তীব্র দাবদাহ : পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক জরুরি

Daily Inqilab ইনকিলাব

২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ এএম

তীব্র দাবদাহে পুড়ছে দেশ। এমন রোদ ও খরতাপ অতীতে কমই দেখা গেছে। বাতাস যেন আগুনের হলকা। দেশের প্রায় সর্বত্র মরুর উষ্ণতা। মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঘরের বাইরে বেরুচ্ছে না। যারা বেরুচ্ছে, প্রচণ্ড গরমে-ঘামে নাকাল হচ্ছে। মানুষের মতোই প্রাণীকূলের অবস্থা। গাছপালা-তৃণলতা ও ফল-ফসলের হালও অত্যন্ত করুণ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের অবস্থা অধিক শোচনীয়। চুয়াডাঙ্গা, যশোর প্রভৃতি এলাকার তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির ওপর। দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা প্রভৃতি এলাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপর। ঢাকা-গাজীপুরেও ৪০ ডিগ্রি। খবরে প্রকাশ, এপ্রিলে বৃষ্টির সম্ভবনা কম। কাজেই, খরা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে, ধরে নেয়া যায়। আগামী দিনগুলোতে জনজীবন, কৃষি, প্রাণি ও গাছ-পালার অবস্থা যে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, সেটা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ইতোমধ্যে সারাদেশ বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় খাবার পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে উপকূলীয় অধিবাসীদের। নলকূপ এমনকি গভীর নলকূপেও অনেক স্থানে পানি উঠছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে খাবার পানিসহ সেচের পানির অভাব প্রকট রূপ নিয়েছে। উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা প্রভৃতি জেলায় ধান ও অন্যান্য ফসল এবং বিশেষত আম-লিচুর অবস্থা মারাত্মক বিনষ্টির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। নদনদী আগেই শুকিয়ে গেছে। পানির অন্যান্য প্রাকৃতিক উৎসও শুষ্ককাষ্টে পরিণত হয়েছে। পানির দেশে পানির এই ভয়ংকর সংকটের জন্য উজানে ভারতের দেয়া ফারাক্কা-গজলডোবা প্রভৃতি বাঁধের প্রভাব সন্দেহতীতভাবে দায়ী। ভারত পদ্মা-তিস্তাসহ বিভিন্ন যৌথ নদীর পানি একতরফাভাবে এসব বাঁধের মাধ্যমে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ভারতের পানি রাজনীতি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা কিংবা অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে আমাদের ‘ভারত বন্ধু’ সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে।

বাংলাদেশকে পানি না দিয়ে শুকিয়ে এবং আটকানো পানি এক যোগে ছেড়ে দিয়ে ডুবিয়ে মারার ভারতীয় অপতৎপরতার পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও পানির সর্বব্যাপী সংকটের জন্য দায়ী। জলবায়ু-পরিবর্তনজনিত প্রতিক্রিয়া বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ তার সর্বশীর্ষে। বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের জনজীবন, ভূমি, প্রকৃতি, পরিবেশ ও উৎপাদন ব্যবস্থায় অবর্ণনীয় ক্ষতি হবে বলে বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই আশংকা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হিসাবে খ্যাত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঋতু বৈচিত্র্য আগের মতো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শীতকালে শীতের অভাব, বর্ষায় বৃষ্টির অভাব, অসময়ে খরা-বন্যা ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। এরকম আলামত দেশের জন্য মোটেই শুভকর বলে গণ্য হতে পারে না। খবর বেরিয়েছে, কাপ্তাই লেকের পানি অস্বাভাগিকভাবে কমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবল খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ এর মূলে। বলা বাহুল্য, কাপ্তাই লেকের পানি কমে যাওয়ার অর্থ কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন ব্যহত হওয়া। পানি বিদ্যুতের এই একমাত্র প্রকল্পটি অনেক দিন ধরেই হুমকিতে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ আবশ্যক, প্রচণ্ড তাপদাহের এই সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং কোথাও কোথাও ১২-১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত করা হচ্ছে। বিদ্যুতের অভাবে সেচ ব্যহত হচ্ছে। উৎপাদনে ধস নামার আশংকা করা হচ্ছে। এই গরমে মানুষ যে ফ্যান চালিয়ে একটু স্বস্তি পাবে, তারও উপায় নেই। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ যাওয়ার কারণে অনেক ছোট ছোট শিল্পকারখানা, পল্ট্রিখামার, মৎস্য খামার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। বিদ্যুতের ব্যাপক লোডশেডিংয়ের কারণে এসব কারখানা, খামার প্রভৃতির উদ্যোক্তারা এখন পথে বসার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, ভোলায় ও চাঁদপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে জ্বালানি সংকটই প্রধানত দায়ী। দেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাস চালিত, তেলেও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র চলে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তেল-গ্যাস বড় আকারে আমদানি করতে হয়। আর্থিক সংকট ও ডলারের অভাবে এই তেল-গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় কী! আমাদের জীবন ও কর্মের প্রায় সকল ক্ষেত্রই বিদ্যুৎনির্ভর। এমতাবস্থায়, শহরের কিছু লোকের জন্য বিদ্যুৎ দিলেই দায়িত্ব শেষ হবে না। গ্রামের বৃহত্তর জনগণের কী হবে? কৃষিসহ অর্থনীতির বৃদাংশের কী হবে?

খরা, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি, উৎপাদন ও অর্থনীতির হুমকি ইত্যাদি কোনো কিছুই এড়িয়ে যাওয়ার মতো না। একটার সঙ্গে অপরটির সম্পর্ক ওতপ্রোত। দাবদাহ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সাবধানে চলাফেরা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হিট স্ট্রোকে ইতোমধ্যে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধরাই এর শিকার হতে পারে বেশি। চিকিৎসাবিদরা এ অবস্থায় কী করতে হবে, কী করতে হবে না, তার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। ঈদের ছুটির পর আরো ৭ দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এসব অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু সার্বিক অবস্থা মোকাবিলায় মোটেই যথেষ্ট নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সামগ্রিক অবস্থার অনুপুংখ পর্যালোচনা ও যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মন্ত্রিসভার একটা বিশেষ বৈঠক হওয়া আগেই উচিত ছিল। তাদের মতে, বিলম্ব হলেও সময় শেষ হয়ে যায়নি। মানবিক পরিস্থিতিসহ অন্যান্য বিষয়ে সঠিক কার্যব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পানি ও বিদ্যুতের সংকট মোচন করে উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইনকিলাবের এক খবরে জানা গেছে, কৃষক ও মৎস্য জীবীদের নেয়া ঋণ অনাদায়ে সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এনিয়ে তারা নানামুখী হয়রানির শিকার হচ্ছে। ঋণ যেই নিক, তাকে তা পরিশোধ করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঋণগ্রহীতার বাস্তব অবস্থাও বিবেচনার দাবি রাখে বৈকি! কৃষক ও মৎস্যজীবীদের অনেকের বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। তেমন আয়-রোজগার নেই। হাতে টাকা নেই। এমতক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ঋণের দায়ে তাদের কোমরে দড়ি দেয়া তাই সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তাদের সময় দেয়া উচিত। তাদের উড়োতাড়া করলে, হয়রানি করলে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্রে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে , যা এ মুহূর্তে মোটেই কাম্য নয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

রঙচটা বাস চলছেই

রঙচটা বাস চলছেই