ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

যৌতুক মামলা গুরুত্ব হারাচ্ছে

Daily Inqilab অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

০৮ জুন ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০৫ এএম

স্ত্রীদের একটি সহজ হাতিয়ার হলো যৌতুকের মামলা। সোজা কোর্টে গিয়ে নালিশী আরজির মাধ্যমে জানানো, ‘স্বামী আমার কাছে যৌতুক চেয়ে না পেয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে, মারধর করেছে, নির্যাতন করেছে ইত্যাদি’। আবার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর স্ত্রী তালাকের নোটিশ পেয়ে কিংবা নোটিশ গ্রহণ না করে কিংবা তালাক সম্পর্কে জানতে পেরে স্বামীর বিরুদ্ধে ঠুকে দেয় যৌতুকের মামলা। কিন্তু এ জাতীয় যৌতুকের মামলা আর মানুষ আগের মতো বিশ^াস করে না।

কারণ, যৌতুকের মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে। তালাকের পর দেনমোহর মামলার ক্ষেত্রে আইনী বাধা নেই। তবে যৌতুকের মামলার জন্য বিবাহ বলবৎ থাকা জরুরি। এ ব্যাপারে মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুম জিনাল আরা বনাম শাহিদুল এবং অন্যান্য মামলা, যা ২ এলএনজে, ২০১৩, ২৩৫ পৃষ্ঠায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ) ধারার অধীনে করা হয়। অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করা হয়েছে বলে মামলাটি করা হয়। আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, মামলাটি করার আগে পক্ষদ্বয়ের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে এবং বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, বিচ্ছেদের পর যৌতুকের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

উচ্চ আদালতের আরও দুটি সিদ্ধান্ত, যা রওশন আরা বেগম বনাম মো. মিজানুর রহমান ও অন্যান্য, হাইকোর্ট বিভাগ, ১২ এডিসি, পৃষ্ঠা-৯৬ এবং রাষ্ট্র বনাম মো. রফিজুল হক, ৬ এএলআর (এডি), ভলিউম-২, পৃষ্ঠা-৯০। হাইকোর্ট এ মামলায় পর্যবেক্ষণে বলছেন, বিবাহ বিচ্ছেদ আগেই হয়েছে। কাজেই কজ অব অ্যাকশনের দিনে ভিকটিমকে তার স্বামীর বাড়িতে থাকার কথা নয়; কিন্তু এ জাতীয় একটি মামলায় ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৬৫(সি) ধারামতে অব্যাহতির আদেশ চেয়ে করা আবেদনটি খারিজ করে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে।

আসামিপক্ষ উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন দাখিল করে। হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে উক্ত অভিযোগ গঠন বাতিল করে আসামিকে অব্যাহতি দেন। এরপর বাদী (রাষ্ট্র) পক্ষ হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগ সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেন যে, অভিযুক্ত স্বামীকে খালাস দেয়ার হাইকোর্টের আদেশ সঠিক। কাজেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একেবারেই বনিবনা না হলে স্ত্রীকে সঠিক নিয়ম মেনে তালাক দেয়ার পর স্ত্রী কর্তৃক মিথ্যা যৌতুকের মামলার ফলাফল বাদীর পক্ষে প্রমাণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।

কাজেই কেউ যদি স্ত্রী কর্তৃক মিথ্যা মামলার শিকার হয়েই যায়, তাহলে আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটি লড়ে যেতে হবে। এজাহারের কপিটি সংগ্রহ করতে হবে। যদি এমন হয় যে, জানার আগে হঠাৎ পুলিশ এসে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেল, সেক্ষেত্রে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে প্রেরণ করতে হবে। তখন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করতে হবে। যদি দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিক থাকে, তাহলে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই মিলবে।

আরেকটি কেস স্টাডি থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সালমা সুলতানা নামের এক নারীর সঙ্গে শফিকুর রহমানের বিয়ে হয়। সালমা ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর স্বামীর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় মামলা করেন। মামলায় বাদী পক্ষে উল্লেখ করে, বিয়ের কিছুদিন পরই সালমা বুঝতে পারেন তার স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্ত। তিনি (সালমা) শ্বশুর-শাশুড়িকে বিষয়টি জানান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন।

কিন্তু শফিকুর জানান, তিনি অসুস্থ কিংবা হতাশাগ্রস্ত নন। সালমা মনে করেন, তার স্বামী পরধন লোভী। সে জন্যই ব্যবসার কথা বলে তার (সালমা) কাছে পাঁচ লাখ টাকা চান। বাবার বাড়ি থেকে ওই টাকা এনে দিতে অস্বীকার করায় তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে সালমা বাবার বাড়ি চলে যান। কিছুদিন পর তাকে ফিরিয়ে আনেন শফিকুর। কিন্তু তার (শফিকুর) স্বভাব পরিবর্তন হয় না। ২০০৯ সালের ২০ মে আবার পাঁচ লাখ টাকা এনে দিতে চাপ দেন। এবার শফিকুর বলেন, তিনি ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান।
সালমা ফের টাকা এনে দিতে অস্বীকার করেন। এতে তাকে নির্যাতন করা হয়। সালমা স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাবার বাড়ি যেতে বাধ্য হন। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর সালমার বাবার বাড়ি গিয়ে একই পরিমাণ টাকা দাবি করেন শফিকুর। টাকা না দিলে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। পরে বাধ্য হয়ে সালমা তার (শফিকুর) বিরুদ্ধে মামলা করেন।

নিম্নআদালত শফিকুরের বিরুদ্ধে মামলটি আমলে নেন। পরে মামলা বিচারের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-১৮-তে স্থানান্তর করলে বিচারক আসামি শফিকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। শফিকুর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা বেআইনি হয়েছে উল্লেখ করে মামলা কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট কেন মামলার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে রুল জারি করেন। সেই রুলের শুনানি শেষে আদালত রায় দেন। আদালত রায়ে বলেন, আইনে স্পষ্ট রয়েছে, বিয়ের সময়কার শর্ত হিসেবে বিয়ের মজলিসে কিংবা বিয়ের আগে অথবা পরে কোনো সময় অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে তা যৌতুক হিসেব গণ্য হবে। (এনএম শফিকুর রহমান বনাম রাষ্ট্র, ৭ এএলআর, পৃষ্ঠা ৩১৩)।

আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, যৌতুকের মামলা শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নয়। স্ত্রীও যদি বিয়ের শর্ত হিসেবে দেনমোহর ব্যতীত অন্যান্য অর্থসম্পদ দাবি করে সেটা যৌতুক এবং এর জন্য প্রচলিত আইনের অধীনে আদালতে মামলা করা যায়। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, যৌতুকের জন্য মিথ্যা অভিযোগ করলে সেই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদ- বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। আবার ১৮৬০ সালের দ-বিধির অধীনেও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দ-বিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলা করলে তার জন্য শাস্তি হবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-।

যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে এ ধারার অধীনে মামলা করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারবেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার