ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

মেট্রোরেল নির্মাণকালে ঢাকার বায়ুদূষণ : একটি পর্যালোচনা

Daily Inqilab জাহিদুল ইসলাম ও ড. মল্লিক আকরাম হোসেন

৩০ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম

ঢাকা হলো দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল মেগাসিটিগুলোর একটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য অনুসারে (২০২২), ঢাকার জনসংখ্যা ২০১১ সালের তুলনায় ১.৫ গুণ বেড়েছে। ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮ শত ৮২ জন। ২০১১ সালে ছিল ৬৯ লক্ষ ৭০ হাজার ১০৫ জন। এছাড়া ম্যাক ফেরসনের গবেষণা মতে, জীবিকার সন্ধান বা আরও ভালো কাজের সুযোগ পাওয়ার জন্য প্রতি বছর ৪ লাখ মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমায়। ফলে যে অতিরিক্ত জনসংখ্যা ঢাকায় আসে, তাদের দৈনন্দিন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াতের জন্য যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া নগরবিদদের একটি স্বীকৃত অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, একটি আদর্শ শহরের জন্য ২৫ শতাংশ এলাকা পরিবহণ ও চলাচলের রাস্তা রাখতে হবে। কিন্তু ঢাকার মোট আয়তনের মাত্র ৭ শতাংশ রাস্তা রয়েছে যা ব্যাপক যানজটের সৃষ্টির অন্যতম কারণ। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর যানজটের কারণে পাঁচ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা এবং টাকার হিসাবে প্রতি বছর ৩৭ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়।

আবার, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ, ২০২২) তথ্য মতে, প্রতিদিন ঢাকার বিআরটিএ অফিসে ৪৩৪টি গাড়ি নিবন্ধিত হয়। দৈনিক গড় নিবন্ধনের মধ্যে রয়েছে ২৯৩ টি মোটরসাইকেল এবং ১৪১ টি গাড়ি। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে কম মোটরচালিত শহরগুলির মধ্যে একটি হলেও এখানে যানজট সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় পাবলিক বাস চলাচলের গতি প্রতিঘন্টায় ৬.৪ কিলোমিটার। বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা শহরের যানজট এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে ঢাকা মেট্রোরেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঢাকায় নির্মাণাধীন মেট্রোরেল নির্মাণ ছিল ২০ বছর ব্যাপী দীর্ঘ কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) অংশ। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একটি সরকারি সংস্থা ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) কে।

২০০৬ সালের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ মোটরচালিত যানবাহন। উদাহরণ স্বরূপ, ভারী গাড়ি, ডিজেল যানবাহন, তিন চাকার গাড়ি এবং দ্বি-স্ট্রোক ইঞ্জিনগুলো প্রধান দূষণকারী। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে মেট্রোরেল নির্মাণ পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে বায়ু ও শব্দ দূষণের উপর। একটি জাতীয় দৈনিকে ২০১৯ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দাবি করে বলেছিলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের এলাকাগুলো শব্দ এবং পরিবেশকে দূষিত করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধুলো তৈরি এবং মানুষের স্বাস্থ্য বিপন্ন করছে। এছাড়াও ঢাকার বাতাসের মান খারাপ হওয়ার পেছনের কারণ হচ্ছে মেগাপ্রজেক্ট নির্মাণ সেই সাথে ঢাকা শহরের আশপাশের ইটভাটা থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের সার্বিক বিষয়গুলো থেকে পরিবেশ দূষণের সূচকগুলো ধরে গবেষণা করা হয়েছে।

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ^বিদালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মল্লিক আকরাম হোসেন-এর তত্ত্বায়ধায়নে থিসিস শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম Assessing the environmental pollution and risk of Metro rail construction in Dhaka City শিরোনামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণাপত্রটি বিখ্যাত গবেষেণা জার্নাল এলসিভিয়ারের Spatial Modeling of Environmental Pollution and Ecological Risk বইয়ের একটি অধ্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটিতে ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের ফলে বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকার মেট্রোরেল লাইনটি এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত যার প্রাথমিক দৈর্ঘ্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২১.৭ কিমি। লাইনটি ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে তুরাগের সমান্তরাল বুড়িগঙ্গা নদীর গতিপথ ধরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গিয়েছে। এই গবেষণাটিতে মেট্রোরেল নির্মাণ সময়ের চলাকালীন ৬ টি স্টেশনের নির্মাণকালীন ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ৬ মাসের বায়ু এবং শব্দের ডেসিবেল নির্বাচিত স্থানগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। স্থান ৬ টি হলো: বিজয় সরণি স্টেশন, ফার্মগেট নির্মাণ ইয়ার্ড, ফার্মগেট স্টেশন, কারওয়ান বাজার, টিএসসি (ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়) এবং মতিঝিল (শাপলা চত্ত্বর)।

বায়ুদূষণ সূচকগুলোর মধ্যে ছিল সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার (এসপিএম), পার্টিকুলেট ম্যাটার২.৫ (পিএম২.৫), পার্টিকুলেট ম্যাটার১০, (পিএম১০), কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, এবং সালফার অক্সাইড। এখানে পিএম২.৫ হল একটি বায়ু দূষণকারী যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ যদি বাতাসে পিএম মাত্রা বেশি থাকে।

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ঢাকা শহরের বায়ুর গুনমান মানচিত্রে দেখা যায় মতিঝিলে এসপিএম ২৫৭.৩২ মাইক্রোন/মি৩, টিএসসি ২০২.৩৮ মাইক্রোন/মি৩, যা আদর্শ মান থেকে অনেক বেশি। এছাড়াও, অন্যান্য স্থানগুলোতে এসপিএম আদর্শ মানের কাছাকাছি। কারওয়ান বাজারে এসপিএম এর সর্বনি¤œ মান (১৫৫.৩০ মাইক্রোন/মি৩) পাওয়া যায়। পিএম১০ এর ক্ষেত্রে মতিঝিল এবং টিএসসি এলাকার মানগুলো আদর্শ মানের দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া চারটি স্থানে পিএম১০ এর ঘনত্বের মাত্রা মানও আদর্শ মানের চেয়েও বেশি। পিএম১০ এর সর্বনি¤œ মান (৬৮.৪০ মাইক্রোন/মি৩) বিজয় সরণি স্টেশনে পাওয়া যায়। ডঐঙ দ্বারা নির্ধারিত পিএম১০ এর গ্রহণযোগ্য মান হল ৫০ মাইক্রোন/মি৩ যদিও বাংলাদেশে এটি ৬৫ মাইক্রোন/মি৩। কিন্তু গবেষণা এলাকার ছয়টি পয়েন্টেই মান গ্রহণযোগ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

ডঐঙ অনুযায়ী পিএম২.৫ এর আদর্শ মান হল ৬৫ মাইক্রোন/মি৩ এবং বাংলাদেশের জন্য ৬০ মাইক্রোন/মি৩। অন্তত চারটি স্টেশনে পিএম২.৫ মান মান থেকে বেশি। স্টেশনগুলো হলো বিজয় সরণি, ফার্মগেট নির্মাণ ইয়ার্ড, ফার্মগেট এবং কারওয়ান বাজার। এছাড়া মতিঝিল ও টিএসসি স্টেশনে পিএম২.৫ মান স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে রয়েছে। সর্বনি¤œ মান পাওয়া গেছে টিএসসিতে ৩৭.১২ মাইক্রোন/মি৩। সালফার অক্সাইড ঘনত্বের মানচিত্র থেকে দেখা যায় বিজয়সরণী, ফার্মগেট নির্মাণ ইয়ার্ড, ফার্মগেট স্টেশনে সালফার অক্সাইড-এর ঘনত্ব আদর্শ মানের (১৫৯.১৯ মাইক্রোন/মি৩) প্রায় আট গুণ। এছাড়া, সালফার অক্সাইডের সর্বনি¤œ পরিমাণ (৬২.০৪ মাইক্রোন/মি৩) আদর্শ মানের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। এর প্রধান কারণ হতে পারে মেট্রোরেল নির্মাণের সময় যানবাহন থেকে নির্গত বাতাসে সালফার অক্সাইডের উপস্থিতি। এছাড়াও, ঢাকা শহরের আশেপাশের ইটভাটা থেকে সালফার ডাই অক্সাইডও এতে অবদান রাখে।

বিজয় সরণি, ফার্মগেট এবং কারওয়ান বাজার এলাকায় নাইট্রোজেন অক্সাইড মান আদর্শ মান থেকে অনেক বেশি, যা নাইট্রোজেন অক্সাইডের মানচিত্র দ্বারা প্রমাণিত। মতিঝিল ও টিএসসি এলাকায় সবচেয়ে কম মান দেখা গেছে। মানচিত্রটি দেখায় সর্বনি¤œ মান হল ৮.৮৬ মাইক্রোন/মি৩ যা আদর্শ মান থেকে বেশি। কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ থেকে দেখা যায়, সমস্ত সাইটের মান মান সীমার মধ্যে।

জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসের শব্দ দূষণ চিত্র থেকে দেখা যায়, ফার্মগেট নির্মাণ ইয়ার্ড সাইটে প্রায় ৮১.১১ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দ দূষণ রেকর্ড করা হয়েছিল এবং বিজয় সরণি স্টেশনে সর্বনি¤œ মান ৭৬.১ ডেসিবেল রেকর্ড করা হয়েছিল। টিএসসি’র মতো সংবেদনশীল এলাকায় (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) শব্দের মাত্রা ৭৫.৪ ডেসিবেল যা সহনশীলতার মাত্রার অনেক বেশি। বায়ু দূষণ সহনশীল মাত্রার চিত্র থেকে বুঝা যায়, যে সমস্ত সাইটে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক মানের থেকে অনেক বেশি যা নগরবাসীর জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। মাঠ পর্যবেক্ষনের তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণস্থল এলাকায় উচ্চ শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে সড়কে ভারী নির্মাণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং নির্মাণ সড়কের প্রস্থ কমে যাওয়ায় যানজটের কারণে শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েছে।

অক্টোবরে-ডিসেম্বর-২০১৯ এই তিন মাসের বায়ুর গুণমান চিত্র হতে দেখা যায়, এসপিএম-এর সর্বনি¤œ মান ছিল ১৪৭.১০ মাইক্রোন/মি৩ যা মতিঝিল স্টেশনে লক্ষ্য করা যায় এবং সর্বোচ্চ মান পাওয়া যায়, প্রায় ৩০৬.৫১ মাইক্রোন/মি৩ টিএসসিতে। এছাড়াও ২৭০.৪ মাইক্রোন/মি৩ কারওয়ান বাজার, ২৩০.৭ মাইক্রোন/মি৩ বিজয় সারণি স্টেশন, ২৪৩.৪ মাইক্রোন/মি৩ ফার্মগেট, ১৬৮.৭ মাইক্রোন/মি৩ ফার্মগেট নির্মাণ এলাকায়। যার সবগুলোই মান ডঐঙ এবং বাংলাদেশের মান ১২০ মাইক্রোন/মি৩ সীমা অতিক্রম করে।

পিএম১০ এর মান থেকেও দেখা যায়, মতিঝিলের পিএম১০ এর মান (১২৫.৪৩ মাইক্রোন/মি৩) এবং ফার্মগেট সাইটে ১২০.৬ মাইক্রোন/মি৩ যা আদর্শ মানের প্রায় দ্বিগুণ। বিজয় সরণি এবং কারওয়ান বাজার স্টেশনে, মান যথাক্রমে ১২২.৮ মাইক্রোন/মি৩ এবং ১১১.৪ মাইক্রোন/মি৩। টিএসসিতে পিএম১০-এর মান হল ৬৭.৩ মাইক্রোন/মি৩ এবং ফার্মগেট নির্মাণ এলাকায় তা হল ৭৮.৮ মাইক্রোন/মি৩।

মতিঝিল স্টেশনে পিএম২.৫ এর মান হল ৯৯.৯৩ মাইক্রোন/মি৩। বিজয় সরণি এবং ফার্মগেট স্টেশনে যথাক্রমে ৭৭.৪ এবং ৭০.৮ মাইক্রোন/মি৩ মান পাওয়া যায়, যা আদর্শ মান (৬৫ মাইক্রোন/মি৩) থেকে বেশি।

টিএসসি স্টেশনে, সালফার অক্সাইডের মান ৫১.৩ মাইক্রোন/মি৩ এবং মতিঝিল স্টেশনে এটি ৪৬.৩ মাইক্রোন/মি৩ যা আদর্শ মানের চেয়ে বেশি। অন্যান্য সমস্ত স্টেশনের জন্য মানগুলো গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। তবে অক্টোবর-ডিসেম্বরের সমস্ত স্টেশনে কার্বন মনোক্সাই এবং নাইট্রোজেন অক্সাইড মান স্বাভাবিক সীমার মধ্যে ছিল।

এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত একটি সংবেদনশীল এলাকা টিএসসি সাইটে সর্বোচ্চ শব্দ দূষণ ৮১.৯৯ ডেসিবেল রেকর্ড করা হয়েছে। এলাকার ধরণ অনুযায়ী টিএসসিতে শব্দে ৪৫ ডেসিবেল থাকা উচিত। পরবর্তী সর্বোচ্চ ৮০.১৪ ডেসিবেল ফার্মগেট স্টেশনে। ফার্মগেট একটি বাণিজ্যিক এলাকা। এছাড়া বিজয় সরণি স্টেশনে ৭৮.৫৫ ডেসিবেল, কারওয়ান বাজারে ৭৫.০৪ ডেসিবেল, মতিঝিলে ৭২.১৬ ডেসিবেল এবং ফার্মগেট নির্মাণ সাইটে সর্বনি¤œ মূল্য ৭১.৪২ িেসবেল রেকর্ড করা হয়েছে। উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণসহ এলাকাগুলোতে উচ্চ মাত্রার শব্দ দূষণ রয়েছে যা নির্দেশ করে যে এই স্থানে নির্মাণ কাজ চলছে। শব্দ দূষণের চিত্র থেকে দেখা যায়, প্রায় সব সাইটই আদর্শ মানের চেয়ে অনেক বেশি দেখায়।

বিশাল মেট্রোরেল উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকা শহর বর্তমানে বায়ু ও শব্দ দূষণের সম্মুখীন হচ্ছে। এই গবেষণা প্রকল্পের নির্মাণ কাজের সময় পরিবেশগত প্রভাব বিশেষ করে বায়ু এবং শব্দ দূষণ নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে। গবেষণার ফলাফলগুলোতে দেখানো হয়েছে, নির্মাণস্থলে উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণ এবং উচ্চ মাত্রার শব্দ দূষণও রয়েছে। যা নির্দেশ করে ঐ এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছে।

বিশেষ করে মেট্রো রেল নির্মাণ প্রকল্প এবং সাধারণভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঢাকা শহরের বায়ুকে দূষিত করে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা যায় যে, মেট্রো রেল নির্মাণের সাথে সে স্থানের বায়ু দূষণ নির্ভরশীল। কোনো স্থানে নির্মাণ কাজ চলমান থাকলে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়তে থাকে। বর্তমান গবেষণাতেও, বায়ু দূষণের পরিসংখ্যান মেট্রো রেল নির্মাণ এলাকার বায়ু দূষণের স্থানিক পরিবর্তন প্রদর্শন করে। দুটি সময়কাল এবং অবস্থান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বায়ু দূষণের পার্থক্য রয়েছে। দুটি সময়ের মানচিত্র দেখে এটা স্পষ্ট যে, দূষণ সবসময় এক জায়গায় একই রকম থাকে না। এর প্রধান কারণ মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ সবসময় এক জায়গায় হয় না। নির্মাণ কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত বায়ু দূষণ আমাদের গবেষণা দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। আরও কিছু দেশি-বিদেশি গবেষণায় দেখা গেছে যে, নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ এলাকায় বায়ু দূষণ এবং শব্দ দূষণ বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্সের লা ডিফেন্স জেলার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৭০ এর দশকে। সেই সময়ে, নির্মাণ এলাকায় তাপমাত্রা এবং বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পায় (গধশযবষড়ঁভ, ২০১২)।

চীনে পরিচালিত একটি গবেষণা অনুসারে, নির্মাণের সময় ভূমি জড়িত কার্যকলাপ সাইটগুলিতে নির্মাণ ধুলোর প্রধান উৎস চারটি। সেগুলো হলো: মাটি খনন, মাটি জমানো, ব্যাকফিলিং এবং মাটি পরিবহন। নির্মাণ ধূলিকণা বেশিরভাগই মাটি পরিবহন দ্বারা সৃষ্ট বলা হয়। মেট্রোরেল নির্মাণের জায়গায় একই দৃশ্য দেখা গেছে। উন্মুক্ত স্থানে নির্মাণসামগ্রী ডাম্প করা, অতিরিক্ত ধুলাবালি সৃষ্টি করা এবং নির্মাণ এলাকায় পানি না স্প্রে করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষকে বেশ কয়েকবার জরিমানা করেছে (বিসনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২০১৬)। এই গবেষণায় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বায়ু তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস বর্ষাকাল। এই সময়ের মধ্যে, ভারী বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় যা বায়ু দূষণে উল্লেখযোগ্য হ্রাসের দিকে পরিচালিত করে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর হলো বর্ষা-পরবর্তী সময়, যা বাংলাদেশে শীতকাল হিসেবে পরিচিত। এই সময়ের মধ্যে কম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় এবং বাতাসে কম জলীয় বাষ্প থাকে। এই অবস্থার ফলে শুষ্ক আবহাওয়া হয়। এভাবে বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেড়ে যায়।

গবেষণায় দেখা গেছে, নির্মাণ সাইটে, শব্দ এক্সপোজার প্রায়ই বিপজ্জনক। নির্মাণকালীন ইঞ্জিন চালিত যন্ত্র, ভারী সরঞ্জামের ফলে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, পাইল-ড্রাইভিং, বিস্ফোরণ এবং অন্যান্য প্রভাব সৃষ্টি করে প্রচন্ড শব্দের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মালয়েশিয়ার একটি গবেষণায় চারটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে যা নির্মাণস্থলে শব্দ দূষণে অবদান রাখে।

যে কোনো ধরনের নির্মাণ কাজ করার সময় বায়ু দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে যেন মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ অস্থায়ী ছাউনি বা বেষ্টনী দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেইসাথে, বেষ্টনীর ভেতর ও বাইরে নির্মাণ সামগ্রী (মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি) যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুইবার স্প্রে করে পানি ছিটানোর কথা বলা আছে এতে।

এসব কারণে নির্মাণ কাজের সময় যথাযথভাবে পরিবেশ দূষণমুক্ত কারার জন্য পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে নির্মাণস্থলে ধুলাবালি কমানো যায়। সরকারের বিভিন্ন নীতি থাকলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আগ্রহ ও যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে জনগণ এসব নীতির কোনো সুফল পাচ্ছে না। ঢাকা শহরের বায়ু ও শব্দ দূষণের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য এই নীতিগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: জাহিদুল ইসলাম, শিক্ষক, মানারাত ঢাকা ইন্ট্যারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ, ঢাকা।
ড. মল্লিক আকরম হোসেন, অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার