পিলখানা হত্যাকাণ্ড
১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৪ এএম

পিলখানা হত্যাকা- আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত বেদনাদায়ক, মর্মন্তুদ ও নজিরবিহীন হত্যাকা- হিসেবে বিবেচিত। এরকম হত্যাকা- সমকালীন বিশ্ব-ইতিহাসেও দেখা যায় না। এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর’র সদর দফতর ঢাকার পিলখানায়। তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে এই সুপরিকল্পিত হত্যাকা- ঘটানো হয়। এতে শীর্ষস্থানীয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হয়। এমন একটা সময়ে এই হত্যাকা- ঘটে যখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং সরকার প্রধান ছিলেন শেখ হাসিনা। সেই সময়ই এই হত্যাকা-ের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, একাধিক মন্ত্রী-নেতার আচরণ ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, যার কোনো সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে ১৫ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ নিয়ে তদন্ত, বিচার ইত্যাদি হয়ে গেছে। কিন্তু এই তদন্ত-বিচারে আস্থাহীনতার যাবতীয় উপাদান রয়ে গেছে। নিহত সেনাকর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা এ তদন্ত-বিচার মানেন না। পর্যবেক্ষকরাও তাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ তদন্ত ও ন্যায়বিচারের তাকিদ উচ্চারিত হলেও তা আমলে আনার গরজ দেখায়নি টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা হাসিনা সরকার। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ঘৃণ্যতম স্বৈরাশাসনের অবসান হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবে উৎখাত হয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। এখন পিলখানা হত্যাকা-ের নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে আগের তদন্ত ও বিচারের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার সময় এসেছে। গত পরশু মহাখালির রাওয়া ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন পিলখানা হত্যাকা-ের শিকার সেনাকর্মকর্তাদের সন্তান ও স্বজনরা। তারা বলেন, আমরা পিলখানা হত্যাকা-ের স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার চাই। বিগত সরকার তদন্ত ও বিচারে লুকোচুরি করেছে। আমরা তার অবসান চাই। সংবাদ সম্মেলনে কোনোরূপ রাখঢাক না করেই নিহত মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভুইয়া বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ ফজলে নুর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম।’ তিনি আরো বলেন, ‘পিলখানা হত্যাকা-ের পর দেশপ্রেমিক অনেক সেনা অফিসার বিচার চাইতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন। কেউ কেউ জেলে গেছেন। সেনা দরবারে শত শত অফিসারের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে। আমরা দাবি করছি, তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। আমরা সেসব দেশপ্রেমিক অফিসারের অবদান ভুলবো না। যেসব নির্দোষ দেশপ্রেমিক বিডিআর সৈনিক জেল খাটছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের যেন মুক্তি দেয়া হয়।’ সংবাদ সম্মেলনে ৭ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো প্রসঙ্গিক ও যৌক্তিক।
আমরা নয় মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছি। ওই লড়াইয়ে, লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, কত মানুষ যে আহত হয়েছে, তার হিসাব নেই। সম্পদ-সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে বেশুমার। কিন্তু ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ওই লড়াইয়ে আমাদের সামরিক অফিসার নিহত হয়েছেন হাতে গোনা। অথচ, দু’দিনের তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহে সেনা অফিসার হারাতে হয়েছে ৫৭ জন। এই সঙ্গে আরো ১৭ জন। কোনো কনভেনশাল যুদ্ধেও এত অফিসারের নিহত হওয়া বিরল ঘটনা। নিহত সেনা অফিসাররা কেবল দেশপ্রেমিকই ছিলেন না, পেশাগত ক্ষেত্রেও ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও খ্যাতিমান। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, পিলখানা হত্যাকা-ের মাধ্যমে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতার ওপর প্রচ- আঘাত করা হয়েছে। তাকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, যার জের এখনো বহমান। সশস্ত্রবাহিনী স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক, সুগঠিত ও প্রশিক্ষিত শক্তি। তার দুর্বলতা স্বাধীনতা-সার্বভৌত্বের হুমকি স্বরূপ। অনেকের মতে, পিলখানা হত্যাকা-ের পর আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব মোটাদাগে ভারতের হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। বিডিআর, যা এখন বিজিবিÑ সীমান্তে তার নতজানু ভূমিকার কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। বিএসএফ পাখির মতো বাংলাদেশি মারছে, অথচ বিজিবি মিষ্টি বিতরণ ও রাখিবন্ধনেই বেশি উৎসাহী। বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর সক্ষমতা হ্রাস পেলে বা এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি দুর্বল হয়ে গেলে কার সবচেয়ে বেশি লাভ? বলা বাহুল্য, ভারতের। এ নিয়ে তখনই কথা উঠেছিল। বলা হয়েছিল, ভারত এর পেছনে রয়েছে। অনেকের মনে থাকার কথা, এর কিছুদিন আগে সীমান্তে বিডিআর-বিএসএফ লড়াইয়ে ১৮ জন বিএসএফ সদস্য নিহত হয়। রাকিন আহমেদ ভুইয়া পিলখানা হত্যাকা-ে ভারতের সম্পৃক্ত থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন ইঙ্গিতে। বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই, সেখানে প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) অন্য একটি বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করে।’ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, তখন থেকে এখন পর্যন্ত দেশের মানুষের দৃঢ় ধারণা, পিলখানা হত্যাকা-ের পেছনে তৎকালীন সরকার ও ভারতের হাত রয়েছে। এটা যৌথ প্রযোজনা। পরবর্তী ১৬ বছর ধরে যৌথ প্রযোজনায় অনেক কিছু ঘটেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ একটি দানবীয় শাসন প্রত্যক্ষ করেছে। এই সময়ে বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনার মন্ত্রী যখন বলেন, ভারত থাকলে আমাদের অন্য দেশের বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই, তখন বুঝা যায়, নতজানুতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা, অন্তর্বর্তী সরকার, বিদেশি পর্যবেক্ষক-সবারই এই অভিমত। দীর্ঘ ১৬ বছর ভারত বাংলাদেশকে অক্টোপাসের মতো টিপে ধরে রেখেছিল। দিল্লীর শিখ-ী হাসিনার বিদায়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। এই সময়ে ভারত শেখ হাসিনার ওপরই বিনিয়োগ করেছিল। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে কোনো মূল্য দেয়নি। শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে মূলত ভারতই বাংলাদেশে শাসন-শোষণ চালিয়েছে। এখন হাসিনামুখিতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এরপরও ভারতের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। হাসিনা পুনর্বাসনের। হাসিনা না থাকলে সব বিনিয়োগই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে, এ আশংকা তার মধ্যে প্রবল। হাসিনাকে রেখে দেয়া হয়েছে দিল্লীতে। সেখান থেকে ঘুঁটি চালাচালি হচ্ছে। কিন্তু সকলই গরল ভেল। পুলিশকে কাজ থেকে বিরত রাখা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঢেউ তোলা, জুডিশিয়াল ক্যু করা, ১৫ আগস্টে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটানোÑ সবই ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘু কার্ড বড় হাতিয়ার ছিল। সেটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। রিউমার স্ক্যানার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। বলেছে, তারা ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে যেখানে অপতথ্য বা মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টধারীদের ৭২ শতাংশই ভারতের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জবাব দিয়েছেন এই বলে যে, তথ্যে অতি রঞ্জন হয়েছে। রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ‘অপতথ্যের ভয়াবহতা’ দেখানো হয়েছে। যাহোক, পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের মোদি সরকারের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিডিআর হত্যাকা-ের ব্যাপারে কমিশন গঠন, নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচারের যে দাবি উঠেছে, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই দাবি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী, ঘৃণ্য অপকর্মের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, কারা পরিকল্পনা করেছিল, কারা ইন্ধন ও সহযোগিতা দিয়েছিল, তা জানা যাবে। তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে। এটা ঠিক, পিলখানা হত্যাকা-ে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা কখনো পূরণ হবে না। তবে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে নিহতদের পরিবার-পরিজনের সান্ত¦নার একটা জায়গা হবে। প্রসঙ্গত বলা আবশ্যক, আমাদের সশস্ত্রবাহিনীকে আরো শক্তিশালী, আরো আধুনিক ও সমৃদ্ধ করতে হবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার জন্য এর বিকল্প নেই।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

রাজশাহীতে স্বাধীনতা দিবসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রদান

জুলাই বিপ্লবে আহতযোদ্ধা ও সুবিধাবঞ্চিতদের মাঝে ঈদ উপহার সামগ্রী বিতরণে মিফতাহ্ সিদ্দিকী

সম্প্রীতির লাকসাম -মনোহরগঞ্জ গড়তে সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে -অধ্যাপক রেজাউল করিম

শ্রীপুরে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে দুই শতাধিক প্রতিবন্ধী পরিবারের মাঝে ঈদ সামগ্রী বিতরণ

স্বাধীনতা আমাদের প্রেরণার উৎস, গৌরবের স্মারক : ধর্ম উপদেষ্টা

স্বাধীনতা দিবসে ইউনূসকে লেখা চিঠিতে যে বার্তা দিলেন মোদি

জয়ের পরও আরব আমিরাতের কোচ ছাঁটাই

চার দিনের সফরে চীনে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

জেলা বিএনপি ফ্যাসিস্টদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে

সিকৃবিতে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত

‘হাসিনাকে রাজনৈতিক ভুলের জন্য একদম হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে’

সিংড়ায় শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিএনপির আলোচনা সভা

শ্রীনগরে বাঘড়া ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

কৃষ্ণ সাগরে যুদ্ধ বন্ধে একমত রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল আবুধাবির ইফতার ও নবগঠিত কমিটির পরিচিতি

পশ্চিমা বিশ্বকে দুই ভাগে ভেঙে দিয়েছেন ট্রাম্প

‘অত্যন্ত আক্রমণাত্মক’, মার্কিন সেকেন্ড লেডির সফর নিয়ে ক্ষুব্ধ গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী

আ.লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে - হাসান সরকার

লাইলাতুল কদরে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনা করলেন তারেক রহমান

মীরসরাইয়ে বিএনপির দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত-১