ভারতের পানি আগ্রাসন

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৪ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৪ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম

ভারতের পানি আগ্রাসনের ভয়াবহ শিকার বাংলাদেশ। অথচ, সরকারি মহলের বয়ান অনুযায়ী, ভারতের চেয়ে বড় বন্ধু আর নেই। ভারত পানিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। বাংলাদেশের পণ্যবাজার ইতোমধ্যে কবজায় নিয়ে নিয়েছে। চাকরির বাজারও ক্রমান্বয়ে ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কাছে যা কিছু চাওয়ার ও পাওয়ার খায়েশ তার, গত দেড় দশকে তার প্রায় সবকিছুই সে হাসিল করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের সরকার ভারতকে দিয়েই খুশি, কিছু পাওয়ার যেন তার কোনোই প্রয়োজন নেই। গঙ্গার পানি নিয়ে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পায় না। এনিয়ে কোনো কথা নেই। তিস্তার পানি চুক্তি বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখলেও সরকারের কোনো বিকার নেই। ‘বন্ধুবচন’ অমৃত সমান। অথবা, না হয় মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেবো না, ভাবটা এরকমই। নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাঁধা। সেই নদীকেই কাজে লাগিয়ে ভারত বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিনাশী তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। দু’ দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীর সংখ্যা ৫০টির বেশি। এসব নদীতে ভারত বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে শুকনো মওসুমে ইচ্ছামতো পানি সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ন্যায্য ও প্রাপ্য পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীগুলো শুকনো মওসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলে মরু প্রক্রিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্তার বিস্তার ক্রমাগত বাড়ছে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন, প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর অপূরণীয় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এবার যে নজিরবিহীন অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড খরা হলো, বিশেষজ্ঞদের মতে, এজন্যে নদীর পানিশূন্যতা বহুলাংশে দায়ী। শুকনো মওসুমে পানি না দিয়ে যেমন ভারত বাংলাদেশকে মারে, তেমনি বর্ষা মওসুমে পানির সয়লাব বা বন্যা সৃষ্টি করেও বাংলাদেশকে মারে। অভিন্ন নদীর উজানে যেসব বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করেছে ভারত, বর্ষা মওসুমে সেগুলো একযোগে খুলে দিয়ে বিপুল পানি ঠেলে দেয় বাংলাদেশে। এতে দ্রুত বাংলাদেশ অস্বাভাবিক বন্যার কবলে পতিত হয়। ফসলাদি, ঘরবাড়ি ও সম্পদের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়। বন্যার সঙ্গে দেখা দেয় নদীভাঙন। নদী ভাঙনে অসংখ্য গ্রাম-জনপদ, শস্যক্ষেত্র, বৃক্ষ-বাগান নদীগর্ভ বিলীন হয়ে যায়। সীমান্ত নদীগুলোর ভাঙনে বাংলাদেশ এযাবৎ যে কত ভূমি হারিয়েছে, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। বাংলাদেশের হৃত ভূমি ভারতের দখলে চলে গেছে।

ভারতের পানি আগ্রাসন বাংলাদেশকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার বিবরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। এই প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য মতে, ছোট-বড় মিলে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি। এর মধ্যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীও অন্তর্ভুক্ত। পানির অধিকাংশের উৎস আন্তর্জাতিক নদীগুলো। এসব নদী উজান থেকে পানি বয়ে আনে এবং বাংলাদেশ হয়ে সাগরে পতিত হয়। অভ্যন্তরীণ নদীগুলো বৃষ্টি ছাড়া আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ওপর নির্ভরশীল। ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে এসব নদীর কয়েকশ’ ইতোমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বাকিগুলোরও অধিকাংশ যাওয়ার পথে। এভাবে নদী যদি ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়, বাংলাদেশে বাঁচবে কীভাবে? ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে বিভিন্ন সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, ভারত অভিন্ন নদীতে বাঁধ, ব্যারাজ, পানি বিদ্যুৎ ও সেচপ্রকল্প, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, জলাধার ইত্যাদি গড়ে তুলে নির্বিচারে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ ধরনের স্ট্রাকচার, কাঠামো বা স্থাপনার সংখ্যা ১৯৪৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার। আর ১৯৯০ থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে আরো ৭শ’। এত প্রতিবন্ধক নির্মাণের পর অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিসাবে বাংলাদেশে পাবে, কোনো বিবেচনাতেই তা ধারণা করা যায় না। নদী ছাড়া, পানি ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। অথচ, আমাদের সরকারের সেদিকে নজর নেই। সরকার বন্ধুত্বের জয়গানেই মশগুল ও তৃপ্ত। ভারতের পানি আগ্রাসন আস্তে আস্তে বাংলাদেশে যে সবকিছু হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে যেন তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, অভিন্ন নদীতে উজানের দেশ ভাটির দেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো বাঁধ, ব্যারাজ বা প্রতিবন্ধক নির্মাণ করতে পারে না। নির্মাণ করতে চাইলে ভাটির দেশের অনুমোদন অপরিহার্য পূর্বশর্ত। কোনো কাঠামো বা প্রকল্প নেয়ার আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করেছে, অনুমোদন নিয়েছে, এমন প্রমাণ নেই। ফলে ভারত যা কিছুই করেছে, আইন লংঘন করেই করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার এনিয়ে অভিযোগ জানানো বা বিচার চাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সরকার এ পথে কেন হাঁটছে না, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

বিকল্প ব্যবস্থা নিতে সরকারের গড়িমসি ভাব লক্ষনীয়। ফারাক্কা বাঁধের প্রতিপক্ষে বাংলাদেশে অনুরূপ বাঁধ নির্মাণের কথা অনেক আগে থেকে শোনা যাচ্ছে। সেই এন্টি ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ কোনো সরকারের তরফেই নেয়া হয়নি। ভারতের গজলডোবা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তা মোকাবিলায় চীন যে তিস্তা প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছে, সরকার তাতে সমুচিত সাড়া দিচ্ছে না। ভারতের নারাজি বা বাধাই এর কারণ বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। অথচ এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চল বেঁচে যাবে। তার অর্থনীতিতে ও জীবনযাত্রায় নবযুগের সূচনা হবে। কদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তার সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কী কথাবার্তা হয়েছে, তার বিস্তারিত জানা যায়নি। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ভারত তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী। চীন এ প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য আগেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এমতাবস্থায় ভারতের প্রস্তাব কেন? প্রকল্প বাস্তবায়নে ঝগড়া লাগানোই কি এর উদ্দেশ্য? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ভারতের ফাঁদে পা দেয়া কোনোভাবে ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাবেন শিগগিরই। ওই সফরের সময় বাংলাদেশের জীবন-মরণের পানি সমস্যা, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্যে অসমতা দূর ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হবে বলে আমরা আশা করি। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সঙ্গে সার্বভৌম সমতাভিত্তিক ও সৎ প্রতিবেশীসূলভ সম্পর্ক চায়। তার দাদাগিরি ও আগ্রাসী আচরণের কারণে বাংলাদেশের মানুষ যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। ভারতের পণ্য বর্জনের আন্দোলন তার অন্যতম প্রকাশ। ভারতের নীতি নির্ধারকদের এই বাস্তবতা উপলদ্ধি করতে হবে। আর আমাদের সরকারের সর্বপ্রকার নতজানুতা পরিহার করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

বেতাগী দরবারে ওরশ আজ

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন

চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন