ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

শ্রমশক্তি রফতানির সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০১ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০১ জুন ২০২৪, ১২:০৪ এএম

দেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাত জনশক্তি রপ্তানি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, জিডিপি’র প্রায় ১২ শতাংশ যোগান দেয় রেমিট্যান্স। গত অর্থবছরে এ খাত থেকে আয় হয় প্রায় ২১.৬১ বিলিয়ন ডলার। বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে শ্রমিক ও কর্মজীবীরা এই অর্থ দেশে পাঠাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। প্রতিনিয়ত বেকার তরুণ শ্রেণী বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য হেন কোনো প্রচেষ্টা নেই, যা চালাচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে প্রবেশ করার জন্য তারা উদগ্রীব। এজন্য, বসতভিটা, জমিজমা বিক্রি, ধারকর্যসহ সর্বস্ব বিনোয়োগ করে। যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে তারা সেখানে যায়, দেখা যাচ্ছে, অনেক এজেন্সির দ্বারা তারা প্রতারিত হচ্ছে। প্রতারিত হয়ে শুধু ওই কর্মী নয়, তার পুরো পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। যদি তার চার সদস্যর পরিবার নিঃস্ব হয়, তাহলে এমন অসংখ্য পরিবার ও মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। এর দায় সরকার তো বটেই কেউই নিচ্ছে না। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সরকার নির্ধারিত খরচ জনপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা হলেও এজেন্সিগুলো নিচ্ছে গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা করে। এ অর্থ ব্যয় করে মালয়েশিয়া গেলেও যে চাকরির কথা বলে তাদের নেয়া হয়, তা গিয়ে তারা পায় না। অনেকে চাকরি না পেয়ে মানবেতর জীবন কিংবা সেখানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পায় না। এ এক ভয়াবহ চিত্র। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার একটি দৈনিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে সিন্ডিকেটের রমরমা ব্যবসা সংক্রান্ত ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। কীভাবে বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকরা প্রতারিত হচ্ছে এবং সিন্ডিকেট ফুলেফেঁপে উঠছে, তা প্রকাশ করা হয়। এর সাথে চার সংসদ সদস্য ও সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং তার পরিবারের সদস্যদের যুক্ত থাকার তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে রয়েছেন, এমপি মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন হাজারী, বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পরিবারের সদস্যদের রিক্রুটিং এজেন্সি। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরও জড়িয়ে আছেন।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দুই দেশের সিন্ডিকেট জড়িয়ে আছে। তাদের বাইরে জনবল রপ্তানি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা একসময় এই সিন্ডিকেটের বিরোধিতা করেছে, তারাও এখন তাতে জড়িয়ে ব্যবসা করছে। পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সর্বশেষ ২০২২ সালে মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির একটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়। তখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সব এজেন্সির জন্য কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত রাখার ওপর জোর না দিয়ে মালয়েশিয়াকে এজেন্সি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়। এতে নির্দিষ্ট কোনো মানদ- ছিল না। এ সুযোগ নেয় মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মালিক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। এর মালিকানায় রয়েছে বাংলাদেশি বংশদ্ভুত নাগরিক আমিন নূর। তিনি সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা। বাংলাদেশে তার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন। তারা দুজন মিলে সিন্ডিকেট গড়ে অন্যদের তাতে যুক্ত করে। সিন্ডিকেটে শুরুতে ২৫টি এজেন্সি থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ১০০ করা হয়েছে। তাদের কাছেই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার জিম্মি হয়ে আছে। অথচ মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৪টি দেশ কর্মী পাঠায়। বাংলাদেশ ছাড়া অন্যকোনো দেশে সিন্ডিকেট নেই। এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও যেন অসহায় হয়ে রয়েছে। সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি খরচের চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ বেশি নিয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাচ্ছে। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন আসে, সরকার কেন এর প্রতিকার ও নির্ধারিত খরচ বাস্তবায়ন করতে পারছে না? সরকার কি সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়? একজন গরিব তরুণ, যে ধারকর্য ও জমিজমা বিক্রি করে সেখানে গিয়েও প্রতিশ্রুত কাজ পাচ্ছে না, অসহায় হয়ে পড়ছে এবং নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরছে, এর দায় কি সরকারের ওপর বর্তায় না? শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের চারজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ সরকারের কাছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পদে পদে ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়কে ঘুষ দেয়ার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ নিয়ে সরকারের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সরকার জেনেশুনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এতে দেশের ভাবমর্যাদা যে ক্ষুণœ হয়েছে, তা নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো বিচলন নেই। অসংখ্য কর্মী যে, মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছে এবং অবৈধ হয়ে কারাবাস করছে, এ ব্যাপারে সরকার নির্বিকার। সরকার একদিকে বেকার তরুণদের চাকরি দিতে পারছে না, অন্যদিকে তারা স্বউদ্যোগে বিদেশ যাওয়ার উদ্যোগ নিয়ে প্রতারণার শিকার হলেও তার প্রতিকার করছে না। এটা কোনো দায়িত্বশীল সরকারের কাজ হতে পারে না। জনবল রপ্তানির মাধ্যমেও যে দেশের অর্থপাচার হয়ে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সরকারের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। গতকাল প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেট বছরে এক বিলিয়ন ডলার হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার করে দিচ্ছে। সরকার এসব জেনেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারকে নিয়মতান্ত্রিক কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যে শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেই শ্রমিকরা দেশের সম্পদ এবং সেই সম্পদ রক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার দেশের তরুণদের চাকরি দিতে না পারলেও তারা যে, সবকিছু বিক্রি ও ধার করে বিদেশ যাওয়ার উদ্যোগী হয়েছে, তাদের এ প্রচেষ্টাকে তো সংরক্ষিত করতে পারে। সিন্ডিকেট যে, তাদের সর্বস্ব লুটে নিঃস্ব করে দিচ্ছে, এর দায় সরকার এড়াতে পারে না। বিদেশ গমনেচ্ছু শ্রমিকদের অর্থ লোপাট এবং দেশের অর্থ পাচার রোধে সরকারকে অনতিবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে সরকার নির্ধারিত খরচে কর্মীরা বিদেশ যেতে পারে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। শুধু মালয়েশিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্যের কুয়েত, সউদী আরব, আরব আমিরাতসহ অন্যদেশগুলোতে শ্রমশক্তি রপ্তানি এবং সেখানের শ্রমিকরা যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, এ ব্যাপারেও সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। জনশক্তি রপ্তানি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। কোনো শ্রমিকের কাছ থেকে প্রকৃত রিক্রুটিং এজেন্সি যাতে নির্ধারিত খরচের বেশি না নিতে পারে, তা নিশ্চত করতে হবে। যেসব ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিক পাঠাচ্ছে, তাদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সিন্ডিকেটের কাছে সরকারকে অসহায় হয়ে থাকলে হবে না।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার