ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

মোদির দর্প চূর্ণ : শরীকদের চাপের মুখে তার তৃতীয় মেয়াদ শুরু

Daily Inqilab সৈয়দ ইবনে রহমত

০৮ জুন ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ১২:০৫ এএম

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে টানা তৃতীয়বার জিতে এনডিএ জোটের নেতা হিসেবে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। তবে এবারের জয় ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের জয়ের তুলনায় ভিন্ন, যা মোদির জন্য ঠিক জয় হিসেবে দেখতে চাইছেন না পর্যবেক্ষকরা। কারণ, ক্ষমতায় বসতে হলে ৫৪৩ আসনের লোকসভায় অন্তত ২৭২ আসন দরকার। ২০১৪ সালে মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টিÑ বিজেপি ২৭২ আসনে জিতে সরকার গঠন করেছিল এবং ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ৩০৩-এ পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপটে দল এবং এনডিএ জোটের মধ্যে মোদি তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জোটে অনেক শরীক দল থাকলেও তাদের খুব একটা পাত্তা দেওয়ার দরকার পড়েনি। যখন যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই গোটা ভারতকে শাসন করেছেন এক হাতে। বিরোধী দল, বিরোধী মত, এমনকি গণমাধ্যমকে দলন, পীড়ন, দমন করেছেন কঠোর থেকে কঠোরতরভাবে। এর জন্য রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যেমন ব্যবহার করতে ছাড়েননি তিনি, তেমনি ভারতের গর্ব ও অহঙ্কারের জায়গা ছিল যে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, তাকেও কলুষিত করতে পিছপা হননি।

শুধু বিরোধী মত বা দলকেই নয়, বরং সংখ্যালঘু মুসলমান, দলিত হিন্দু এবং বিভিন্ন তফশিলি উপজাতীয় জনগোষ্ঠির উপরেও চলেছে নিপীড়নের স্টিম রোলার। বিশেষ করে মুসলমানদের জীবনে অনেকটা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন মোদি। নির্বাচনকে সামনে রেখে তড়িগড়ি করে অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির উদ্বোধন করেন, যাকে বিরোধীরা ব্যাখ্যা করেন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ট্রামকার্ড হিসেবে। তারা বলেন, বিজেপি এবং তাদের আদর্শিক মূল সংগঠন আরএসএস এই রামমন্দির উদ্বোধনের মাধ্যমে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে হিন্দুদের উজ্জীবিত করে টানা তৃতীয়বারের মতো ভোটে জিতে দিল্লির ক্ষমতাকে আরো নিরঙ্কুশ করতে চেয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল দেখে এটা স্পষ্ট যে, তাদের সেই ট্রামকার্ড কোনো কাজে আসেনি। বরং যে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে তারা রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই রাজ্যেই তারা নির্বাচনে হেরেছেন চরমভাবে। ভারতের এই রাজ্যটিতে লোকসভার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৮০টি আসন রয়েছে, যার মধ্যে বিজেপি অন্তত ৭০টি আসন জিতে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার পরিকল্পনা করেছিল, সেখানে দেখা গেল, তারা পেয়েছে মাত্র ৩৩টি আসন। অন্যদিকে বিরোধী জোট উত্তর প্রদেশের ৪৩টি আসনে জয়ী হয়ে মোদির রামমন্দির এবং হিন্দুত্ববাদী ট্রামকার্ডকে অসার প্রমাণ করে ছেড়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই উত্তর প্রদেশের একটি আসনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী চার লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। সেখানে একই রাজ্যের অন্য একটি আসন বারাণসীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জিতেছেন মাত্র এক লাখের কিছু বেশি ভোট পেয়ে।

২০১৯ সালে বিজেপি এককভাবে পেয়েছিল ৩০৩ আসন এবং তাদের জোট এনডিএ পেয়েছিল ৩৫৩ আসন। এবার সেখানে তাদের লক্ষ্য ছিল আরো অনেক বড়। ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপির লক্ষ্য ছিল ৩৭০, আর জোট হিসেবে এনডিএ’র লক্ষ্য ছিল চারশ’রও বেশি। ১ জুন সর্বশেষ ধাপের ভোট গ্রহণ শেষে বুথফেরত জনমত জরিপের ফলও তাদের এই লক্ষ্যকেই সমর্থন করছিল। কিন্তু ৪ জুন সকালে ভোট গণনা শুরু হতেই উল্টে যেতে থাকে সকল হিসাব আর পূর্ব পরিকল্পনা। দিন শেষে দেখা যায় ৩৭০ তো বহু দূরের কথা, দল হিসেবে বিজেপি সরকার গঠনের ম্যাজিক সংখ্যা ২৭২ থেকেও বহু পিছিয়ে আছে, তারা পেয়েছে মাত্র ২৪০ আসন। অন্যদিকে এনডিএ জোটের শরীকদের পাওয়া আসনের যোগফল ২৯২, এই সংখ্যা তাদের সরকার গঠনের পথে যথেষ্ট হলেও বিজেপি এবং তার নেতা নরেন্দ্র মোদির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া তাদের ক্ষমতার আসনকেই নড়বড়ে দিয়েছে। এটা বুঝতে দেরি হয়নি মোদির। ফলে নির্বাচনী ফল ঘোষণা পরবর্তী ৩৪ মিনিটের বক্তব্যে যতবার না নিজের এবং নিজের দলের নাম নিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশিবার জোটের শরীকদের নাম উচ্চারণ করে তাদের প্রশংসা করেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিশেষ করে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার এবং অন্ধ্রপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর কথা বলেছেন বারবার, তাদের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে, যা কিনা মোদির অতীত কোনো ভাষণে কখনোই দেখা যায়নি। বিষয়টিকে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, “বিজেপি তথা এনডিএ’র অন্দরে মোদী-শাহ-নাড্ডা ত্রয়ীর প্রভাব কমছে আঁচ করেই সম্ভবত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিজেপির সদর দপ্তরে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বারবার এনডিএ’র জয়গান গেয়েছেন। স্বভাবসিদ্ধ আমিত্বের বাইরে বেরিয়ে ‘ম্যায়’ (আমি)’র পরিবর্তে ‘হম’ (আমরা) শব্দ ব্যবহার করেছেন।”

বাস্তবতা হলো এই, শরীকদের সমর্থন ছাড়া ক্ষমতা কিংবা প্রধানমন্ত্রিত্ব কিছুই থাকবে না মোদির। তাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে টিকে থাকতে হলে শরীক নেতাদের জয়গান করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তার। আপাতত শরীকদের লিখিত সমর্থন পেয়েছেন তিনি, তাতে টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রিত্বও নিশ্চিত হয়েছে। তবে এই প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ আগামী পাঁচ বছর টিকে থাকবে বলে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না ভারতের রাজনৈতিক কোনো বিশেষজ্ঞই। কারণ, এনডিএ’র শরীক রাজনীতির দুই অভিজ্ঞ খেলোয়াড় অন্ধ্রপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার দীর্ঘ সময় বিরোধী পক্ষ কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতি করেছেন। অন্যদিকে তাদের এনডিএ জোট থেকে এর আগেও বেরিয়ে যাওয়ার নজির আছে। ২০১৪ সালে এনডিএ জোটে থেকে নির্বাচন করার পরও বিহারের নীতীশ কুমার নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বকে মেনে নিতে পারেননি বলেই জোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া এই নীতীশ কুমার বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিরোধী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট গড়ারও অন্যতম কারিগর। যদিও নির্বাচনের কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া জোট থেকে বেরিয়ে এসে এনডিএ জোটে যোগ দিয়েছেন তিনি। তাই এবার যখন ক্ষমতার চাবি হাতে পেয়েছেন, তখন তিনি কখন কী করবেন, সেটা আগে থেকে অনুমান করা খুবই কঠিন। ইতোমধ্যেই এনডিএ জোটের মধ্যে শরীকরা দেনাপাওনা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হতে শুরু করেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। আর সেকারণেই নাকি শপথের তারিখ ৮ জুন নির্ধারণ করেও পিছাতে হয়েছে মোদিকে।

নরেন্দ্র মোদি আগের দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। এর ফলে তাকে আর কারো দিকে চেয়ে থাকতে হয়নি ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে। এর ফলে তিনি ছিলেন নির্ভার, নির্ঞ্জঝাট, অপ্রতিরোদ্ধ। ক্ষমতার এই নিশ্চয়তা তাকে দারুণভাবে অহঙ্কারি এবং একরোখা করে তুলে। গুজরাট দাঙ্গার কালো অতীতসহ নানা বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কারো মতামতের তোয়াক্কা করেননি। বিরোধী মতের গুরুত্ব দেয়া তো দূরের কথা, জোট শরীকদেরও খুব একটা পাত্তা দেননি। গণমাধ্যম তো কোন ছার। দেশীয় গণমাধ্যম তো বটেই, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে তছনচ করেছেন বিবিসি’র মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কার্যালয়কেও। এর জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়নি কোথাও। সেই একাধিপত্যের ছড়ি ঘুরিয়ে তিনি নিজেকে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে অবতারের কাতারে নিয়ে গেছেন। আর এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শরীকদের পাশে বসিয়ে তোয়াজ করতে হচ্ছে। তাদের দেনাপাওনার হিসাব মেলাতে কতটা সফল হবেন তিনি, তা নিয়ে এখন অনিশ্চয়তার মেঘ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে শপথ গ্রহণের আগেই নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু অর্থমন্ত্রীসহ ৬ থেকে ৭টি পূর্ণমন্ত্রী এবং আরো বেশ কয়েকজন প্রতিমন্ত্রীর দাবি জানিয়েছেন। তারা নিজ নিজ রাজ্যের জন্য উন্নয়নের বিশেষ প্যাকেজও দাবি করেছেন। তাছাড়া এনডিএ’র ছোট ছোট শরীকরাও মন্ত্রিত্বসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দাবি করছেন। শরীকদের সব দাবি না মানলেও, তাদের অনেক দাবিই যে মানতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে শরীকদের দাবি মেটাতে গিয়ে নিজ দলের নেতাদের অনেক দাবি-আবদারে স্বাভাবিকভাবে টান পড়বেই। তাতে বিজেপির মধ্যে গৃহদাহ শুরু হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাছাড়া বিভিন্ন রাজ্যে দলের বহু নেতার পরাজয়ের দায় নিয়েও শুরু হতে পারে কাঁদা ছোড়াছুড়ি। এর আভাস ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বোদ্ধা মহল দিতে শুরু করেছেন। আর এটা শুরু হতে পারে সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশ থেকেই।

লোকসভার সবচেয়ে বেশি আসন থাকা উত্তর প্রদেশের উপর বিজেপি এবং মোদির নির্ভরতা ছিল নানা কারণেই। বিশেষ করে যে হিন্দুত্ববাদী আওয়াজ তুলে বিজেপি আগের দুবার বিপুল ভোটে জয় পেয়ে ভারত শাসন করেছে, সেই হিন্দুত্ববাদী শ্লোগানের উচ্চকণ্ঠ আরেক নেতা যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। যিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে রাজ্যটিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নে রেকর্ড করেছেন। মুসলিম নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বুলড্রজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়ে ইতোমধ্যে ‘বুলড্রজার বাবা’ খ্যাতি লাভ করেছেন, বহু মুসলিম নেতার সম্পদ কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করেছেন, প্রকাশ্যে মুসলমানদের ইবাদত-বন্দেগি নিষিদ্ধ করাসহ নানা কা- করে আলোচিত হয়েছেন। সর্বোপরি রাজ্যটির অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ করে হিন্দুত্ববাদী ক্রেজকে চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তারপরও সেই রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩৩টি আসন পাওয়ার মাশুল দিতে হচ্ছে দিল্লিতে বসে খোদ মোদিকে। আরো অবাক করার বিষয় হলো, যে অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হলো, সেই আসনটিতেও বিজেপি জিততে পারেনি। তাদের এই পতনের যে লজ্জা, তা ভুলে যাওয়াটা কোনোভাবেই সহজ হবে না। বরং এর পেছনের কারণ নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি যে ইতোমধ্যে ভেতরে ভেতরে শুরু হয়ে গেছে সেটাই বলাবলি করছেন অনেকে। বস্তুত এটা হয়েছে মূলত মোদি-অমিতশাহ, আদিত্যনাথদের অতি অহঙ্কারের পরিণতি। কিন্তু তারা ক্ষমতার মোহে এতটাই অন্ধ হয়ে আছেন যে, ঘটনার পেছনের আসল সত্যিটা কখনোই উপলব্ধি করতে পারবেন বলে মনে হয় না।

যদি তারা ঘটনার পেছনের সত্যিকারের কারণ অনুসন্ধান করেন তাহলে দেখতে পাবেন, গত দশ বছরের শাসনামলে দেশটিতে তারা কী করেছেন। সংখ্যালঘু মুসলমানদের সাথেই বা তারা কী করেছেন। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, মোদির শাসনামলে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদ, সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনাদিকে চরম হুমকির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। তারা যে কেবল ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদই ভেঙ্গে দিয়ে তার জায়গা দখল করে নিয়েছে, তাই নয়, ঐতিহাসিক জ্ঞানবাপী ও ঈদগাহ মসজিদেরও একই পরিণতির জন্য তারা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন অজুহাতে বিশেষ করে গোরক্ষার নামে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বহু মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। জোরজবরদস্তি করে মুসলমানদের ধর্ম পরিবর্তন করে হিন্দু বানিয়ে তারা একে নাম দিয়েছে ‘ঘর ওয়াপসি’ তথা ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচি বলে। জাতীয় নাগরিক পুঞ্জির নামে আসামের অধিকাংশ মুসলমানের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে। তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকিও দিচ্ছে বিজেপির কোনো কোনো নেতা। অন্যদিকে কাশ্মীর ভারতের সংবিধান মোতাবেক বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী ছিল। সেটাও ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার কেড়ে নিয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ বাতিলের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন পেশ করা হয়েছিল। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট তার রায় দিয়ে মোদি সরকারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে। এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম ‘দ্য ইকনোমিস্ট’ সুপ্রিম কোর্টকে লক্ষ্য করে বলেছে, ‘ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাবে নিমজ্জিত। এক সময় ভারতের বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বলে অভিহিত করা হতো। প্রবল হিন্দুত্ববাদ সেই স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।’

ভারতের ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা শিক্ষা উঠিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলছে। মুসলমানরা মানবিক, নাগরিক ও সংবিধানিক অধিকার থেকে শোচনীয়ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে তারা বঞ্চিত। এরকম অবস্থায় ভারতীয় মুসলমানরা অতীতে আর কখনো পড়েনি। শুধু মুসলমান নয়, বরং শিখ, নিচু বর্ণের দলিত হিন্দু এবং বিভিন্ন তফশিলি উপজাতীয় জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধেও মোদির শাসন নানা নিবর্তনমূলক নীতি গ্রহণ করেছে। আর এসব করতে গিয়ে দেশটির নানা বর্ণ, ধর্মের বিপুল জনগোষ্ঠির মধ্যকার শত শত বছর ধরে বিরাজমান ঐক্যকে নষ্ট করছে মোদির শাসন। এর ফলে ভেতর থেকে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে বিশাল আয়তনের এই ভারতের টিকে থাকার মূল শক্তি জাতিগত বন্ধনের দৃঢ়তা। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কাশ্মির, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মণিপুরসহ বিভিন্ন রাজ্যে। অন্যদিকে দেশটিতে বাড়ছে বেকারত্ব, ঘনীভূত হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট, যার পরিণতিতে তরুণদের মধ্যে বাড়াচ্ছে হতাশা। ১৯৪৭ এর পর থেকে রাজ্যভিত্তিক বিকেন্দ্রীকরণ শাসন ব্যবস্থা যেখানে ভারতকে শক্তিশালী করেছিল, সেখানে মোদির বিজেপি শাসনামলে ক্ষমতাকে দিল্লির একচ্ছত্র অধীনে নেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি কেন্দ্রের নানামুখী নজরদারি বাড়ানোকে যার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এসব ব্যবস্থাও বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে, কেন্দ্রের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরাচ্ছে।

মোদির শাসনামল শুধু যে ভারতের জনগণের মধ্যেই বিভেদ তৈরি করেছে তাই নয়, বরং তার প্রতিবেশীদেরও করেছে ত্যাক্তবিরক্ত। যে কারণে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের মতো দেশের নাগরিকরাও ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এমনকি সম্প্রতি মালদ্বীপের মতো ক্ষুদ্র দেশও ‘ইন্ডিয়া হটাও’ শ্লোগান দিয়ে সেখান থেকে ভারতীয় সৈনিকদের বের করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সরকারের সাথে বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ের থাকলেও নানা কারণে এদেশের নাগরিকদের কাছে তারা ঘৃণিত, এমনকি বাংলাদেশেও ‘ইন্ডিয়া বয়কট’ এখন বেশ জনপ্রিয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যা কিনা তাদের অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এমন একটি বৈরী সময়ে এসে জোটের শরীকদের উপর নির্ভর করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটি সরকার গঠন করা নরেন্দ্র মোদির জন্য এক অনিশ্চিত পথই তৈরি করেছে। একে সফলতার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে কতটা সম্ভব হবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কেননা, একদিকে এ ধরনের দুর্বল সরকার সামলানোর অভিজ্ঞতা নেই মোদির, অন্যদিকে দুর্বল সরকারের উপর শরীক ও নিজ দলের নেতাকর্মীদের চাপও থাকে বেশি, যা সামলানো আরো কঠিন। এ অবস্থায় মেয়াদপূর্তি তো দূরের ব্যাপার, তার আগেই যেকোনো সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে সরকার।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক হালাল শোকেসের ২০তম আসরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত দেশকে অস্থিতিশীল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে পরাজিত শক্তি

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কাল

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

‘মব জাস্টিস’ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরামের

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

সাত দফা দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

গৌরনদীর দই, একবার খাইলেও আর একবার খাই

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

নোয়াখালীতে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বন্ধের দাবি

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড ২,৬০৯ ডলার ছাড়িয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ ও বিচার দাবিতে খুলনায় মানববন্ধন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি গণহত্যা ওআইসির নেতারা চেয়ে চেয়ে দেখছেন

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

চাঁদপুর শহরে সড়ক সংস্কার কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া প্রসঙ্গে

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

নোয়াখালীতে ৪৪ দিন পর লাশ উত্তোলন

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

ভারতের দোসর ও হাসিনামিডিয়ার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

আশাশুনিতে হাজরাখালির নেটপাটায় পানিবন্দি ২শ’ পরিবার

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের অধিকার খর্ব হবে না: সেলিম উদ্দিন

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

গাছে গাছে আফ্রিকান জায়ান্ট শামুক

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

ঈশ্বরগঞ্জে মহাসড়কে কাঁচাবাজার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রসহ আরসা সন্ত্রাসী গ্রেফতার