ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

গাজায় পথ হারিয়েছে মানবিক বিশ্ব

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

২২ মে ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ১২:০৭ এএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব বাহ্যিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বহুত্ববাদী বা মাল্টিকালচারাল সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করলেও মধ্যপ্রাচ্য ফিলিস্তিনের প্রশ্নে তারা ভিন্ন ভূমিকা পালন করে চলেছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ নাগরিকদের সাথে শাসকদের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। গাজায় ইসরাইলের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রবল প্রতিবাদী ভূমিকাই বলে দেয়, তারা তাদের সরকারগুলোর নীতির সাথে একমত নয়। তারা তা সমর্থনও করছে না। এসব সরকার দশকের পর দশক ধরে বিশ্বের এক নম্বর বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের নিবর্তনমূলক নীতির প্রকাশ্য সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি, ইউরোপের দেশে দেশে সীমাহীন ধ্বংসযজ্ঞ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমানবিক বোমায় জাপানের হিরোশিমা নাগসাকি শহরের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষসহ ধ্বংসস্তুপে পরিনত হওয়ার ভয়াল পরিনতি দেখে বিশ্ব সম্প্রদায় আঁৎকে উঠেছিল। যুদ্ধের বিভীষিকাময় আতঙ্ক, সভ্যতার পুনর্গঠন, আন্তজাতিক নিরাপত্তা ও জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতেই লীগ নেশনস ইউনাটেড নেশনস বা বর্তমান জাতিসংঘের কাঠামোতে রূপান্তরিত করা হয়। পারমানবিক যুদ্ধাস্ত্রের অধিকারি হয়ে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মশারবরদার হয়ে নব গঠিত জাতিসংঘের নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের পুরোভাগ নিশ্চিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ গৃহিত হওয়ার তিন বছরের মাথায় জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনের আরবদের পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত, উচ্ছেদ ও গণহত্যা সংঘটিত করে বিশ্বে প্রথম একটি অন্যায়-অন্যায্য রাষ্ট্র কায়েমের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর, খামার, স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও বানিজ্যকেন্দ্রগুলো বুলডোজারে গুড়িয়ে দিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। হাজার বছর ধরে শান্তিতে বসবাসরত ফিলিস্তিনি আরবদের কাছে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে দিনটি ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেদিন জায়নবাদী হাগানা মিলিশিয়াদের বর্বর গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে আসা ফিলিস্তিনি মুসলমানরা ৭৬ বছর পেরিয়ে এসে আজও উদ্বাস্তু। সাত দশকেও জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায় ফিলিস্তিন সংকটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান নিশ্চিত করতে পারেনি। ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তু আরবরা একদিনের জন্যও তাদের ফেলে আসা গ্রাম বসতভিটায় ফিরে যাওয়ার দাবি ও স্বপ্ন পরিত্যাগ করেনি। ফিলিস্তিনি জনগণের ফেলে আসা ঘরের চাবি তাদের সেখানে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন ও আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিক হয়ে আছে। একচেটিয়া পুঁিজবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গত সাড়ে ৭ দশকে মাল্টিকালচারালিজমের ধ্বজাধারি পশ্চিমারা মূলত একটি জায়নবাদী হেজিমনিক এজেন্ডার ক্রীড়নকে পরিনত হয়েছে। সেই নাতবা থেকে আজকের গাজা গণহত্যা পর্যন্ত তারা অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার যাবতীয় জায়নবাদী কর্মযজ্ঞে পৃষ্ঠপোষন, অংশগ্রহণ ও সমর্থন দিয়ে চলেছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবরে হামাসের আল কাসসাম বিওগেডের অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’র জবাবে জায়নবাদী ইসরাইলী ডিফেন্স ফোর্স গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যায় মেতে উঠেছে। গণহত্যার ভয় দেখিয়ে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে জমি দখলের পুরনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা বিশ্ব সভ্যতার সব রীতি নীতি, বিশ্বসম্প্রদায়ের আহ্বান, দাবি ও বিক্ষোভ উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধের সকল মাত্রা লঙ্ঘন করে চলেছে। মে মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসের যুদ্ধে ইসরাইল প্রায় ৩৬ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু ও নারী। মির্মম হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির বাইরে তাদের কোনো সামরিক-রাজনৈতিক অর্জন নেই। হামাসকে নিমূর্ল করার ধর্ন্ভুঙ্গ পণ এখন অসারের গর্জন বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ গাজায় হামাসের হাতে শক্ত মার রখয়ে, মারকাভা ট্যাঙ্ক, সাজোয়া বহর এবং শত শত সৈন্য হারিয়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে জায়নবাদীরা। ধ্বংসস্তুপ থেকে বেঁচে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের একটি বড় অংশ মিশর সীমান্তবর্তী রাফা শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। এটাই ছিল তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। এখানে অভিযান চালানো হলে তা বড় ধরণের গণহত্যা বা ফিলিস্তিনি নির্মূলিকরণ হিসেবে গণ্য হওয়ার আশঙ্কা করেছেন বিশ্ব সংস্থা ও নেতারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাস যখন যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল, তখনই ইসরাইল যুদ্ধবিরতির আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে রাফায় গণহত্যা শুরু করেছে। শুরু থেকেই ইসরাইল হামাসের আল কাসসাম ব্রিগেডের রণকৌশল ও সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাফায় ইসরাইলী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে খাদ্য, ওষুধসহ জরুরি পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেখানে দুর্ভিক্ষাবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। ইসরাইলিরা বিমান হামলা করে, কামানের গোলা-মর্টারশেল দিয়ে, স্নাইপার দিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যার পাশাপাশি খাদ্য, পানি, ওষুধপত্র, চিকিৎসাব্যবস্থা ধ্বংস করে একসাথে লাখ লাখ মানুষকে মনন্তরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে হত্যা করার মারণ নেশায় মেতে উঠেছে। ওদিকে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে রনতানিয়াহু সরকারের যুদ্ধাপরাধ মামলা ক্রমেই একটি সুস্পষ্ট প্রসিকিউশনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে নেতানিয়াহুর সরকার গ্রেফতারি পরোয়ানার আশঙ্কায় আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছে। হামাস-হিজবুল্লাহ, হুতি, ইসলামিক জিহাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে গাজা যুদ্ধের পরাজয়ের ধারা তেল আবিবের রাজপথ থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিল এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সব শহর, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ওয়াশিংটন ডিসির মার্কিন ক্যাপিটলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে হাজার হাজার ইহুদির প্রতিবাদ বিক্ষোভ থেকে শত শত মানুষ গ্রেফতার হওয়া এবং প্রতিবাদ দাবানলের মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বজনমত স্পষ্টতই ইসরাইলের বিপক্ষে চলে গেছে। এটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। এ সপ্তাহে ৭৬তম নাকবা দিবস উপলক্ষে আবারো মার্কিন ক্যাপিটল ইসরাইল বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সেখানে শত শত ইহুদিও অংশগ্রহণ করে। ‘চুরি করা জমিতে শান্তি নেই, গণহত্যা বন্ধ কর, যুদ্ধাপরাধ বন্ধ কর, ইসরাইলকে ফিলিস্তিন থেকে বের করে দাও’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে রাজপথ কাঁপিয়েছিল।

জায়নবাদী ইসরাইল আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সাথে বেমানান। তারা বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেনা। তারা পথ হারানো পৌরাণিক প্রমিজড ল্যান্ডের ইউটোপিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিবেশি আরবদের উপর গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিং চালাতে চায়। দেড় যুগ ধরে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের উপর বিশ্বের সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও তারা বার বার পরাজিত হয়েছে। সাড়ে ৭ দশক ধরে ইসরাইলী বর্বরতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইঙ্গ-মার্কিন অক্ষও এবার তাদের নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। মার্কিনীদের ভেটো ক্ষমতা ও কূটনৈতিক প্রভাব উপেক্ষা করেই ইউরোপের দেশগুলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের অবস্থান জোরদারের ঘোষণা দিচ্ছে। এতসব বিপত্তি ও বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে নতুন করে রাফা শহরে গণহত্যা চালানোর মধ্য দিয়ে ইসরাইলীরা তাদের পুরনো পোড়ামাটি নীতিকেই তুলে ধরেছে। হামাসের পাল্টা আক্রমনে দিশাহারা আইডিএফ মনোবল ধরে রাখতে পারছে না। একদিকে তারা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করতে শুরু করেছে অন্যদিকে হামাস হেজবুল্লাহর গাইডেড মিসাইল আক্রমণে ইসরাইলের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সামরিক ও বিমানঘাটিগুলো লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে নেতানিয়াহু ইসরাইলকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধে নিক্ষেপ করেছে। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ স্পষ্টতই বলেছেন, ইসরাইল একটি চুড়ান্ত পরাজয় কিংবা অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে চলেছে। ইতিমধ্যে ইসরাইলী সামরিক বিশ্লেষক, সাবেক মোসাদ কর্মকর্তা এবং একাধিক সাবেক মন্ত্রীও আইডিএফ’র চেয়ে হামাসের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। নেতানিয়াহুর ভুল ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সামরিক উপদেষ্টাদেরকেও সমালোচনা মুখর হতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিবাদ করে কেউ কেউ পদত্যাগও করেছেন। এমনকি গাজা গণহত্যায় ইসরাইলকে সহায়তার প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসনেও বিরোধীতা, বিভক্তি ও বেশ কয়েকটি পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। তবে গণবিক্ষোভসহ আন্তর্জাতিক জনমত ও রাজনৈতিক কারণে বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর নীতির বিরুদ্ধে দ্বিমত প্রকাশ করলেও রাফায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রাখতে শতকোটি ডলারের অস্ত্রের চালান পাঠিয়েছে। অন্যদিকে, ভারত থেকে ইসরাইলে পাঠানো অস্ত্রভর্তি জাহাজ তাদের বন্দরে ভিড়তে দেয়নি স্পেনের কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে চলেছে বলে ঘোষণা করেছে স্পেন। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা শুরুর পর ইসরাইলে যদ্ধাস্ত্র রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্পেন। তবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যাবহুল দেশ ভারত একদিকে ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের পুরনো নীতির কথা বলছে, অন্যদিকে ইসরাইলে অস্ত্র, সৈন্য ও শ্রমিক পাঠিয়ে তাদের গণহত্যায় সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে পশ্চিমা বন্ধুরা ইসরাইল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও হিন্দুত্ববাদী ভারত সবকিছু নিয়ে জায়নবাদী ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাফা শহরের ১০ লক্ষাধিক মানুষ এখন দুর্ভিক্ষ, গণহত্যার মুখোমুখী দাঁড়িয়েও বিজয়ের স্বপ্নে প্রত্যয় ছড়াচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের বশংবদ ইসলামোফোবিক রাষ্ট্রগুলোর হাত ধরে কথিত সভ্য ও মানবিক ‘পথ হারিয়েছে বিশ্ব’। যুদ্ধের নামে গাজায় ক্রমবর্ধমান গণহত্যার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন গ্রিফিথ এই মন্তব্য করেছেন। বহু বছর ধরে অঘোষিতভাবে ইসরাইলী জায়নবাদ ও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ হাত ধরাধরি করে চলছে। চলমান গাজা যুদ্ধে জায়নবাদের সব হিসাব নিকাশ পাল্টে গেলেও হিন্দুত্ববাদের সাথে নতুন গাঁটছড়া বলে দেয়, মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার জায়নবাদী ইসরাইলের পথেই হাঁটবে ভারত। ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর চরম হুমকির আলামত দেখা যাচ্ছে। দিল্লির মূখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক নির্বাচনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা অনুসরণ করে নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিজের দলের পক্ষে নেয়ার পন্থা গ্রহণ করেছেন বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন। এভাবেই হিন্দুত্ববাদ নিয়ন্ত্রিত ভারত ক্রমে একটি মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্রে পরিনত হতে চলেছে। আর এই প্রেক্ষাপটে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একটি জাতিগত আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক সংঘাতের হুমকির মুখে রয়েছে। গাজা যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে গণজোয়ারে খৃস্টান, ইহুদিরাও ব্যাপক হারে যোগ দিলেও হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের ভূমিকা যেন জায়নবাদী ইসরাইলীদের চেয়েও একধাপ এগিয়ে। গাজায় গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে যখন বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, তখন ভারতের মুম্বাইয়ে পারভিন শেখ সুমাইয়া নামের এক স্কুল শিক্ষিকাকে (অধ্যক্ষ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে লেখা পোস্টে লাইক দেয়ার কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এটি কোনো ভারতীয় ইস্যু নয়, ফিলিস্তিনে ইসরাইলী গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিংয়ের বিরুদ্ধে মত দেয়ার কারণে চাকরি চলে যাওয়ার মত ঘটনা খোদ ইসরাইলেও ঘটেছে কিনা সন্দেহ আছে। সেখানকার রাজনৈতিক সমাবেশগুলোতে যুদ্ধবিরোধী ও নেতানিয়াহুর সরকারবিরোধী, এমনকি ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরাইলী নাগরিকদের প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং হিন্দুদের মধ্যে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে বিজেপি নেতাদের কান্ডজ্ঞানহীন ভূমিকায় সাধারণ ভারতীয় ও উপমহাদেশের মুসলমানদের শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়রা এবার হয়তো হিন্দুত্ববাদের ফাঁদে পা দিবে না। প্রথম চার ধাপের নির্বাচনে ভোটের জরিপে হিন্দুত্ববাদীদের জনপ্রিয়তায় ধসের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে জায়নবাদীদের ইসলামোফোবিক এজেন্ডা মার খাচ্ছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেনে ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনীর ট্রিলিয়ন ডলারের ওয়ার প্ল্যান ব্যর্থ হয়ে গেছে। গাজা যুদ্ধে হামাসকে এতটুকু দুর্বল করতে পারেনি ইসরাইল। ইরানের সাথে সীমিত সংঘাতে ইসরাইলকে হারতে হয়েছে। হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি, ইসলামিক জিহাদ ও আইআরজিসি’র সমন্বিত আক্রমণের মুখে জায়নবাদী ইসরাইলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। নিজেদের অস্তিত্বের সংকট সত্বেও জায়নবাদী নেতানিয়াহু দ্বিরাষ্ট্রের সমাধানের পথে হাঁটতে নারাজ। তারা এখন্ োতাদের ইউটোপিক প্রমিজড ল্যান্ড বা গ্রেটার ইসরাইল গড়ার দিবাস্বপ্নে বিভোর। একইভাবে ভারতের বিজেপি নেতারাও উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের নিশানা মুছে দিয়ে হিন্দুত্ববাদী মহাভারত গড়ার কল্পকাহিনী ছড়াচ্ছে। এ স্বপ্ন কখনোই পুরণ হবার নয়। মুসলমান ও বৃটিশদের হাতে গড়া একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রকে জায়নবাদ কিংবা হিন্দুত্ববাদের মোড়কে ঐক্যবদ্ধ ও অখন্ড রাখা অসম্ভব। ভারত ও ইসরাইলের ক্ষেত্রে এই সত্য সমভাবে প্রযোজ্য।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার