ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

সর্বাগ্রে সুন্দরবন ও উপকূলীয় সম্পদ রক্ষা করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

৩০ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম

সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জনপদ আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারায় সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জনপদের মানুষ ও প্রাণপ্রকৃতি বার বার মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে ঘুর্ণীঝড় সিডর ও আইলার তান্ডবে শত শত কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষিজমি, মৎস্যখামার ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ে। অতীতের মত এবারো আমাদের দক্ষিণের উপকুলীয় জনপদের প্রাকৃতিক সুরক্ষাব্যুহ সুন্দরবন প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের তান্ডব নিজের বুক পেতে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। ঘুর্ণীঝড় আইলা ও সিডরের সময়ে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বহু বছর লাগবে বলে সে সময় বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন। সেই ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠার আগেই সুন্দরবনের উপর বার বার উপকূলীয় দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। প্রকৃতি আপন খেয়ালে সুন্দরবনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হলেও আমরা নাগরিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় উপকূলীয় জনপদের মানুষ বার বার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। একেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর প্রথমেই উপকূলীয় বেড়িবাঁধ মেরামত, উন্নতকরণ, উকুলীয় সবুজবেষ্টনী এবং সংরক্ষিত বনভূমি রক্ষা ও উন্নয়নে যে ধরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল, সরকারিভাবে তা গ্রহণ ও বাস্তবায়ণ না হওয়ার দায়ভার বহন করতে হয় উপকূলীয় জনপদের প্রাণপ্রকৃতি ও লাখ লাখ মানুষকে।

গত ২৭ মে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণীঝড় রেমাল আঘাত হানার পর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক ক্ষয়ক্ষতিতে শতাধিক উপজেলার মানুষের মধ্যে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। সংবাদপত্রের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে শুধুমাত্র খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ১ লাখ ৩২ হাজার পরিবার বাড়িঘর বিদ্ধস্ত হয়ে গৃহহীন হয়েছে। পূর্ব সর্তকতার কারণে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও সুন্দরবনে হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী এবং উপকূলীয় এলাকায় হাজার হাজার গৃহপালিত গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী মারা গেছে। তবে শুধুমাত্র আর্থিক মানদন্ডে আমাদের উপকূলীয় প্রাকৃতিক সুরক্ষাব্যুহ সুন্দরবনের ক্ষতিসহ সামগ্রিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করা সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ক্ষতির অংক লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার চেয়ে বেশি। জমির ফসল, মাছের খামার, ফলফলাদির বাগান, গোলার ধান, ঘরবাড়ি ও গবাদি পশুসম্পদ হারিয়ে উপকূলীয় জনপদের লাখ লাখ মানুষ এখন আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছে। তাদের পুর্নবাসিত করা, খাদ্যনিরাপত্তা, কর্মসংস্থান এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এখন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকের ঘরে স্বজন হারানোর শোক, সহায়সম্বল হারানো আর্তজনের আহাজারিতে উপকূলীয় জনপদের আকাশ-বাতাস স্তব্ধ হয়ে আছে। তিনদিন পেরিয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তেমন কোনো সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারিভাবে ত্রাণতৎপরতা, উদ্ধার ও পুর্নবাসন তৎপরতা এখনো শুরু হয়নি। অথচ প্রতিটি মানুষের প্রতিবেলা খাবার প্রয়োজন। সবকিছু হারানো দুর্গত দরিদ্র মানুষ সরকার ও বিত্তবান মানুষের সহায়তার আশায় বুক বেঁধে চেয়ে আছে। কোটি কোটি মানুষ এখনো বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের বাইরে।

গত দেড় দশক ধরে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সরকার উন্নয়নের রোল মডেল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। এসব অবকাঠামো উন্নয়নের সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও উপকূলীয় প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা, সুন্দরবন, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী, বেড়িবাঁধের যথাযথ উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্ব তথাকথিত মেগা প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের যে সম্পদ আছে তা সুরক্ষা করাই প্রথম কর্তব্য। তারপর অন্য কিছু। অনেক কিছু হলেও বঙ্গোপসাগরের ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত ও সময়োপযোগী উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হলে রেমালের তান্ডবে শত শত কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উপর এমন খড়গ নেমে আসত না। উপকূলীয় সম্পদের সুরক্ষার বাস্তবসম্মত উদ্যোগের সাথে জড়িয়ে আছে দেশের কোটি মানুষের কর্মসংস্থান, জ্বালানি ও খাদ্যনিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নিশ্চিত সম্ভাবনা। এখন ঘর্ণীঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতিকে সামনে রেখে এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্গত জনপদের লাখ লাখ পরিবারের খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের নিজ বাড়িঘরে ফিরে যেতে গৃহনির্মাণে পর্যাপ্ত অর্থসহায়তা দিতে হবে। সর্বস্ব হারানো প্রান্তিক কৃষক ও খামারিদের আবার কৃষিকাজ ও খামার শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী সহায়তা ও প্রণোদনা দিতে হবে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে এই মুহূর্তে উপকুলীয় মানুষের সহায়তায় এগিয়ে যাওয়া সবচেয়ে জরুরি। দুর্গত পরিবারগুলোর জরুরি ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি বেড়িবাঁধ উন্নয়নসহ উপকূলীয় জনপদে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের উপযোগী শ্রমঘন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। উপকূলীয় জনপদকে অরক্ষিত রেখে, সেখানকার সাহসী, পরিশ্রমী মানুষদের দুস্থ অবস্থায় রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ প্রত্যাশা করে দেশের সাধারণ মানুষ।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার