বাজেট : উৎপাদনমুখী খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে
০৬ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম
আজ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন। চলতি বাজেটের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাড়িয়ে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার (৫ লাখ কোটি টাকা) চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে মোট বাজেট ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে জোগান দেওয়া গেলেও ঘাটতির বাকি ৩২ শতাংশের যোগান দিতে নেওয়া হবে দেশি-বিদেশি ঋণ। এবারও বাজেট রাজস্ব প্রাপ্তির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা থাকছে; সঙ্গে যোগ হচ্ছে ব্যয় সংকোচন নীতি, যে কারণে এবার বাজেট ঘাটতি সামান্য কমলেও আয়-ব্যয়ের ঘাটতি এখনও বিপুল। ঘাটতি পূরণে বিকল্প কম, সেই ঋণ নির্ভরতাই প্রধান সমাধান। এবারও অপেক্ষাকৃত কম সুদের বিদেশি ঋণের পরিবর্তে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি সুদের ঋণের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলতে থাকায় তা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ নেওয়ায় তারল্য সংকট পরিস্থিতিও দেখা দিয়েছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বারবার চাপের মুখে পড়ার কথা বলে আসছেন তারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ভর্তুকি কমানো উচিত। বাজেটে ঘাটতি বেশি হলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়াবে। ফলে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। আবার দেশের রিজার্ভ কম থাকায় অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাচ্ছে। সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের সিংহভাগ খেয়ে ফেলছে। বাজেটে এসব বিষয় ভারসাম্য থাকা চাই।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে এবারের বাজেটে আগের বছরের তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ কমে যাচ্ছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বা ১ দশমিক ১৬ শতাংশ। সূত্র থেকে জানা গেছে বাংলাদেশের জিডিপি আকার ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা অর্থবছর শেষে আরও কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত ২২%। বর্তমানে মোট ঋণের ৬৩% অভ্যন্তরীণ খাত থেকে, ৩৩% বিদেশি ঋণ। ঘাটতি পূরণে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও এ বাজেটে তা আরও বাড়িয়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এখানে অনুদান বাবদ ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেট হিসাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধরা হলেও আগামী বাজেটে তা ধরা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ধরা হলেও নতুন অর্থবছরে ধরা হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশি ঋণের হার কমলেও দেশি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে ৯ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আভাস মিলছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এবারেও ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো হচ্ছে, যেখানে সুশাসন বা কৃচ্ছতাসাধন বা ব্যয় সাশ্রয়ী অনুপস্থিত। তার বিপরীতে উচ্চাভিলাষী বাজেট দেওয়া হচ্ছে এবং খরচ বাড়ানো হচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন কেনাকাটাযর ক্ষেত্রে যেন খরচ বাড়িয়ে কেনা না হয়, যে বছরের প্রকল্প সে বছরেই শেষ করা উচিত। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে খরচ বাড়ানো ঠিক না।
অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়িয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ দিতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। বর্তমান অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক নিম্নমুখী উচ্চ মূল্যস্ফীতি র্দীর্ঘদিন ধরে বজায় রয়েছে। বেড়েছে মানুষের কষ্ট। বৈদেশিক মুদ্রার পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। শুধু ডলারের কারণে নড়বরে হয়েছে অর্থনীতির অনেক সূচক, ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি করলেও মূল্যস্ফীতি কমছে না। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে অর্থনীতির সূচকগুলো খারাপ হতে থাকে। ব্যাংক খাতসহ অর্থনীতির খাতগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম জবাবদিহির ঘাটতি, অর্থপাচার ও শৃঙ্খলাহীনতার কারণে মূল কাঠামোগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাধারন মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা ২০২২ সালের এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.২৯ শতাংশ গত এপ্রিলে তা বেড়ে হয়েছে ৯.৭৪ শতাংশ। আগামীতে জনগণকে স্ব^স্তি দেওয়ার জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ জোরদার করা উচিত।
উৎপাদনমুখী খাতগুলোর প্রতি জোর দেওয়া উচিত। তাই কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি ও রপ্তানিমুখী খাতসমূহের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। আগামী অর্থ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সহজে ও দ্রুত উৎপাদনমুখী প্রকল্প বরাদ্দ বাড়ানো উচিৎ। জানা গেছে, এডিপিতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য সব মিলিয়ে ৭৬৬টি নতুন প্রকল্প অর্ন্তভূক্ত করেছে। এর মধ্যে ৬৮২টি প্রকল্পকে ‘উচ্চ’ অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮২টি প্রকল্পকে মধ্যম এবং ১৪টি প্রকল্পকে নিম্ন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে দেখা উচিৎ এসব প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণ সরাসরি উপকৃত হবে কিনা। বর্তমানে অর্থনীতিতে সংকট আছে। রাজস্ব আদায়ও কাক্সিক্ষত মানের হচ্ছে। তাই এসব প্রকল্প কোনভাবে কোনো উচ্চ অগ্রাধিকার হতে পারে না। যেখানে ২৭০ কোটি টাকা কর্মসংস্থান ব্যাংক ভবন নির্মাণ ও ১১৫ কোটি টাকার মিরপুর তাত বোর্ড কমপ্লেক্স নির্মাণ ও সরকারের উচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। অথচ, এডিপির প্রায় পুরো অর্থই আসবে দেশি বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে। অর্থনীতির ভালো সময়ে ভবন নির্মাণ প্রকল্প করা জরুরি, সার্কিট হাউস ও সরকারি কর্মচারীদের ফ্ল্যাট না দিলেও কোনো ক্ষতি নাই।
এখন প্রয়োজন সংকট উত্তরণ, উৎপাদন বাড়বে, রপ্তানি বাড়বে এমন খাতগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উপর বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। শিক্ষা খাতে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম স্বচ্ছতার সঙ্গে তদারকি করে গবেষণা প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এই মুহূর্তে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে প্রবৃদ্ধি অর্জনে কোনো ধরনের লাভ হবে না। চলতি অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি ৬.৫০ শতাংশ ধরা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্য মাত্রার মধ্যে আনা সম্ভব নয়। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৬৭ শতাংশ। আগামী অর্থ বছরের মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ ধরা হবে বলা হচ্ছে, যা অর্জন করা দূরহ হয়ে পড়বে। অর্থনীতির আকার এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষের লেনদেনের জন্য আর্থিক খাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিড়িয়ে আনা ও কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাজেটের বরাদ্দ থাকা উচিৎ। জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ভারসম্যপূর্ণ কার্যকর বাজেট সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল
‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের
সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ
গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই
নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি
স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন
গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন
চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ
সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে
নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন
ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা
আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার
জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন
গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক
ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার
উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার