ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ বদলে দিতে পারে বিশ্বরাজনীতি

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১৭ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১৭ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম

যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে গণতন্ত্র সূচকের উন্নয়ন ও অবনমন নিয়ে জরিপ প্রকাশ করে থাকে। সরকারের কার্যকারিতা, রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরিবেশ এবং জনগণের বাকস্বাধীনতার উপর ভিত্তি করে ১৬৭টি দেশের ওপর এ জরিপ করা হয়। মোট ১০ নম্বরের মধ্যে যে দেশ ৮.০১ থেকে ১০ পায়, সে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, ৬.০১ থেকে ৮.০১ পেলে তাকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র বলা হয়। ৬.০১ এর নিচে পেলে গণতন্ত্র নেই বল ধরা হয়। জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে গণ্য যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছে ৭.৯২। এ স্কোর প্রমাণ করে দেশটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে। তালিকায় তার অবস্থান ২৯। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে জাহির করা ভারতের স্কোর ৭.১৮ এবং অবস্থান ৪১। বাংলাদেশ ৫.৮৭ নম্বর নিয়ে ৭৫-এ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন অবস্থায় আছে, তা বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। গণতন্ত্রের সূচক তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মনে করে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের গণহত্যা বন্ধে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও প্রতিবাদ যেভাবে দমন করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে, গ্রেফতার-নির্যাতন করছে, তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণের মধ্যে পড়ে না। কারণ, গণতন্ত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের এই মতপ্রকাশে বাধা প্রদান করা হয়েছে। দেশটি যেভাবে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে গণহত্যাকে সমর্থন করছে, এ নীতি তারই তরুণ প্রজন্ম মেনে নিতে পারছে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রকে এ নীতি থেকে সরে আসার জন্যই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে।

দুই.
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদে গত ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু করে। সেখানে তারা অবস্থান নেয়। এমনকি তাবু গেঁড়ে রাত্রিযাপন করে। পুলিশ শুরুতে তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেও তারা যায়নি। পরবর্তীতে পুলিশ কঠোর অবস্থান নিয়ে শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে। এতে শিক্ষার্থীরা আরও সংগঠিত হয়ে শক্ত অবস্থান নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট গত ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ৫৫৩টি বিক্ষোভ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ৯৭ শতাংশ বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ২ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম দিয়ে বলেছে, নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে না গেলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে। অনেককে বহিষ্কারও করেছে। এতেও শিক্ষার্থীরা দমে যায়নি। তারা হুমকি উপেক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে। ইয়েল, ক্যান্টাকি, কানেক্টিকাট, হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, ব্রাউন, নর্থওয়েস্টার্ন, টেক্সাস অ্যাট অস্টিন, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, জর্জ ওয়াশিংটন, ভার্জিনিয়া টেক, ডিপল, নর্থ ক্যারোলিনাসহ অন্যান্য খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করছে। ইরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা দাবানলের মতো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের ১২টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার প্রতিবাদ করছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, স্পেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ দমাতে গ্রেফতার-নির্যাতন চালাচ্ছে। শত শত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে। তারপরও তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। মানবতা, ন্যায়বিচার, সমতা নিশ্চিত করার জন্য তারা মার খাচ্ছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে। এ যেন তরুণ-তুর্কিদের বিবেকের এক অদম্য স্ফূরণ। তারা কোনো হত্যাযজ্ঞ চায় না। তারা বিশ্বে সকল নাগরিকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতে লড়াই করছে। তাদের এই প্রতিবাদ, যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের তথাকথিত সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্বরাজনীতির ভিত্তিতে আঘাত করেছে। এর ফলে বদলে যেতে পারে বিশ্বরাজনীতির গতিপথ। গত ৮ মে লন্ডনের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ কিংস কলেজের সামনে তাঁবু টানিয়ে কয়েকশ’ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে। ‘গাজায় গণহত্যা থামাও, ইসলাইলকে সহযোগিতা বন্ধ করো’, এমন শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ও ফিলিস্তিনের পতাকা শিক্ষার্থীদের হাতে দেখা যায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বেশকিছু দাবি উত্থাপন করে। এর মধ্যে রয়েছে, ইসরাইলকে সব ধরনের অর্থায়ন বন্ধ, বিনিয়োগ নীতি সংস্কার, ইসরাইলকে বর্জন ও গাজায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুননির্মাণ ইত্যাদি। অক্সফোর্ড অ্যাকশন ফর ফিলিস্তিন ও ক্যামব্রিজ ফর ফিলিস্তিন এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরাইল সরকারকে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন দেয়া বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ফিলিস্তিনিদের জীবনের বিনিময়ে মুনাফা করতে পারে না অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ। ইসরাইলের অপরাধ আড়াল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমর্যাদা গড়ে উঠতে পারে না। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ইউরোপের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে আয়ারল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজ, ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া স্পেনের ৭৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে গঠিত পরিচালনা পর্ষদ গত ৯ মে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবছে। সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান বিক্ষোভকে সমর্থন দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি পশ্চিমাবিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের সমর্থন এবং পাশে দাঁড়ানোর ঘটনা নজিরবিহীন। যুগের পর যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং সমর্থন নিয়ে ফিলিস্তিনে ইসরাইল হত্যাযজ্ঞ চালালেও এবার দেশগুলোর তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। এখানে কে মুসলমান, কে ইহুদি তা তারা বিবেচনায় না নিয়ে ইসরাইলের বর্বর আচরণ, গণহত্যা ও নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়া তাদেরকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তারা চুপ থাকতে পারেনি। আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিবাদে নেমে পড়েছে। দেশগুলোর সরকার তাদের তরুণ প্রজন্মের এই পাল্স বুঝতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। তারা মনে করেছে, তোমাদের নিরাপত্তা ও আয়েশী জীবন আমরা নিশ্চিত করেছি। বাইরে কি করছি, তা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করার দরকার নেই। তাদের এই চিন্তাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে শিক্ষার্থীরা বিবেকের তাড়নায় মানবতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই মানবিক আচরণ দেশগুলোর সরকারকে নিশ্চিতভাবেই বেকায়দায় ফেলেছে, তাদের সা¤্রাজ্যবাদী নীতিকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছে। এর প্রভাব তাদের বিশ্বরাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে। নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্র নিজে নাইন-ইলেভেন ঘটিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ‘ওয়ার অন টেরোরিজম’ শুরু করেছিল এবং বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচিত করা এবং মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস চালিয়েছিল, তা পশ্চিমা বিশ্বের জনগণকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছিল। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার মতো সমৃদ্ধ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ধ্বংস করে দিলেও তাদের জনগণের মধ্যে তেমন কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। বরং তাদের মধ্যে ‘ইসলামোফোবিয়া’ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে যখন ইসরাইলের মতো সন্ত্রাসী রাষ্ট্র গাজায় নিরীহ, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা শুরু করে, তখন দেশগুলোর তরুণ প্রজন্ম চুপ থাকতে পারেনি। তাদের মানবিক চেতনা ও বিবেককে মনের কুঠোরিতে বন্দি করে রাখতে পারেনি। ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনির আত্মা যেন তাদের জাগিয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা জুগিয়েছে। তাদের এই প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ইসরাইল যেমন গণহত্যাকারি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তেমনি তাদের সরকারের মানববিধ্বংসী ভুল নীতি চিহ্নিত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম যখন নিজেদের আরাম-আয়েশ ও শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা নিয়ে বর্বর ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদ ও অসহায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠেছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছে। অথচ উচিৎ ছিল, ইসরাইলের এই গণহত্যার প্রতিবাদে সবার আগে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী ও ধনী মুসলমান দেশগুলোর ফুঁসে উঠা। দেশগুলোর তরুণ প্রজন্মকে তারা যেন ঘুম পাড়িয়ে ও চেতনাকে অবশ করে রেখেছে। মুসলমান হিসেবে, এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

তিন.
বিশ্বের যত যুদ্ধবিগ্রহ এবং মানবতাবিরোধী কর্মকা- ঘটছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধ না বাঁধালে তার মোড়লগিরি যেন থাকবে না। ফলে তাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে ‘অন্তহীন যুদ্ধনীতি’ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। তবে এ নীতি যে, সব সময় কাজ করে না, তা এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘ওয়ার অন টেরোরিজম’ চালিয়ে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা চূড়ান্তভাবে মার খেয়েছে। আফগানিস্তানে বিশ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে হয়েছে। ইরাক থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নিতে হচ্ছে। সিরিয়া, লিবিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ চালালেও দেশগুলোর মুসলমানরা পশ্চিমাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশগুলো আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তাকে ‘ওয়ার অন টেরোরিজম’ থেকে সরে আসতে হয়েছে। কারণ, তার প্রণীত মুসলমানবিদ্বেষ বিশ্ব এখন খাচ্ছে না। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আগের মতো ‘আনচ্যালেঞ্জড’ যাচ্ছে না কোনো কিছু। সে যেখানে যুদ্ধ বা হস্তক্ষেপ করছে, সেখানে চীন, রাশিয়া, তুরস্কসহ অন্যান্য বৃহৎ দেশ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তার একক আধিপত্য খর্ব হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বিশ্ব এখন ‘ইউনিপোলার’ রাজনীতির দিকে ধাবিত। এখন আর কারো একক আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ নেই। যে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ, সেই ফিলিস্তিনকেই এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পরিকল্পনা করছে। আগামী ২১ মে ফিলিস্তিনকে ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, স্লোভেনিয়া ও মাল্টা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক জোসেফ বোরেল বলেছেন, তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলে বেলজিয়ামসহ অন্যদেশগুলোও সমর্থন দেবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই স্বীকৃতি নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের একধরনের পরাজয় এবং ইসরাইলের গালে চপেটাঘাত। যুক্তরাষ্ট্র এখন শুধু বাইরে তার ইসরাইল প্রীতি ও নীতির বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে না, ঘরেও বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইরাইলবিরোধী বিক্ষোভ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তরুণ প্রজন্ম তার ‘অন্তহীন যুদ্ধনীতি’ সমর্থন করছে না। এর অর্থ হচ্ছে, ঘরে-বাইরে যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তি হারাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তরুণদের এই বিরোধিতা ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ মনে হলেও বাস্তবতা উপেক্ষা করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ প্রজন্মের যে বোধের জন্ম হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মার্কিন তরুণরা মনে করছে, যুদ্ধবাজ নেতৃত্বের হাতে শুধু তারা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রান্তিক সব মানুষের ভবিষ্যৎ জিম্মি হয়ে রয়েছে। বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সম্পদ রয়েছে। এ সম্পদ কাজে লাগানোর পরিবর্তে ব্যয় করা হচ্ছে অন্তহীন যুদ্ধ, ব্যক্তিগত ক্ষমতা ও লাভের জন্য। ক্ষমতাসীনরা মনে করছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া দরকার। অথচ এসবই করা হচ্ছে, মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের সাথে জড়িত মুষ্টিমেয় ব্যক্তির জন্য, যেখানে দেশটির সাধারণ মানুষের কোনো অংশ নেই।

চার.
নিবন্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণুতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এ বছরের ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সে নির্বাচনের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি ‘একনায়ক’ হতে চান। একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর এ কথা বলার অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ‘কবর’ রচিত হওয়া। এমনিতেই দেশটির তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এটা তরুণ প্রজন্ম মানতে পারছে না। তারা এর প্রতিবাদ করতে মাঠে নেমেছে। এর সূচনা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের গণহত্যা এবং তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ সহযোগিতা ও সমর্থনের বিরোধিতার মাধ্যমে। তারা মনে করছে, যে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুরো নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে তাদের কোনো স্থান নেই। তাদের কণ্ঠস্বরেরও কোনো মূল্য নেই। মার্কিন প্রশাসন যে অন্তহীন যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেছে, সে রিপাবলিকান বা ডেমোক্রেটিক যেই হোক, তাতে তাদের আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই। ফলে তারা নিজেরাই এখন নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্মের এই বোধোদয় এবং বিক্ষোভকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের দেশটির আভ্যন্তরীণ নীতি ও বিশ্বনীতির ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ, ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। এতদিন তাদের তথাকথিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নামক ‘আফিম’ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও এখন তারা জেগে উঠেছে। তারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতির বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্মই নয়, তার মিত্র দেশগুলোর তরুণ প্রজন্মও জেগে উঠেছে। তাদের সরকারের একতরফা ও মানবতাবিরোধী নীতির বিরোধিতা করছে। এতে সরকারগুলোকেও বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ, তরুণরা যেভাবে জেগেছে, তা কিছুদিন পর থেমে যাবে কিংবা তাদের এই মনোভাব ও উপলব্ধি হাওয়ায় ভেসে যাবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার