ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

দেশে-বিদেশে বাংলাদেশিদের দাসত্ব ও মানবিক বিপর্যয়

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৫ জুন ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০৫ জুন ২০২৪, ১২:১১ এএম

একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার সোপান হচ্ছে, সে দেশের তরুণ সমাজের মেধা, শ্রম, উদ্ভাবনী প্রতিভার পরিকল্পিত ও সম্মিলিত প্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে দেশের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষা, বিশেষায়িত ও গবেষণামূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ কর্মসংস্থান পরিকল্পনার বিশেষ ভূমিকা থাকে। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় বিশ্বের ডেমোগ্রাফি ও জনকাঠামো এক জটিল সমীকরণ লাভ করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে জমির উর্বরতা হ্রাসের মতো মানুষের প্রজনণক্ষমতাও নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পতিত হতে শুরু করেছে। অনেক দেশেই মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সাথে সাথে বয়োবৃদ্ধ মানুষের গড় হার বাড়ছে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, তাদের তরুণ প্রজন্ম তথা কর্মশক্তির আনুপাতিক হার কমছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বেশি পজিটিভ ও সম্ভাবনাময়। আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্তত কোটি শিক্ষার্থী আগামী দিনের সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার দীক্ষা নিচ্ছে। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিপুল উচ্চশিক্ষিত কর্মশক্তির বাইরেও ঝরে পড়া অথবা শিক্ষা বঞ্চিত কর্মশক্তি সমাজে নানা পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। কৃষক, কামার-কুমার, জেলে, তাঁতি, ছুঁতারের অবদানে আমাদের আবহমানকালের জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে উঠেছে। অর্থনীতি ও তথ্য প্রযুক্তির বিশ্বায়ণের প্রভাবে এখনকার যুব সমাজ বৃহত্তর বৈশ্বিক কর্মক্ষেত্রের পরিমন্ডল গড়ে তুলেছে। তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে এ সময়ের তরুনরা ঘরে বসেই যেমন ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজের মেলবন্ধনে যুক্ত হতে পারছে, তেমনি মেধাপাচারের প্রলোভন ও দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন মেটাতে নানা প্রকার ইমিগ্রেশনে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে লাখ লাখ তরুন। একইভাবে আমাদের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, ইপিজেড এবং মেগা প্রকল্পগুলোতেও হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছে। আশির দশকের শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি ও শিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আমাদের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে শুরু করেছিল। প্রতিবেশী দেশের য়ড়যন্ত্রে পাটশিল্প ধ্বংস হওয়ার পর তারই ধ্বংসাবশেষের উপর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়েছে রফতানিমুখী গার্মেন্ট শিল্প। শ্রমঘন রফতানিমুখী শিল্প বিনিয়োগ দেশে কর্মসংস্থানের বিশাল ক্ষেত্র প্রস্তুত করায় বিদেশমুখী অদক্ষ জন¯্রােত কিছুটা হলেও দেশের কর্মক্ষেত্রে থিতু হতে সহায়ক হয়েছিল। কিন্তু গত দেড় দশকে দেশে এমন কী ঘটে গেল যে আমাদের রফতানিমুখী শিল্পখাতগুলোতে লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দিতে হলো? দেশের গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল ও এক্সেসরিস আমদানি করে পোশাক সেলাই করে বিদেশে রফতানি থেকে যে আয় হয়, তার মূল কারিগর এ খাতের শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা। লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিক, সে লাভের গুড় নিজ দেশে পাচার করে দিয়ে শিল্পের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে অনেকটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের বেশিরভাগই ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে কাজ করে নিজদেশে টাকা পাঠাচ্ছে। এই আয়ের কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। তাদের কাছ থেকে আমাদের সরকার কোনো রাজস্ব পায় না। এমনকি তাদের সঠিক পরিসংখ্যানও আমাদের সরকারের হাতে নেই।

আমাদের শিল্পকারখানা বন্ধ হলে, রফতানি বাজার হাতছাড়া হলে, কৃষি উৎপাদন ব্যহত হলে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পথ হারালে, গণতন্ত্র উচ্ছন্নে গেলে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ও সম্ভাবনা থমকে দাঁড়ালেও প্রতিবেশী দেশ তার সুফল ঘরে তুলে নেয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ঠিক কত সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। বাস্তব প্রয়োজনে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি আমদানির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। আমাদের দেশ থেকে দক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি যেমন বিদেশে গিয়ে সে সব দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, একইভাবে কিছু সংখ্যক দক্ষ জনশক্তি আমাদের দেশেও বিদেশ থেকে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সংখ্যা কোন সেক্টরে কত? তারা কিভাবে নিয়োগ পাচ্ছে? বেতন হিসেবে কত টাকা নিয়ে যাচ্ছে? কতদিন বাংলাদেশে অবস্থান করছে? এসব তথ্যের হালনাগাদ পরিসংখ্যান সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে থাকার কথা। কিন্তু সরকারের কোনো দফতরের কাছেই দেশে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকের সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়না। এ নিয়ে দেশের সচেতন মহলে কৌতুহল ও চাপা ক্ষোভ রয়েছে। এ বিষয়ের পরিসংখ্যান ও সরকারের অবস্থান জানতে মাঝে মধ্যেই কেউ কেউ হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট যথারীতি সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে এ বিষয়ে পরিসংখ্যান জানাতে রুল জারি করলেও এখনো তার সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। সরকারি-বেসরতকারী কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরি না পাওয়া কতিপয় তরুন-তরুনীর করা এক রিটের শুনানিশেষে দেশে বিদেশি শ্রমিকের সংখ্যা কত তা জানতে চেয়ে গত সপ্তাহে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ পররাষ্ট্রসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্বনর, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পুলিশের মহাপরিচালকসহ আটজনকে কারণ দর্শানো নোটিশ এবং পুলিশ প্রধানকে প্রতিবেদন আকারে বিদেশি শ্রমিকের তালিকা হাইকোর্টে জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। অবৈধভাবে কাজ করা বিদেশি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, মর্মে রুল জারি করেছেন আদালত। রিটের পক্ষে আদালতে শুনানিতে অংশগ্রহণকারী আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে দেশে অন্তত ১০ লাখ বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে। এদের বেশিরভাগই ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কোনো ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই গার্মেন্ট কারখানা, বায়িং হাউজ, আইটি সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। যেসব পদে বিদেশিরা কাজ করছে, তার বিপরীতে দেশে যোগ্য প্রার্থীর সংখ্যা কত তাও জনতে চেয়েছেন আদালত। দেশের গার্মেন্ট সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে লাখ লাখ ভারতীয়সহ বিদেশিরা কাজ করলেও এসব পদের জন্য উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসলেও তারা কাজ পাচ্ছে না। বর্তমানে দেশে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশের বেশি বলে বিবিএস’র পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। এটা সাম্প্রতিক সময়ের সর্বোচ্চ রেকর্ড। এ রেকর্ড ক্রমশ তার পরিসীমা অতিক্রম করে চলেছে।

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে (৭মে) জাতিসংঘের অবিভাবসন বিষয়ক সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক অ্যামি পোপ ঢাকায় আন্তর্জাতিক অবিভাসন বিষয়ক একটি প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন করেন। নানা কারণে আন্তর্জাতিক অবিভাসন সম্পর্কিত বিষয়ে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান চাপ এবং ভ’মধ্যসাগরসহ বিভিন্ন নৌ রুট এবং স্থল সীমান্ত দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় অবিভাসন প্রত্যাশি লাখ লাখ মানুষের দৃশ্যপট এই বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। বৈশ্বিক রির্পোট প্রকাশকালে আইএমও পরিচালক অ্যামি পোপ উদ্বেগসহ বলেছেন, অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা যাওয়া অবিভাসন প্রত্যাশিদের মধ্যে শতকরা ১২ভাগ বাংলাদেশি। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলো থেকে প্রতিবছর বহুসংখ্যক মানুষ ইউরোপে অবিভাসনের জন্য বিপদসঙ্কুল পথে পাড়ি জমায়। সেখানে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশির সংখ্যা বিষ্ময়কর। ভূমধ্যসাগরে ইতালি, লিবিয়া, তুরস্কের কোষ্টগার্ডের হাতে প্রায়শ অবৈধ ইমিগ্রান্টদের নৌযান ধরা পড়ে। বৈরী আবহাওয়ায় ডুবন্ত কিংবা বিপদগ্রস্ত জাহাজ আটক হওয়ার পর সেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিদের উপস্থিতি দেখা যায়। এভাবেই প্রতিবছর ভূমধ্যসাগরে বাংলাদেশি অবিভাসন প্রত্যাশিরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। আমাদের শাসক শ্রেণী যখন দেশকে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার মত সমৃদ্ধ, শক্তিশালী করে তুলছেন বলে দাবি করছেন, তখন দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত তরুনরা লাখে লাখে দেশ ত্যাগে এমন মরিয়া হয়ে উঠেছেন কেন? দেশের হাজার হাজার ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ ও স্বচ্ছল পেশাজীবী সেকেন্ড হোম ও ট্যাক্স হ্যাভেন বেছে নিয়ে বিদেশে পুঁজি ও সম্পদ পাচার করছেন কেন? এদের মধ্যে অনেকেই ব্যাংক জালিয়াতি, ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি তহবিল তছরুপ করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, আবার অনেকে শুধুমাত্র দেশে নিরাপত্তাহীনতার কারণে সম্পদ বিদেশে পাঠিয়ে অভিবাসী হয়ে শান্তিতে বসবাসের জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন।প্রায় প্রতিটি মানুষের নিজ দেশকে ঘিরে স্বপ্ন, ভালবাসা, মমতা ও সহজাত কমিটমেন্ট থাকে। দেশে ন্যুনতম নিরাপত্তা থাকলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক সুবিধা নিয়ে কেউ বিদেশে যায় না। দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ,লুটপাটের অর্থনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে যে নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তা নতুন প্রজন্মকে বিদেশমুখী করে তোলার নেপথ্য ভূমিকা রাখছে। কতটা অসহায়, বিতৃষ্ণ এবং বেপরোয়া হলে একেকজন টগবগে তরুণ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রপথে অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট হতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিতে বাধ্য হতে পারে! স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে এমন বাংলাদেশ কারোই প্রত্যাশিত ছিল না। আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে যে উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, তা উন্নয়নের কোনো মানদন্ডকেই ধারণ করেনা। এ পরিস্থিতি দেশকে ক্রমশ অনিরাপদ, ভঙ্গুর, দেউলিয়া ও লজ্জাজনক বাস্তবতার মুখোমুখী দাঁড় করিয়েছে।

বিদেশের কারাগারে কত সংখ্যক বাংলাদেশি জেল খাটছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিশ্বের অন্তত ৪২টি দেশের কারাগারে অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশী কারাভোগ করছেন বলে জানা যায়। সাম্প্রতিক রিপোর্টে এদের বেশিরভাগই অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন। দেশের কারাগারে এই মুহূর্তে ধারণক্ষমতার তিনগুনের বেশি মানুষ কয়েদ আছেন। আমরা দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা বলছি। এটি এমন একটি সংস্কৃতি যখন, জালজালিয়াতি করে জনগনের. রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা চুরি করে চোরেরা ভিআইপি তকমা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর ৫-৭ হাজার টাকার কৃষিঋণ নিয়ে সময় মত শোধ করতে না পারায় কৃষকের কোমড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতে হাজির করা হয়। যখন পেশাদার খুনি-দাঙ্গাবাজ দুষ্কৃতিকারী ব্যক্তিরা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দুর্দোন্ড দাপটে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়, আর রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে নিরপরাধ হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে ৫-১০টি মামলা-হুলিয়ার খড়গ মাথায় কারাবন্দি জীবন কাটাতে হয়। কোনো অপরাধ না করেও দেশে বেকারত্ব ও পলাতক জীবনের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোকেই শ্রেয় মনে করছেন অনেকে। এক শ্রেণীর মতলববাজ টাউট সরকারি ছত্রছায়ায় এদের নিয়ে প্রাগৈতিহাসিক কালের দাসদের মত আচরণ করছেন, দাস বিক্রির মত অনৈতিক মুনাফাবাজিতে লিপ্ত হয়েছেন। বৃহত্তম শ্রমবাজার সউদি আরব কিংবা মালয়েশিয়ার কারাগারে হাজার হাজার বাংলাদেশি বন্দীর কাহিনী আমরা জানি। সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশ মেক্সিকো, ইউরোপের ছোট্ট দেশ মাল্টা কিংবা উপমহাদেশের ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের মাফুসি কারাগার হাজার হাজার বাংলাদেশি কারাবন্দী দেশের ভাবমর্যাদাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। রাজনৈতিক কারণে দেশের কারাগারে নিরপরাধ মানুষের বন্দিত্বের প্রভাব বিদেশেও পড়ছে। বেকারত্ব ঘোচাতে, নিরাপত্তাহীনতার কারণে, যেনতেন প্রকারে বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি বিদেশের কারাগারে যাচ্ছে। এ এক মারাত্মক দুষ্টচক্র। অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিভিন্ন দেশে নানা ধরণের সামাজিক সংকট সৃষ্টি করছে। এরা নিজেরাও এক প্রকার দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়ছে।

দেশে দেশে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশ ছেড়ে উন্নততর জীবনের খোঁজে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু মালয়েশিয়া, সউদী আরব কিংবা মালদ্বীপের মত দেশে হাজার হাজার বাংলাদেশি এমন পঙ্গপালের মত কারাবন্দি হওয়া অথবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগরে ইঁদুরের মত ভাসতে ভাসতে সলিল সমাধি বেছে নেয়ার মত পরিস্থিতি বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা ও বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। মালয়েশিয়া সরকার কয়েকটি দেশের শ্রমিকদের জন্য কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শীঘ্রই বাংলাদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর দেশীয় আদম বেপারী ও মালয়েশিয়ার রিক্রটিং এজেন্সিগুলো তড়িগড়ি করে হাজার হাজার শ্রমিককে উড়িয়ে নিয়ে সেখানকার বিমানবন্দরে এক অমানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আইনের জটিলতায় আটকে পড়া অভিবাসিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার যেন কেউ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের আর্তি-আহাজারির করুন দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানবেতর অবস্থা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। ভুলকার তুর্ক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো মালয়েশিয়ায় ভাগ্য-বিড়ম্বিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবস্থাকে আধুনিক দাসত্ব বলে বর্ননা করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে তিনি মালয়েশিয়া সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সাথে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলবেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিষয়ে বিশেষ তৎপরতা দেখালেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, প্রবাসি কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বন্দিত্ব ও দাসত্ব বরণের নেপথ্যে যেসব ক্রিমিনাল রিক্রুটিং এজেন্সি, আদম বেপারি, এমপি, মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তা জড়িত তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দেশকে বিচারহীনতার সংষ্কৃতি থেকে বের করে আনতে না পারলে, দেশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করতে না পারলে দেশে-বিদেশে এদেশের মানুষকে এমন দুর্ভোগ-দর্গতি ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার