ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

আত্মহত্যা নয়

Daily Inqilab জালাল উদ্দিন ওমর

০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্রই এই সমস্যা বিদ্যমান। ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবতি, এমনকি বৃদ্ধ মানুষেরাও আত্মহত্যার মিছিলে শামিল হচ্ছে। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই সমান হারে আত্মহত্যা করছে। কুড়ে ঘরে বসবাসকারী গরিব মানুষটিও যেমন আত্মহত্যা করছে, ঠিক তেমনি অট্টালিকায় বসবাসকারী মানুষটিও আত্মহত্যা করছে। অনুন্নত দেশের মানুষেরা যেমন আত্মহত্যা করছে, ঠিক তেমনি উন্নত দেশের মানুষেরাও সমান তালে আত্মহত্যা করছে। আত্মহত্যার এই প্রবণতা দিন দিন কেবলই বাড়ছে। কোনভাবেই এই আত্মহত্যার মিছিল থামছে না এবং থামানো যাচ্ছে না। সমস্যায় পড়লে ধৈর্য না ধরে কেউ কেউ সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যাকারী মানুষটি মনে করে, এর মাধ্যমে সে সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে। কিন্তু আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বরং এটি হচ্ছে নিজেকে চিরতরে ধ্বংস করার সহজ প্রক্রিয়া। একজন মানুষ যখন আত্মহত্যা করে তখন তার জীবন যেমন চিরতরে শেষ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর স্বপ্নও চিরতরে শেষ হয়ে যায়। কারোই আত্মহত্যা তাই কোনভাবেই কাম্য নয়।
আত্মহত্যা বিশ্বের একটি সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১১০০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি বছর ভারতে প্রায় ১৭০০০০, পাকিস্তানে প্রায় ২০০০০, জাপানে প্রায় ২২০০০ এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০০০০ মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার এই হার প্রায় প্রতিটি দেশেই বিদ্যমান। আত্মহত্যাকারিদের মাঝে বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীরাও রয়েছে। আঁচল ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। সংস্থাটির রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২২ সালে ৫৩২ জন এবং ২০২৩ সালে ৫১৩ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। এসবের মাঝে স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী রয়েছে। পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। অথচ, পরবর্তীতে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার সুযোগ আছে এবং পরবর্তীতে ভালো ফলাফল করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার অনেক নজির এই সমাজে রয়েছে। আবার কিশোর বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হয়েও অনেক ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করে। অথচ, এসব ছাত্রছাত্রীর সবারই অনেক সুন্দর একটি ভবিষ্যত ছিল। ঠুনকো কারণে এসব ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা মাধ্যমে শুধু নিজেকেই চিরতরে শেষ করেনি বরং তাদের পিতামাতা, ভাইবোন এবং পরিবারকেও শেষ করেছে। সন্তানের আত্মহত্যায় অনেক পিতামাতা শোকে পাগল হয়ে গেছে। অনেকে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। একজন মানুষ যখন সুখে-শান্তিতে থাকে তখন কিন্তু তিনি আত্মহত্যা করেন না। অপরদিকে একজন মানুষ যখন বিপদে পড়ে, দুঃখ-কষ্টে থাকে তখন অনেক সময় সাহস হারিয়ে ফেলে, জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময় অনেকে আত্মহত্যা করে।

যে সমস্ত কারণে সাধারণত মানুষ আত্মহত্যা করে তার কিছু উদাহরণ বর্ণনা করছি। যথাযথ চাকরি না পাওয়া, চাকরিতে প্রমোশন না পাওয়া, চাকরি হারানো, ব্যবসায় উন্নতি না হওয়া, ব্যবসায় ক্ষতি হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, দা¤পত্য কলহ, লাইফ পার্টনারের পরকীয়া, একাকীত্ব, লাঞ্চনা-বঞ্চনা, অবজ্ঞা এবং অপমানের শিকার হওয়া ইত্যাদি কারণে মানুষের মনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে সামাল দিতে পারে না এবং তখন জীবনের প্রতি হতাশ হয়ে পড়ে। এ সময় কী করবে তা কোনো কোনো ব্যক্তি বুঝে উঠতে পারে না। তখন তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে এবং নিজেকে চিরদিনের জন্য শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজেকে শেষ দেয়ার পাশাপাশি তার পুরো পরিবার এবং আপনজনকেও যে দুঃখ-কষ্টের মাঝে নিক্ষেপ করে তা কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখে না। এসব ভেবে দেখলে একজন মানুষ কখনোই আত্মহত্যা করতে পারে না এবং আত্মহত্যা করবে না।

আমরা কেউই আমাদের ইচ্ছানুযায়ী এই পৃথিবীতে আগমন করিনি। আমাদের জন্ম, জন্মসময় এবং জন্মস্থান কোনটাই আমাদের দ্বারা নির্ধারিত নয়। আবার আমরা পুরুষ না নারী, তাও আমাদের দ্বারা নির্ধারিত নয়। একইভাবে আমাদের জীবন কত দিনের এবং আমাদের মধ্যে কার মৃত্যু কখন হবে, তাও আমাদের দ্বারা নির্ধারিত নয়। এসব একান্তই সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত। আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই এই দুনিয়ায় আমাদের আগমন এবং জীবন যাপন। যেহেতু আমাদের জীবনের মালিক আমরা নই, সেহেতু নিজের ইচ্ছানুযায়ী এই জীবনকে শেষ করে দেয়ার অধিকারও আমাদের নেই। এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণই সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। জীবনে যত দুঃখ-কষ্ট এবং বিপদ-আপদ আসুক না কেন, ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্য ধরলে একদিন সকল ধরনের দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-আপদ কেটে যাবে। কোনো কাজে ব্যর্থ হলে আবার চেষ্টা করতে হবে। একদিন সফলতা আসবেই।

মানুষের জীবন কখনোই ফুলশয্যা নয় যে, আরাম আয়েশেই সব সময় জীবন কেটে যাবে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, সফলতা-ব্যর্থতা এসবই কিন্তু জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারো জীবনেই শুধুমাত্র সুখ, আনন্দ এবং সফলতা থাকে না। আবার কারো জীবনেই শুধুমাত্র দুঃখ, বেদনা এবং ব্যর্থতাও থাকে না। ধনীর জীবনে যেমন সুখ এবং সফলতা আছে, ঠিক তেমনি তাদের জীবনেও দুঃখ এবং ব্যর্থতা আছে। একইভাবে গরিবের জীবনে দুঃখ এবং ব্যর্থতার পাশাপাশি সুখ এবং সফলতাও আছে। জীবন হচ্ছে একটি বহমান নদীর মতো, যেটি সবসময় বয়ে চলে। নদীতে যেমন জোয়ার ভাটা থাকে, ঠিক তেমনি মানুষের জীবনেও সুখ-দুঃখ এবং সফলতা-র্ব্যথতা থাকে। সুতরাং জীবনের প্রতি সবসময় ইতিবাচক থাকতে হবে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রত্যেকেরই বিরাট ভূমিকা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে সবাইকে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। আত্মহত্যার কারণে কারো জীবন যেন অকালে শেষ হয়ে না যায় এবং কারো বুক যেন খালি না হয় তার জন্য আমাদের সবাইকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের সবার সহযোগিতায় আত্মহত্যা নামক সামাজিক ব্যাধিটি চিরতরে নির্মূল হোক, এটিই প্রার্থনা।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার