁধ-ব্যারাজ খুলে পানি ছেড়ে দিয়ে পানিসম্পদ একচ্ছত্র কব্জায় নিতে পারে না। অথচ, ভারত অব্যাহতভাবে এবং নির্বিকার থেকে তাই করছে। তিব্বত ও হিমালয় পর্বতমালার হিমবাহ কিংবা অৎস্র স্রোতধারা থেকে উৎপত্তি হয়ে মূলত চীন ও ভারত অতিক্রম করে ভাটির দেশ বাংলাদেশমুখী অভিন্ন বা আন্তর্জাতিক নদ-নদী, উপনদীতে বাঁধ, ব্যারাজ, পানিবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প, ক্যানেল, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, জলাধার (রিজার্ভার), গ্রোয়েন নির্মাণসহ আরও নানাবিধ উপায়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে যথেচ্ছভাবে ভারত নিয়ন্ত্রণ করেই চলেছে। এর মাধ্যমে ভারত একতরফাভাবে বাংলাদেশমুখী পানি প্রবাহকে আটকে দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। যা সোজা-সাপটা কথায় ভারতের পানি আগ্রাসন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন-বিধি-কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনটি অভিমত ব্যক্ত করে আসছেন পানিসম্পদ, ভূ-তত্ত্ব, পরিবেশ-প্রকৃতি বিশেষজ্ঞগণ।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের অভিমুখী নদ-নদী, উপনদীগুলোতে ভারত ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাঁধ, ব্যারাজ, পানিবিদ্যুৎ ও সেচ প্রকল্প, ক্যানেল, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, জলাধার (রিজার্ভার) ইত্যাদি অবাকাঠামো নির্মাণ করেছে। তাও স্থায়ীভাবে। ১৯৯১ সাল থেকে এ যাবত আরও কমপক্ষে ৭শ’ বা ৮শ’র মতো এই ধরনের পানি-প্রতিবন্ধক কাঠামো দিয়েছে ভারত। সব মিলিয়ে ৪ হাজারেরও বেশি পানি নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী কাঠামোর কাছে আটকে যাচ্ছে পানির স্বততঃ স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রবাহ। যার বেশিরভাগই ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন তথা আন্তর্জাতিক নদ-নদী, উপনদীগুলোতে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভিমুখী পানির প্রাকৃতিক স্রোতধারাকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। এর অনিবার্য পরিণতিতে পুরো শুষ্ক মৌসুমে এসব অভিন্ন নদ-নদী, উপনদী চুঁইয়ে চুঁইয়ে কিছু পানি ভাটির দিকে আসছে। তাতে নদ-নদীর প্রবাহ থাকে না; থাকে তলানি। থাকে ধু ধু বালুচর। মরা ও হাজামজা খালে পরিণত হয়েছে একেকটি নদ-নদী।

অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে ভারত নিজেকে বন্যামুক্ত রাখতে এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার কারণে উজানের ঢলে-বানে ডুবে মরছে বাংলাদেশের মানুষ। উজান থেকে হু হু করে আসা ঢলের তোড়ে নদ-নদীগুলো দু’কুল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দেয় গ্রাম-জনপদ, হাট-বাজার-গঞ্জ, মসজিদ-মক্তব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাজারো বসতবাড়ি। নদীর তীরে একের পর এক ভাঙনে ভয়ঙ্কর ও সর্বনাশা হয়ে উঠে নদ-নদীগুলো। নদীবক্ষে হারিয়ে যায় পাড়া-জনপদ, বসতভিটে। আর শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে হাহাকার অবস্থা। দ্রুত মরুময় অবস্থার দিকে যাচ্ছে দেশ। এককালের খরস্রোতা নদ-নদী, শাখানদীগুলো অস্তিত্ব হারিয়ে পরিণত হচ্ছে মরা গাঙে। দেশের কৃষি-খামার, ক্ষেত, বাগ-বাগিচা, বনজ সম্পদ, আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি, মৎস্যসম্পদ, জনস্বাস্থ্যসহ জনগণের জীবনধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে পড়ছে তার মারাত্মক বিরূপ প্রভাব। জীবন-জীবিকা হারিয়ে অসংখ্য মানুষ রাজধানী ঢাকা শহর ও অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে নদীতীরের অসংখ্য মানুষ হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। বলা যায় দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু। তারা দেশের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

আবহাওয়া-জলবায়ুর চরম-ভাবাপন্ন আচরণের পাশাপাশি ভারতের নির্মম পানি আগ্রাসনের ফলে দেশের প্রধান নদ-নদী, উপনদী, শাখানদীগুলো মরা খাল কিংবা মরা গাঙে রূপ নিয়েছে। কিছু কিছু নদীতে পানি থাকলেও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নদ-নদীর চারদিকে মরুভূমির মতো ধু ধু বালুচর। শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে যেন মরুর আগুনের হল্কা। বালুরাশিতে বিস্তীর্ণ নদ-নদীর বুক থাকে পরিপূর্ণ। এ সময়ে বাতাসের সঙ্গে নদীর আশপাশের গ্রাম-জনপদে ঘরবাড়িতে ধুলোবালিতে সয়লাব হতে দেখা যায়। এতে করে জনস্বাস্থ্য হচ্ছে বিপন্ন।

উজানে ভারতের পানি আটকে দেয়ার কারণে উজান থেকে আসা নদ-নদীর প্রবাহ ভাটিতে থমকে যাচ্ছে। এর ফলে শুধু অভিন্ন প্রধান নদ-নদীগুলোই নয়; এসব নদীর সঙ্গে যুক্ত শাখা-প্রশাখা, খাল-খাঁড়ি পর্যন্ত যাচ্ছে শুকিয়ে। বেশিরভাগ প্রধান নদ-নদী, শাখা নদীগুলোর পানি ভাটির দিকে যায় উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-মধ্যাঞ্চল দিয়ে মধ্যাঞ্চল তথা রাজধানী ঢাকার আশপাশ দিয়ে। মূল নদ-নদীগুলোতে পানি না থাকার কারণে ভাটির দিকে সবক’টি শাখা-প্রশাখা ও খাল শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পানিশূন্য হয়ে যায়। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুতই এবং আশঙ্কাজনকভাবে নিচের দিকে নামছে। রাজধানী ঢাকায়ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নামছে প্রতিবছর স্থানভেদে ৬ ফুট থেকে ২০ ফুট। ক্রমাগত মরুময়তার পথে ধাবিত হচ্ছে খরা কবলিত উত্তর জনপদ ও উত্তর-মধ্যাঞ্চল। রুক্ষ-রুদ্র হয়ে উঠেছে সেখানকার আবহাওয়া-প্রকৃতি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অভিন্ন তথা আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা প্রসঙ্গে খ্যাতনামা পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত অভিমত দিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টন সমস্যার ফয়সালা রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে।

এদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশের স্বার্থ কিংবা সমস্যা, অসুবিধা, আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদ-নদীর পানি ভাগাভাগির আইন-বিধি, কনভেনশন কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না ভারত। উজানে ভারতের নির্বিচারে পানি নিয়ন্ত্রণ ও আগ্রাসন এবং এর পাশাপাশি আবহাওয়া-জলবায়ুর চরম-ভাবাপন্নতা অর্থাৎ খ্যাপাটে আচরণের কারণে বিশেষত বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে দেশে পানির সঙ্কট বা হাহাকার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপরোক্ত দুইটি কারণ (ভারতের পানি আগ্রাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা ছাড়াও আরও অন্তত তিনটি কারণে দেশে পানির এই সঙ্কট ও হাহাকার অবস্থা বেড়েই চলেছে। এক. সুপেয় খাবার পানি, শিল্পাঞ্চলে ও ফল-ফসলি জমিতে কৃষিতে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানি বেপরোয়াভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে। অথচ, অপ্রতুল বৃষ্টি এবং নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে সেই তুলনায় ভূগর্ভস্থ পানির রিচার্জ (পুনর্ভরণ) হচ্ছে না। মাটির উপরের এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচের দিকে নেমে যাওয়ার পরিণামে ভূমিকম্প, ভূমিধসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুই. শহর-বন্দর-নগর-গঞ্জ, হাট-বাজার, গ্রাম-জনপদের সবখানে মাটির উপরিভাগে পানি ধারণের প্রচুর যে আধার (ওয়াটারবডি) যেমন- হ্রদ, জলাভূমি, খাল, ছরা, দীঘি, পুকুর, কূয়া ছিল সেগুলো বেশিরভাগ নির্বিচারে ভরাট তথা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ভূ-উপরিভাগের পানিসম্পদের সদ্ব্যবহার নেই; বরং অপচয় হচ্ছে। এবং তিন. বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিশাল অঞ্চলে কয়েক বছর ধরে আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ অবস্থা বিরাজ করছে। ‘এল নিনো’র প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের বুক থেকে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি উষ্ণ স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রভাবে এর ফলে উচ্চ তাপপ্রবাহের সঙ্গে বৃষ্টি-নিরোধক খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত এবং হঠাৎ মাঝারি থেকে ভারী সাময়িক বর্ষণ হচ্ছে। যা চরম ভাবাপন্ন ও বৈরী আবহাওয়ারই রূপ।

সারা দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাওয়ার সঙ্কট প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভিসি (বর্তমানে রুয়েট ভিসি) প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, বন-জঙ্গল ও পাহাড়-টিলা, উঁচুনিচু, উপকূলীয় ভূমি বৈচিত্র্যের গঠন বৈশিষ্ট্যকে সুরক্ষা করতে হবে। দেশের অনেক অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বা লেয়ার আশঙ্কাজনক হারে নিচের দিকে নামছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব। ভরা বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত হচ্ছে কম। অন্যান্য সময়ে ও হঠাৎ ভারী বা মাঝারি বর্ষণ হচ্ছে সীমিত কোন এলাকায়। তাছাড়া হ্রদ, জলাশয়, দীঘি, খাল-ছরা, পুকুর, কূয়া ইত্যাদি মিলিয়ে পানির ব্যাপক উৎসগুলো ছিল সেগুলো কালক্রমে মানুষ ভরাট, দখল ও ধ্বংস করে ফেলছে। এ কারণে বর্ষায় মাটির উপরিভাগে পানি ধারণ বা স্টক হচ্ছে খুবই কম। আবার ভূগর্ভস্থ পানি সারা বছর নির্বিচারে উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে পানির সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে।

এ অবস্থায় ভূ-উপরিভাগে ব্যাপকহারে জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণ করতে হবে। শহর-নগরে যেসব খাল-নালা-ছরা রয়েছে সেগুলোর ময়লা-আবর্জনা-পলিথিন, জঞ্জাল পরিস্কার করে সুপেয় পানি চলাচলের উপযোগী করে তুলতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচের দিকে নামলে ভূগর্ভের মাটিতে ফাঁকা বা গ্যাপ তৈরি হয়। এর ফলে মাটির উপরে-নিচের ভারসাম্যহানি হচ্ছে। যখন ভূমিকম্প কিংবা ভূমিধস হবে তখনই সেই গ্যাপের কারণে উপরের মাটি ধসে গিয়ে জনবসতিসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মিত হলেও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে মাটির নিচে ফাঁকা বা খালি জায়গা তৈরি হওয়ায় সেসব ভবন বা স্থাপনা তখন ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। এ অবস্থায় আমাদের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা জরুরি। বৃষ্টির পানিসহ মাটির উপরিভাগের সব ধরনের পানি বেশিহারে কাজে লাগাতে হবে। জলাধার, খাল-হ্রদ সৃষ্টির মাধ্যমে সেই পানির যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য সুষ্ঠু নীতিমালা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

২০২৩ সালকে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি ২০২৪ সালের গোড়া থেকেই এ যাবত বাংলাদেশ, এই উপমহাদেশসহ বিশে^র বেশিরভাগ দেশে তাপমাত্রা স্মরণকালের সীমারেখা অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশে গেল এপ্রিল মাসজুড়ে (চৈত্র-বৈশাখ) টানা উচ্চ তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। ৪৩ বছরের মধ্যে এটি ছিল দীর্ঘস্থায়ী খরা-অনাবৃষ্টির মাস। জাতিসংঘ, বিশ^ আবহাওয়া সংস্থা, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বৈশি^ক সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞমহল সতর্ক করছেন, উচ্চতাপ বা গরমের তীব্রতায় দেশে দেশে বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন। এতে করে মানুষের জীবন-জীবিকায় ব্যাঘাত ঘটছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ‘এল নিনো’র প্রভাবে উচ্চ তাপপ্রবাহ ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার উপ-মহাসচিব কো ব্যারেট বলেন, তাপদাহ ক্রমেই নীরব ঘাতকে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অনেক দেশই চলতি বছর রেকর্ড অতিক্রমকারী উচ্চ তাপপ্রবাহের কবলে পড়েছে। সবদেশেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে।

লেখক : উপ-সম্পাদক, দৈনিক ইককিলাব, ব্যুরো প্রধান চট্টগ্রাম।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

গোল উৎসবে নেশন্স কাপে উড়ন্ত সূচনা জার্মানির

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

জয়ে ইংল্যান্ডের সাউথগেট-পরবর্তী অধ্যায় শুরু

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

পোপের ১৫৪ রানের পরেও ইংল্যান্ডের ৩২৫,কামিন্দু-সিলভায় লংকানদের লড়াই

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

স্কটল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করলো অস্ট্রেলিয়া

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

মানিকগঞ্জে ইছামতী নদীতে থেকে মরদেহ উদ্ধার

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

‌'শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের কঠাগড়ায় দাঁড় করাতে হবে'

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

শেষ ম্যাচও জিততে চায় বাংলাদেশ

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় জামায়াতকে পাহারাদারের ভূমিকা পালন করতে হবে

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

আইওসির কোচিং কোর্সে বাংলাদেশের মাহফিজুল

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

নাটোরে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা সপ্তাহ শুরু

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

পটিয়ায় জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদ্ন্নুবী অনুষ্ঠিত

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

মীরসরাইয়ে কমছে পানি তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী চাঁদাবাজের ঠাঁই হবে না

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

নেমে গেছে বানের পানি স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষতচিহ্ন

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সভাপতি শওকত সম্পাদক মানিক

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

সংযোগ সড়ক ভেঙে দুর্ভোগে ৬ গ্রামবাসী

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়িভিটা হারিয়ে দিশেহারা তিস্তা পাড়ের মানুষ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

ভয়াবহ বন্যায় কৃষি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের সর্বনাশ

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা

মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার : একটি পর্যালোচনা