ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণে ব্যর্থতার দায় সরকার এড়িয়ে যেতে পারে না

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৬ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৬ জুন ২০২৪, ১২:০৩ এএম

বৈদেশিক কর্মসংস্থান দেশের রেমিটেন্স প্রবাহ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সত্তুরের দশকের শেষদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নবযাত্রা সূচিত হয়। নব্বই দশকে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাত ধরে সে দেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের সুযোগ এ ক্ষেত্রে এক নতুন মাইল ফলক হয়ে ওঠে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এক শ্রেণীর রেক্রুটিং এজেন্সি ও আদম বেপারির দৌরাত্ম্য, কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায়ের মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের ঋণের জালে বন্দি করে বিদেশে পাঠানো হলেও তাদের যথাযথ কর্মসংস্থান প্রক্রিয়া ও আইনসম্মত বেতন-ভাতাসহ প্রাসঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো সম্পর্কে রিক্রুটিং এজেন্সি ও সরকারি মিশন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। এ কারণে হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় মানবেতর জীবন বেছে নিতে হয়েছে। এহেন বাস্তবতা মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের জন্যই বিব্রতকর ও লজ্জাজনক। শ্রমিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করে স্বল্প মজুরির চাকরিতে নিয়োগের ফলে নির্ধারিত সময়ে তারা খরচের টাকা উঠাতে না পারায় নানাবিধ সংকটের সৃষ্টি হয়। এ কারণে মালয়েশিয়া সরকার শ্রমিক পাঠাতে খরচ কমানোসহ নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করতে উদ্যোগী হলেও কোনো উদ্যোগেই সুফল পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতাকেই দায়ী করা যায়।একেকজন কর্মীর কাছ থেকে নির্ধারিত ব্যয়সীমার কয়েকগুণ বেশি টাকা আদায় করা হলেও তাদের নিয়োগের পর রিক্রুটিং এজেন্সি ও সরকারের সংশ্লিষ্টরা কোনো খোঁজ খবর রাখে না। তাদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকে না।

বেশ কয়েক বছর বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ থাকার পর দু’বছর আগে তা পুনরায় চালু হলেও যে সব শর্তে ও কারণে মালয়েশিয়া নিয়োগ বন্ধ করেছিল তার গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়নি। মালয়েশিয়ায় হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের দুর্ভোগ-দুর্দশা নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ ও যথেষ্ট তৎপরতা দেখা গেলেও বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় ও দফতরগুলো কুম্ভকর্ণের মত আচরণ করেছে। তারা যেন সবকিছু মুনাফাবাজ, দুর্নীতিবাজ রিক্রুটিং এজেন্সি এবং আদম বেপারিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। বেশ কয়েক মাস ধরেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নানামুখী টানপোড়েন চলছিল। অর্থনৈতিক সংকট ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় মালয়েশিয়া সরকার বিদেশি শ্রমিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। ই-ভিসা প্রাপ্ত শ্রমিকদের শর্তসাপেক্ষে ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ দেয়ার সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছিল কয়েক মাস আগেই। এ সময়ের মধ্যে কর্মী বাছাই, যাতায়াতের ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ভিসা প্রাপ্ত ও সম্ভাব্য আরো হাজার হাজার শ্রমিকের মালয়েশিয়ায় নিয়োগ চুড়ান্ত করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক সংকট, বিমান টিকেটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ সামগ্রিক প্রতিবন্ধকতাসমুহ দূর করে ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কার্যক্রম নিশ্চিত করতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ব্যর্থতার কারণে সীমাহীন খেসারত দিতে হচ্ছে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের। প্রয়োজনীয় সব খরচসহ প্রস্তুতি সমাপ্ত করেও অন্তত ১৭ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না পারার বিষয়টি এখন আন্তজার্তিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিনত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভুলকার তুর্ক এ বিষয়ে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার জন্য মালয়েশিয়ায় যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরের পরিবেশ সুবিধা বঞ্চিত হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিকের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সময়মত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলেও শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়া সরকারের কাছে সময় বৃদ্ধির যে প্রস্তাব করেছিল, মালয়েশিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছে। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতু সেরি সাইফুদ্দিন নাসিসুন ইসমাইল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন তাদের অপরাগতার কথা জানিয়েছেন। ই-ভিসাপ্রাপ্ত ১৭ হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে। এসব শ্রমিক তাদের ক্ষতিপুরণসহ সব টাকা ফেরত পাওয়ার হকদার। জাতিসংঘের চাপ এবং মালয়েশিয়া সরকারের সক্রিয় উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও মালয়েশিয়ায় নিয়োগ প্রার্থী লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও প্রাথমিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার নামে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার সাথে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সরকারীদলের কতিপয় এমপিসহ প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশের বিষয়টি ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে উঠে আসলেও তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সাবেক অর্থমন্ত্রী ও তার স্ত্রী, ফেনির এমপি নিজাম হাজারী, ঢাকার এমপি বেনজির আহমেদ এবং জাতীয় পার্টির এমপি মাসুদ উদ্দিনের নাম উঠে এসেছে। বায়রার পক্ষ থেকে শ্রমিকদের টাকা ফেরতের আশ্বাস বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ও ভাগ্য বিপর্যয়ের নেপথ্যে থাকা কুশীলবদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। অর্থনৈতিক সংকটের দোহাই দিয়ে দেশের বিমান সংস্থা ও এভিয়েশন ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেশের প্রবাসি কর্মী ও বিমান যাত্রীদের দিল্লী-কলকাতায় যেতে বাধ্য করার নেপথ্য বিষয়াদিও তলিয়ে দেখতে হবে। ১৭ হাজার কর্মীর মালয়েশিয়া যাত্রা নিশ্চিত করতে বিশেষ ফ্লাইটসহ আনুসাঙ্গিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। মালয়েশিয়ার পাশাপাশি, সউদি আরব, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারকেও অনাকাঙ্খিত জটিলতার মুখে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা এখনই মোকাবেলার উদ্যোগ না নেয়া হলে দেশের অর্থনীতি বড় ধরণের সংকটের মুখে পড়বে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার