ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

জনতার মন্ত্রিসভা : কল্পনা না আন্দোলনের নতুন মাত্রা?

Daily Inqilab মোমিনুল আমিন

৩১ মে ২০২৪, ১২:১৪ এএম | আপডেট: ৩১ মে ২০২৪, ১২:১৪ এএম

যুক্তরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির ছায়া সরকারে ‘আর্লি ইয়ার এডুকেশন’ মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন টিউলিপ সিদ্দিকী। তাঁর এমপি হওয়া নিয়ে এদেশে অনেক মাতামাতি থাকলেও ‘ছায়া সরকারের মন্ত্রিত্ব’ নিয়ে আওয়ামী লীগ বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কখনো মুখ খুলে নাই। কারণ গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সরকার এবং বিরোধী দলকে আলাদা করে দেখা হয় না। সরকারি দলের প্রত্যক্ষ সমর্থন নিয়ে ভোট ডাকাতি করে বা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসন যারা গত দুই মেয়াদে ‘আলোকিত” করে আছেন, তাঁরা নিজেদের কর্মীদের কাছেই বিরোধী দলের মর্যাদা পায় না। আইনের শাসন, জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এসব কেতাবি শব্দের অর্থ এদেশে ধর্ম, বর্ণ এবং রাজনৈতিক পরিচয়ে এখন ভিন্ন। আপনি যদি আওয়ামী মদদপুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে সরকারি পোশাকে মাত্র ৭০ হাজার টাকা বেতন পেয়েও শ্বশুরকে দুইটা জাহাজ কিনে দিতে পারবেন। ব্যাংক খালি করতে এদেশের বিশেষ একটা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মুন্সিয়ানা দেখে সত্য নাদাল, সুন্দর পিচাই-এর মত বিশ্বের সর্বাধিক বেতনপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহীরাও হয়তো তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে আফসোস করবে। পাঞ্জাবের নির্বাচনী সভা থেকে কেজরিওয়াল যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেখানো পথে হেঁটে ক্ষমতায় যেতে চাইছেন বলে মন্তব্য করেন তখন আসলে আমাদের অবাক হবার কিছু থাকে না। ক্ষমতার এই স্বাদ আর আলাদিনের চেরাগ যখন হাতের মুঠোয় থাকে তখন ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বা তাঁদের ক্রীড়ানক সংসদের বিরোধী দল কথা বলবে এটা ভাবাও একপ্রকার বিলাসিতা।

১৯৯১ সাল থেকে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে হাঁটা শুরু করলেও আজ পর্যন্ত ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ গঠন নিয়ে কোন কথা বলি নাই। সেই সময়ের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সংসদের থেকে রাজপথেই বেশি সময় কাটিয়েছিলো। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুইটি রাজনৈতিক দলের পরষ্পরের প্রতি চরম আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসাবে তখন থেকেই রাজপথকে বেছে নেয়া হয়েছে। ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে এবং সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কাজের পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন এবং যৌক্তিক সুপারিশ সংসদের মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে নাই। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সংসদে ভূমিকা রাখে। অষ্ট্রেলিয়া এবং কানাডার গণতন্ত্রেও ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ যাত্রা শুরু করলেও আজ পর্যন্ত নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত হতে পারে নাই। কারণ বাংলাদেশের বাস্তবাতায় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু একব্যক্তির হাতে ন্যস্ত। ফলে জাতীয় সংসদে আমরা কোরাম সংকট, অকার্যকর সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, ব্যক্তি প্রশংসা এবং বিরোধীদের উপর বিষেদাগারে সংসদীয় কার্যক্রমের সময় নষ্ট হতে দেখেছি। আমাদের সংবিধানের ৫৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবে’ লেখা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এসব প্রেক্ষাপটে আমাদের দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম ২০২২ সাল থেকেই ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ নিয়ে কথা বলে আসছে। তবে সংসদের প্রধান বিরোধী দল যেহেতু জনগণকে প্রকৃত অর্থে প্রতিনিধিত্ব করে না এজন্য এবছর আমরা এর নামকরণ করেছি ‘জনতার মন্ত্রিসভা’। রাজপথের স্বক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, দেশবরেণ্য আলেম, অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং কূটনৈতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ নিয়ে এমন একটি পরিষদ গঠিত হলে তা জনআকাক্সক্ষাকে ধারণ করে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

২০০৫ সালে ভারতে অসাদচরণের অভিযোগে একযোগে ১১ জন লোকসভা এবং রাজ্যসভার সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়। আমাদের দেশের ‘কালচার অব ইম্পিউনিটি’ বা দায়মুক্তির সংষ্কৃতিতে এটা অকল্পনীয়। সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধির ২৭০ এর ৬ উপবিধি লঙ্ঘন করে এখানে সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার এবং আচরণ লক্ষণীয়। কার্যকর একটি ‘জনতার মন্ত্রিসভা’ এসব ব্যক্তব্য এবং আচরণের বিপরীতে সরকারের নীতি এবং মন্ত্রনালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারে যা জনমত গঠনে এবং ভবিষ্যত আন্দোলন-সংগ্রামে সবপক্ষের সমর্থন আদায়ে জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি মতপার্থক্য এবং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ভুলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসাবে ‘জনতার মন্ত্রিসভা’ গঠন করতে পারে তাহলে দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বর্তমান সরকারকে কার্যকরভাবে চাপে রাখা সম্ভব হবে। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মও গতানুগতিক ধারায় জ্বালাও-পোড়াও এর রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে চায়। চলমান আন্দোলনে মেধাবী তারুণ্যকে সম্পৃক্ত করতেও একটি কার্যকর ‘জনতার মন্ত্রিসভা’ বড় ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: মহাসচিব, এনডিএম


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার