ইলিশের উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব

Daily Inqilab সেলিনা আক্তার

২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ দশমিক ২২ শতাংশ, যার বাজারমূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের অধিক। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু এ মাছ যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। ইলিশের স্বাভাবিক উৎপাদন বজায় রাখার লক্ষ্যে ডিমওয়ালা মা ইলিশ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা ইলিশ রক্ষা পেলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ১৭ আগস্ট ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ইলিশ শীর্ষক ভৌগোলিক নিবন্ধন সনদ (জিআই সনদ) প্রাপ্তিতে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ইলিশ এখন সমাদৃত। দেশের প্রায় ৭ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে এবং ২৫ লক্ষ লোক পরোক্ষভাবে ইলিশ আহরণ, বিক্রয় ও বিপণনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠন পরিকল্পনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে এ খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে নানা দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমার মাটি আছে, আমার সোনার বাংলা আছে, আমার পাট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি ডেভেলপ করতে পারি ইনশাল্লাহ, এই দিন আমাদের থাকবে না।’ বঙ্গবন্ধুর সূচিত পথ ধরে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে মৎস্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে-বিদেশে ইলিশের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। একক মৎস্য প্রজাতি হিসেবে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান সবচেয়ে বেশি । ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ রোল মডেল এবং পৃথিবীর প্রায় দুইÑ তৃতীয়াংশের অধিক ইলিশ আহরণকারী বাংলাদেশ ইলিশের দেশ হিসেবে খ্যাত। ৬.৭১ লক্ষ মেট্রিকটন ইলিশ মাছ আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে।

ইলিশ পছন্দ করে না, এমন বাঙালি দেশে ও বিদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইলিশ স্বাদে ও গুণে অতুলনীয়। সাগর ও নদী দুই জায়গাই ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র। বিগত বছরগুলোয় ইলিশ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল এবং এমন প্রেক্ষাপটে মা ইলিশ শিকারের ওপর অবরোধসহ সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। পদ্মা ও মেঘনা ইলিশের প্রধান বিচরণক্ষেত্র।দূষণের কারণে এ দু’ নদীর পানির গুণগত মান ক্রমেই অবনত হচ্ছে। সেই সঙ্গে কমছে ইলিশের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারের পরিমাণ। ইলিশ গবেষকরা বলছেন, এর ফলে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যেই নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে গেছে। ইলিশের বিচরণক্ষেত্রের পানির মান সরকারের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে আসছে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও-ডিসলভ অক্সিজেন), পিএইচ, পানি ও বায়ুর তাপ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। পদ্মায় গত পাঁচ বছরে ডিওর মান কমেছে। ২০১৮ সালে পদ্মার পানিতে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৭০ এবং এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছর কমছে। ২০২২ সালে ডিওর মান ছিল ৫ দশমিক ৪১। মেঘনায় ২০১৮ সালে ডিওর গড় মান ছিল ৮ দশমিক ৪০ এবং এটি ২০২২ সালে কমে ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ হয়েছে। নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাসায়নিক যৌগ হলো অ্যামোনিয়া। যে পানির মান ভালো, সেখানে এর উপস্থিতি শূন্য থাকে। পদ্মায় ২০১৮ সালে পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি ছিল শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। গত বছরও তা-ই ছিল। কিন্তু মেঘনায় পানিতে অ্যামোনিয়ার গড় উপস্থিতি শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ এবং এটি গত বছর শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে, অ্যাসিড ও ক্ষারের পরিমাপক হলো পিএইচ। জলজ প্রাণীর সহনীয় পরিবেশের ক্ষেত্রে পিএইচ সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮-এর মধ্যে থাকে কিন্তু কোনভাবেই ৭-এর নিচে নয়। পদ্মা নদীতে পিএইচের গড় উপস্থিতি ছিল ৮ এবং গত বছর এর পরিমাণ কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭। মেঘনায় ২০১৮ সালে পিএইচের উপস্থিতি ছিল ৮ দশমিক ১৩ এবং ২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে পদ্মায় পানির তাপমাত্রা প্রায় ২৫ থেকে বেড়ে ৩০ ডিগ্রি হয়েছে। এ সময় অবশ্য মেঘনায় পানির তাপ ২৭ দশমিক ৪০ থেকে কমে প্রায় ২৭ হয়েছে। জলজ প্রতিবেশে দূষণ যেকোনো মাছের জন্যই ক্ষতিকর। তবে ইলিশ অনেক বেশি সংবেদনশীল মাছ এবং দূষণের ফলে প্রতিবেশের সামান্য পরিবর্তন ইলিশ নিতে পারে না।

মা ইলিশ মূলত বছরে সাধারণত দু’বার ডিম দেয়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্র মাস থেকে মধ্য কার্তিক) ও জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি (মধ্য পৌষ থেকে মধ্য ফালগুন)। তবে দ্বিতীয় মৌসুমের তুলনায় প্রথম মৌসুমে প্রজনন হার বেশি। একটি মা ইলিশ প্রতি মৌসুমে একবারে সর্বোচ্চ ১ থেকে ২.৩ মিলিয়ন অর্থাৎ ১০ থেকে ২৩ লাখ ডিম দেয়। ইলিশ পোনা ৬-১০ সপ্তাহে ১২ সেমি থেকে ২০ সেমি পর্যন্ত বড়ো হয়। তখন এদের জাটকা বলে। একটি জাটকা মাছ পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হতে সময় লাগে ১ থেকে ২ বছর। তখন আয়তনে ৩২ সেমি থেকে ৬০ সেমি এবং ওজনে ১ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। জাটকা মা ইলিশের সাথে সমুদ্রে চলে যায়। সেখানে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিণত হয়ে আবার প্রজনন কালের নদীতে ফিরে আসে। দেশের সব নদ-নদী, মোহনা, উপকূলীয় এলাকায় ডিম ছাড়ে ইলিশ। মেঘনা নদীর ঢলচর, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীর চর ও কালির চর এলাকাকে ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র ধরা হয়, যার আয়তন প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর প্রধান আহরণ এলাকা হচ্ছে- মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল, তেঁতুলিয়া, কালাবদর বা আড়িয়াল খাঁ ধর্মগঞ্জ নয়াভাাঙানি, বিষখালি পায়রা, রূপসা, শিবসা, পশুর কচা, লতা, লোহাদিয়া, আন্ধারমানিকসহ অনেক মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চল। আমাদের দেশে প্রধানত তিন প্রকারের ইলিশ পাওয়া যা। ইলিশ, চন্দনা ইলিশ ও গুর্তা বা কানগুর্তা ইলিশ। টর্পেডা আকৃতির রূপালি রংয়ের মাছ পৃষ্টদেশ কিছুটা কালচে আভা। আরও চার প্রজাতির ইলিশ বাংলাদেশ উপকূলে পাওয়া যায়।

স্বাদে, ঘ্রাণে, রূপে অন্যান্য মাছকে পেছনে ফেলে ইলিশ বাঙালি সমাজে ‘মাছের রাজা’ হিসেবে সমাদৃত। শুধু যে রূপে গুণে বিষয়টা এমনও না, অন্যান্য মাছের পুষ্টিগুণের দিক থেকেও এগিয়ে আছে এই সমুদ্র থেকে আসা নদীর রাজা। ইলিশ মাছ রোগ প্রতিরোধেও সহায়ক। ইলিশ মাছ হার্ট সুস্থ রাখে, রক্ত সঞ্চালন ও বাত নিয়ন্ত্রণের সহায়ক, রাতকানা রোধে, ক্যান্সার মোকাবিলায়, হাঁপানি রোধে, অবসাদ দূর করতে, ত্বকের যত্নে, শিশুদের মস্তিষ্কের গঠন করতে সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশে আছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন। তাছাড়াও আছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, যা রক্তের কোলেস্টেরল ও ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, ফলে হার্ট সুস্থ থাকে। তাই হৃদরোগীদের জন্য ইলিশের তেল উপকারী। ইলিশ মাছে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম।

ইলিশের উৎপাদন ক্রমশ বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে ১৫ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ। ইলিশ সম্পদ বাড়লেও যদি এর মৌলিকত্ব ধরে রাখা না যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশে-বিদেশে ইলিশের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যাবে। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে অংশীজনের মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নিয়মিত সচেতসতামূলক সভা আহবান, ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। নদী দুষণরোধ এবং ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে সকলকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। (পিআইডি)


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

লোকসানে দিশেহারা খামারিরা

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

তাপদাহের সঙ্গে স্বল্প বৃষ্টি

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর কোনো অসম্মান একমুহূর্তও সহ্য করবো না

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল পালিত

সারাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিল পালিত

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

যারা আমাদের চাপে রাখতে চেয়েছিল, তারাই এখন চাপে :ওবায়দুল কাদের

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আরবিতে দক্ষতা অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন : সিপিডি

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

অস্বাভাবিক তাপমাত্রা আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

বৃষ্টি-পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত সিলেটের নিম্নাঞ্চল বন্যার আশঙ্কা

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

ভিয়েতনামে লাখ লাখ মাছের মৃত্যু

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

২৫ জেলায় স্কুল-কলেজ-মাদরাসা আজ বন্ধ থাকবে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

বাড়তি ভাড়ায় রেলভ্রমণ আজ থেকে

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত তুরস্কের

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

তুরস্ককে আন্তর্জাতিক গ্যাস বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত করার পথ প্রশস্ত

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

চাঁদের পথে পাকিস্তানের প্রথম স্যাটেলাইট মিশন

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

সম্রাট হুমায়ুন : উদারনীতির উদ্যান-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ফজরের নামাযের দশটি ফযীলত-২

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

ষাঁড় ঝাঁপিয়ে পড়ে দোকানে

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

নারী সংখ্যাধিক্যের দেশ

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

চুল রাঙিয়ে বিপাকে

রঙচটা বাস চলছেই

রঙচটা বাস চলছেই