ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

রিমালের তাণ্ডব : আবার বুক পেতে দিয়েছে সুন্দরবন

Daily Inqilab অলিউর রহমান ফিরোজ

৩০ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম

ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত উপকূলীয় জনপদ। সেখানে এখন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির অবতারণা ঘটেছে। ঘরবাড়ি আর গাছপালা ঘূর্ণির তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার অদম্য সাহসী মানুষগুলো এখন আর ভালো নেই। দুর্গত মানুষগুলোর দীর্ঘ সময়ের সরকারি সাহায্য-সহায়তা প্রয়োজন।

এবারের রিমাল অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ছিল অনেকটা ভিন্ন। তার গতি এবং প্রকৃতি সিডর, আইলা থেকে কম থাকলেও দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি ও বাতাস বয়ে চলার কারণে এবার ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুনণ জলোচ্ছ্বাস এবং পানির তোড়ে বাঁধ এবং সড়কের ক্ষতি ঘটেছে অনেক বেশি। তাছাড়া কৃষি জমি তলিয়ে ফসলহানি ঘটেছে আশংকাজনক হারে। দীর্ঘসময় ধরে তাণ্ডবে কারণে এ অঞ্চলের মানুষগুলো বাড়ি-ঘর, বাঁধ, সড়ক, জমির ফসল এবং কর্মস্থান হারিয়ে এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে চিংড়ী এবং কাকড়া চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে জোয়ারের পানির কারণেও বাঁধের ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়েছে। এতে লবণাক্ত পানি ঘেরে প্রবেশ করে কোটি কোটি টাকার চিংড়ী এবং কাকড়া নদীর ¯্রােতে মিশে গেছে। অনেক এলাকার একটি বাড়িও পানিতে জেগে নেই। বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলের ওপর দিয়েই রিমালের তা-ব ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে এখন খাদ্য, পানি, বাসস্থান সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। উপকূলের বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে মিঠা পানির উৎস তলিয়ে যাওয়ায় খাদ্য এবং সুপেয় পানির তীব্র সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা যে হারে দুর্গতদের নিকট পৌঁছার কথা সেহারে তারা পাচ্ছে না। তাই দুর্গত এলাকায় খাদ্যের বড় সংকট তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো সরেজমিনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা তৈরি করে তাদের সর্বাত্মকভাবে পাশে দাঁড়াতে হবে।

মনে রাখতে হবে, ঘরে বসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা তৈরি করা হলে তাতে অনেকেই বাদ পড়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অফিসে বসেই দায়সারা গোছের তালিকা তৈরি করা হয়ে থাকে, যা বাস্তবতার সাথে অনেক ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৬ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে অর্ধেক নগদ সহায়তা, যা বাস্তবতার ভিত্তিতে খুবই অপ্রতুল। এবার বাঁধ, সড়ক, মৎস্য ও কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কৃষির ক্ষতির ক্ষেত্রে তাদের তালিকা করে সার, বীজ এবং নগদ সাহায়তার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নইলে খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলা করা অনেকটা সরকারের পক্ষে দুরুহ হয়ে পড়বে।
আলুর মৌসুম দুর্যোগের কবলে পড়ে এখন আলু ৫০ টাকা খেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তাই মনে রাখতে হবে, কৃষিকে এগিয়ে নিতে না পাড়লে দেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। যারা ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে তাদের বাড়ি তৈরি করতে দ্রুততার সাথে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। মাথা গোঁজার আশ্রয়, সড়ক ও বাঁধের উন্নয়নে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার মানুষ তাদের কর্ম হারিয়েছে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো কর্ম হারিয়ে এখন দিশেহারা। এলাকাগুলোকে দুর্গত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে দীর্ঘ মেয়াদী খাদ্য সহযোগিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আগে দেশের মানুষ সিডর এবং আইলার কবলে পড়ে। ২০০৭ সালে তা-ব চালায় ঘূর্ণিঝড় সিডর। তাতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। সিডরে ৩ হাজার ৪ শত ৪৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়। আর গবাদি পশুসহ অন্যান্য প্রাণীরও ব্যাপকহারে মৃত্যু ঘটে। কৃষিতে তখন ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয় এবং ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তখন গাছে গাছে মানুষের লাশ ঝুলতে দেখা গেছে। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে উপকূলীয় মানুষের ওপর। তাতে ৫৭ জন মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে এবং ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ ক্ষতির শিকার হন। সড়ক ক্ষতি হয় ৩ শত ৭২ কিলোমিটার এবং ৫ শত ৯৭ কিলোমিটার বেড়ীবাঁধ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে যায়। তখনকার সময় খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘূর্ণিঝড় আইলাতে বেড়ীবাঁধ ক্ষতির চিন্তা করে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে। নেয়া হয় বেড়ীবাঁধ তৈরির বিশেষ প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে যতোটা শক্ত ও টেকসই উন্নয়ন করার কথা তার সিকি ভাগও করা হয়নি। লুটপাটে প্রকল্পের সবটাকা বেহাত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় কয়েকবার উপকূলীয় এলাকার বেড়ীবাঁধ সংস্কার করা হয়। তাও যেনযেন ভাবে করে টাকা হাতিয়ে নেয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এবং প্রকৌশলীরা। তাই দীর্ঘ সময়ে উপকূল অঞ্চলকে নিরাপদ করা যায়নি। বড় ধরনের কোনো ঝড় হলেই বেড়ীবাঁধ ভেঙে ক্ষতির মুখে পড়েছে উক্ত এলাকার মানুষ। এবার রিমালে বিশেষ করে উপকূলীয় কয়েকটি এলাকার ১৫ শতাংশ বেড়ীবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকা প্রতিবেশ, মানুষ, ভূগর্ভস্থ পানি এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

দিন দিন সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইপিসিসির হিসাব মতে, ১৯৯৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩ দশমিক চার দুই মিলি মিটার উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। খুলনার যে অঞ্চলের বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে সেখানে গত ৩০ বছরের পানি বৃদ্ধির একটি গবেষণা রয়েছে। ১ শত ৮৩টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি রেকর্ড পরিচালনা করা হয়েছিল। তাতে এ অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক দুই এক মিলি মিটার। সেখানে যেভাবে বাঁধ দেয়ার দরকার ছিল তা দেয়া হয়নি। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে যদি উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলো তৈরি করা হতো তাহলে রিমালে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে এতোটা বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারতো না। মূলত বাঁধ নির্মাণেই সবচেয় বেশি দুর্নীতি ঘটে। টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য যেখানে টেন্ডার আহ্বান করা হয়, সেখানে টাকা খরচ হয় ঠিকই কিন্তু বাঁধ আর মজবুত হয় না। তাহলে এতো টাকা খরচ করার দরকার কী? যে বাঁধ সমুদ্রের পানি ঠেকানোর জন্য দেয়া হয়েছিল, তা যখন ভেঙে ক্ষতির মুখেই পড়তে হলো তখন আর বাঁধের প্রয়োজনীতা কী? সে প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মনে দেখা দিয়েছে। কেন বাঁধ ভাঙলো, তার জবাবদিহি করতে হবে সংশ্লিষ্ট দফতর এবং ঠিকাদারদের। এটা কোনো বাণিজ্যের ক্ষেত্র হতে পারে না।

আমাদের দুর্যোগ এবং দুর্বিপাক নিয়ে বাঁচতে হবে। প্রকৃতি এখন আমাদের ওপর তার রোষ চাপাচ্ছে। তা একদিন-দু’দিনে তৈরি হয়নি। প্রকৃতির ওপর আমাদের অত্যাচার ও অবহেলার খেসারত এখন আমরা দিচ্ছি। আমাদের প্রতিবেশ ও পরিবেশের যতোটুকু যতœ নেয়ার দরকার ছিল তা আমরা নিতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। রিমাল আমাদের উপকূল এবং স্থল ভাগের বিশাল একটা অংশ গুড়িয়ে দিয়েছে। গাছপালা ও ঘরবাড়ির ওপর তা-ব চালিয়েছে। তবে এবারও সুন্দরবন আমাদের রক্ষায় এগিয়ে এসেছে। বুক পেতে দিয়েছে আমাদের রক্ষার্থে। সুন্দরবনের অনেক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। উপকূলীয় এলাকার বন সম্পূর্ণ রূপে তলিয়ে গেছে। তাতে বনের প্রাণীকূল অনেকটা আশ্রয় হারিয়ে ফেলেছে। অনেক প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। যে বন আামাদের আগলিয়ে রাখে সে বনকে রক্ষায় আমরা সচেষ্ট নই। আমরা আগুন দিয়ে বনকে জ্বালিয়ে দিয়ে মাইলের পর মাইল পুড়িয়ে দিয়েছি। আগুন নেভাতে নেই আমাদের আধুনিক কোনো প্রযুক্তি। নেই কোনো দক্ষ ফায়ার ফাইটার। এটা যেন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো ব্যাপার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার