হিন্দুত্ববাদীদের জাতিবিদ্বেষ ও ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৪ এএম

প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের যুগে প্রায় প্রতিটি দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের সাথে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি এবং আন্তর্জাতিক পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এড়ানো প্রায় অসম্ভব। তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে রাজনৈতিক সংহতি, সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগনের অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতি নিরপেক্ষ ভূমিকা ও সুশাসনের মধ্য দিয়ে যে কোনো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও বড় পরাশক্তির প্রভাব এড়িয়ে দৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে এমন বেশ কিছু নজির রয়েছে। কিউবা,ভিয়েতনাম নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্নায়যুদ্ধের ইতিহাসের কথা বাদ দিলেও ইউনিপোলার বিশ্বের সাম্প্রতিক তিন দশকে সিরিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে পশ্চিমা বিশ্বের সব সামরিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অজেয় রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে সব রাজনৈতিক পক্ষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিরাপত্তা ও জাতীয় ঐক্য ছাড়া শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ শক্তির সামরিক-অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিকে পরাভুত করা সম্ভব নয়। প্রবল প্রতিপক্ষের আগ্রাসন মোকাবেলা করে ইরান ও আফগানিস্তানের টিকে থাকা ও যুদ্ধ জয়ের গল্পের সাথে রয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুপ্রেরণা, নির্দেশনা এবং জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব প্রধানত পশ্চিমা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর ইহুদি জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা বিশ্ব একটি ইসলামোফোবিক এজেন্ডা সামনে রেখে মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে একটি অন্তহীন যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছে। নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিও বুশের ‘ক্রুসেড’ তথা অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা থেকে গাজায় ইসরাইলী ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার চলমান নৃশংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রতিটি ঘটনার সাথে একই সাম্রাজ্যবাদী ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করছে। ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে শতকোটি মুসলমানের পাশাপাশি বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের পরও এক কোটির কম জনসংখ্যার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদি রাজনৈতিক লক্ষ্যকে টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা বিশ্ব একটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ যোগাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বের বিশাল সম্পদ ও জনগোষ্ঠিকে আস্থায় রাখার চেয়ে মাত্র কয়েক মিলিয়ন ইসরাইলীর আস্থা ও সমর্থনকেই বেশি ুগুরত্বপূর্ণ মনে করছে। সাম্রাজ্যবাদী ভূরাজনৈতিক নীলনকশা ও প্রোপাগান্ডার আওতায় মুসলিম বিশ্বে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি সৃষ্টির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী পক্ষকে নিজেদের কব্জায় রাখার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উপর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

চীন-রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে আঞ্চলিক কৌশলগত মিত্র হিসেবে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকাকে গুরুত্বে নিয়ে পশ্চিমারা যে প্রত্যাশা পোষণ করেছিল, তা ইতিমধ্যে অনেকটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ভারতকে দিয়ে কোনোভাবেই চীনের প্রভাব ঠেকানো যাচ্ছে না। ভারত তার কোনো প্রতিবেশীর আস্থা ও সমর্থন ধরে রাখতে না পারার নেপথ্যে রয়েছে তার সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি ও প্রতিবেশীদের প্রতি তার অনুদার ও আগ্রাসী নীতি। স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রতিশ্রুতি হিসেবে এর গণতান্ত্রিক ভাব মর্যাদা ও বহুত্ববাদী নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় ছিল। গণতান্ত্রিক ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘ প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন ও আস্থা অর্জনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। পশ্চিমা ও জায়নবাদীদের ইসলামোফোবিক এজেন্ডা ও প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করে ভারতের প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠির অশিক্ষা, অজ্ঞতা, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক অপবিশ্বাসকে উস্কে দিয়ে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে ক্ষমতার মসনদে তোলা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ভারতীয়দের কাছে মুসলমানদের বহিরাগত শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা ও গণতন্ত্রহীনতার মূল কারণ। হিন্দুত্ববাদের আধিপত্যবাদী নীতি ভারতকে তার প্রতিবেশীদের কাছে ক্রমেই আস্থাহীন ও অপাঙতেয় করে তুলেছে। পাকিস্তান কিংবা চীনের কথা বাদ দিলেও ভারতের বাইরে বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল একটি ল্যান্ডলক্ড দেশ, নানাভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। একই অবস্থা ক্ষুদ্র পার্বত্য দেশ ভূটান কিংবা ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের ক্ষেত্রেও। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির কারণে শ্রীলঙ্কা বহু আগেই চীনের দিকে ঝুঁকেছিল। একইভাবে নেপাল, ভূটান এবং মালদ্বীপও এখন চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী এসব দেশের উপর চীনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ভারতের চেয়ে বেশি। বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক রেখে কিংবা ভারতের প্রভাবাধীনে থেকে কোনো প্রতিবেশী দেশ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। অভিন্ন নদনদী, সমুদ্রসীমা, আন্ত:সীমান্ত বাণিজ্য, নিরাপত্তা কিংবা আঞ্চলিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রতিবেশিদের স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়না। ভারতীয় শাসকরা শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। ভারতের আধিপত্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে একটি টেক্সট বুক উদাহরণ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিয়ে এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আলামত এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার হরণের পেছনে ভারতীয় আধিপত্যবাদের দানবীয় প্রভাব দেশের জনগণ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। নির্বাচনের আগেও বিরোধীদলগুলো কোনো সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়নি। বিএনপি জনগণকে একতরফা নির্বাচনে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল। ভোট বর্জনকারী সবগুলো রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ভোট বর্জনের ডাক সমর্থন করে প্রচারণা চালিয়েছিল। বিরোধী পক্ষের কেউ কেউ বিএনপি এমন গান্ধীবাদী আন্দোলন নিয়ে উপহাস ও হতাশা প্রকাশ করলেও প্রায় নেতৃত্বশূণ্য পরিবর্তিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনী ও সরকারী দলের রাজনৈতিক ক্যাডারদের আগ্রাসী হুমকি মোকাবেলা করে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে রাজপথের আন্দোলনে সামিল করা কিংবা সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে ফায়দা লোটার অবস্থা বিরোধী দলের ছিলনা। নির্বাচনের আগের ২ মাসে কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করেম মহানগর, জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের হাজার হাজার সক্রিয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে এবং লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মামলার আসামি বানিয়ে দৌড়ের উপর রেখে একটি সুষ্ঠু- শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রয়াস চালানোর কথা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও স্বীকার করেছেন। এরপরও মাঠের রাজনীতিতে অনেক ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার নেতা কর্মীর সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ঘোষিত আন্দোলন শুরু থেকে শান্তিপূর্ণ ছিল। এমন একটি সমন্বিত প্রবল রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক শক্তির বিপক্ষে শুধুমাত্র ভোট বর্জনের আহ্বান এতটা ফলপ্রসু হতে পারে তা আগে কেউ ভাবতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোটার টার্নআউট ২৮ কিংবা ৪১ শতাংশ দেখানোর চেষ্টা করা হলেও দেশি-বিদেশি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ১০ শতাংশের বেশি নয়। এর মানে হচ্ছে, বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর ভোট বর্জনের ডাক দারুনভাবে সফল হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা যতই বেপরোয়া হোক, মানুষের নীরব প্রতিবাদের সম্মিলিত ভাষা অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুদুরপ্রসারি প্রভাব রাখতে সক্ষম। যদিও এ ধরণের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিই মূল কথা নয়। দেশি-বিদেশি সব পক্ষের আহ্বান ও দাবি-দাওয়া উপেক্ষা করে বিরোধীদলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীকে আটক করে, জেলে পাঠিয়ে কবরের নিরবতায় শান্তিপূর্ণ-সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশা একেবারেই অবাস্তব। সরকারীদলের প্রার্থী, ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে। ঢাকা মহানগরীতে ডিএমপি, মেয়র কাউন্সিলরদের সমন্বিত উদ্যোগের পরও ভোটার উপস্থিতি ছিল ১৪ শতাংশ। অতীতের যে কোনো প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটের হার ছিল ৩০ শতাংশের কম ছিলনা। এমনিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে দেশের সাধারন মানুষের কোনো আগ্রহ থাকে না। বিরোধীদলের ভোট বর্জনের ডাক দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের চেতনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছে। লাখো মানুষের সমাবেশ, হরতাল-অবরোধ কিংবা প্রতিরোধের পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি এড়িয়ে শুধুমাত্র বর্জনের ডাক সাধারণ মানুষের সমর্থন পেলে অনেক বেশি শক্তিশালী রূপে আবির্ভুত হতে পারে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সেই সত্যই মূর্ত হয়ে উঠেছে।

কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ অথবা সক্রিয় বর্জনের মধ্য দিয়ে বড় কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নিহিত থাকে। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্র যদি জনগণের স্বার্থ ও প্রত্যাশা উপেক্ষা করে বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠি বা রিজিমকে সমর্থন করে, তাহলে বঞ্চিত-নিপীড়িত জনগোষ্ঠির হাতে সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ বিকল্প থাকে সেই প্রবল প্রতিপক্ষকে বর্জন করা। প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা যতই নিরঙ্কুশ হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নীরব প্রতিবাদ কিংবা বর্জনের মধ্য দিয়ে তার প্রতিরোধ সম্ভব। দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বেতাঙ্গদের জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে স্থানীয় কালোদের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন সফল হয়ে নেলসন মেন্ডেলার বিজয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তারই ধারাবাহিকতায় চরম নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতির শিকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে জায়নবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বের মানবতাবাদী বিডিএস(বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট অ্যান্ড স্যাংশন) আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ইসরাইলী পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে এই আন্দেলনে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ৭৬ বছর ধরে চলা ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গত ৭ অক্টোবরে শুরু হওয়া হামাসের আল আকসা ফ্লাড অভিযানের পর বিডিএস আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করেছে। গাজায় নির্বিচার গণহত্যা ও যুদ্ধের এক মাসের মাথায় ম্যাকডোনাল্ডস, নেসলে, কোকাকোলাসহ ইসরাইলী মালিকানাধীন বেশকিছু শীর্ষ কর্পোরেশনের শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্যে ধস নামার খবর বেরিয়েছে। দুই বছর আগে ভারতীয় নেতাদের ইসলাম বিদ্বেষি বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বের মুসলমানরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিল। সুপারশপের শেল্ফ থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল। পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে সম্ভবত ভারতই একমাত্র দেশ, গাজা যুদ্ধের প্রথম দিনেই দৃঢ়ভাবে ইসরাইলের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছিল। ভারতের জাতীয় নীতি হচ্ছে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থন করা। কোনো একক দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলমান জনগোষ্ঠি ভারতে বসবাস করে। প্রায় ২৫কোটি ভারতীয় মুসলমানের সমর্থন ও আকাঙ্খাকে অগ্রাহ্য করে জায়নবাদী ইসরাইলের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সমর্থন করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রকৃত চেহারা আবারো বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। ইসরাইলী গণহত্যার সমর্থক ভারতকে পুরষ্কার হিসেবে ভারত থেকে লক্ষাধিক শ্রমিক নিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল। এমনকি ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করতে ভারত থেকে সেনা পাঠানোর কথাও শোনা গেছে। জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের গাঁটছড়া এভাবেই এখন একই সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছে। শান্তির সময়ে ইসরাইল সীমান্তে কাজ করতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের উপর আইডিএফ’র গুলি বর্ষণের ঘটনা খুব কমই ঘটে। কিন্তু ভারতের অন্যতম বড় পণ্য বাজার এবং রেমিটেন্স আয়ের দেশ বাংলাদেশিদের উপর বিএসএফ’র গুলি বর্ষণের ঘটনা নৈমিত্তিক ব্যাপার। গত সপ্তাহে একজন বিজিবি সদস্যকে গুলি করে হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই গত রবিবার পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে বাংলাদেশি যুবক রফিউল ইসলাম নিহত হয়েছে। এভাবেই ভারতীয়রা বাংলাদেশিদের উপর তাদের আধিপত্য জাহির করছে। বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা মুখে কুলুপ এঁেট ভারতের প্রশ্বস্তি বন্দনায় রত থাকলেও ক্ষোভে ফুসছে দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ। গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার হরণ, কর্মসংস্থান হরণ, সীমান্তে মানুষ হত্যা, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও জাতিবিদ্বেষের প্রতিবাদে মানুষ ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ ভারতকেই প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করছে। যদিও সরকার না চাইলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন সফল হওয়া কঠিন। আমদানির বিকল্প উৎস সরকারকেই খুঁজে বের করতে হয়। তবে জনগণ বর্জন করলে পণ্য আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সত্যিকার আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিনত হতে পারে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল পালিত

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল পালিত

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

রঙচটা বাস চলছেই

রঙচটা বাস চলছেই