সিনিয়র সিটিজেনদের নিঃসঙ্গতা ও কিছু কথা
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম
মানব জীবনকে সুন্দর থেকে সুন্দরতম করার অভীষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ভিড়ে বিশ্বময় মনুষ্যত্বের মৌলিক উপাদানগুলো আজ বিলীনের পথে। পরিণতিতে মেধা ও দক্ষতায় শীর্ষে অবস্থানকারী এই মানুষগুলো জীবনের এক পর্যায়ে সবার থেকে আলাদা হয়ে একান্তই নিঃসঙ্গতার ভয়াল থাবার গ্রাস হচ্ছেন। আমাদের দেশেও একাংশ বিশেষভাবে সিনিয়র সিটিজেনদের এই ভয়ংকর পরিণতি দিবালোকের মতই স্পষ্ট। সম্প্রতি দেশের কয়েকটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা জাপানের নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীদের ভয়াবহ সংখ্যা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যা বিবেকবান মানুষের মনে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। জাপানের জাতীয় পুলিশ সংস্থার বরাত অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা ২১ হাজার ৭১৬ জন, যা আনুপাতিকভাবে বছরে ৮৬ হাজার ৮৬৪ জন। এর মধ্যে অনেক মৃতদেহই মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর উদ্ধার করা হয়।
জাপানে পিএইচডি অধ্যায়নরত সময়ে একজন প্রবীণ জাপানিজের নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ভায়াবহতা স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। দুই-তিন দিন যাবত তার রুমের সামনে বেশ দুর্গন্ধ ও মাছির আধিক্যের দরুন প্রফেসরকে অবহিত করায় তিনি পৌরসভা অফিসে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান। কিছুক্ষণের মাঝেই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে দরজা ভেঙ্গে সেই বয়স্ক লোকটির অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে, যারা প্রতি সপ্তাহে নিঃসঙ্গ প্রবীণদের বাসার দরজায় কাগজের ফুল রেখে যায় এবং ভিতরে থাকা লোকটি সেই ফুলটি ভিতরে নিয়ে রাখে। পরের সপ্তাহে আবার ফুল দিতে এসে পূর্বের সপ্তাহের ফুল যদি দরজায় ঝুলানো থাকে তার অর্থ হচ্ছে সে অসুস্থ নতুবা মৃত্যুবরণ করেছে। তাইতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন গত মে মাসে রিপোর্ট করেছে, জাপানে এখন ৯০ লক্ষ বাড়ি মানুষ বিহীন পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, যা অচিন্তনীয়! সাঁঝের বেলায় প্রবীণ মানুষগুলোর একাকি দরজায় দাঁড়িয়ে একমাত্র সঙ্গী কুকুরটির রশি হাতে ধরে অপলক দৃষ্টিতে উদাস মনে তাকিয়ে থাকা এক নির্মম বাস্তবতা। স্বপ্নের দেশ আমেরিকাতেও প্রবীণদের সম্মান বা যতœআত্তি তো অনেক পরের বিষয়, ছোটরা বয়সে বড়দের যে সামান্যতম সম্মানটুকু দেখাবে এই শৃঙ্খলা ন্যাটিভ আমেরিকানদের (যাদের পূর্ব পুরুষ আমেরিকান) মাঝ থেকে বহু আগেই হারিয়ে গেছে। মনুষ্যত্বের এই মৌলিক উপাদানগুলোর ক্রমবর্ধমান বিলুপ্তিই নিশ্চিত করে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বময় মানুষের নীরবতা ও নিঃসঙ্গতার সাথে ভয়ানক মৃত্যু।
নিঃসঙ্গ এই মৃত্যুগুলোর বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেন জাপানের শিজুওকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কেইকো আরিনিশি, যার অনেকগুলোই আমাদের দেশের বাস্তবতার সাথেও মিলে যায়। তার ভাষ্যমতে, সন্তানদের কর্মজীবনের তাগিদে ব্যস্ত থাকায় বাবা-মা সন্তানদের বাসায় গিয়ে উঠলেও নিজেদের সমবয়সী বা পরিচিতজনদের কাছে না পাওয়ায় ভীষণ হতাশায় ভোগেন। তাই বৃদ্ধ বাবা-মা নিজ শহরেই থাকাকে প্রাধান্য দেন। ফলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় দেহে কোর্টিসল নামক হরমোন বৃদ্ধি পায়, যা বিষণœতা, স্মৃতিভ্রম, চিন্তা শক্তি কমে যাওয়া, মানসিক চাপ ও উদ্বিগ্নতা বৃদ্ধি, ডিমেনশিয়া ও আলজেইমেরস রোগ সৃষ্টি করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য হোম সার্ভিস সুবিধা থাকলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকের জন্য তা নিতান্তই দুরুহ ব্যাপার। নিয়তির পরিহাসে বয়স্ক কোনো দম্পতির কেউ একজন মারা গেলে অন্যজনকে আমৃত্যু নিঃসঙ্গতায় কাটাতে হয়। উন্নত সভ্যতার এই সময়ে মানুষের বিবাহ বিমুখতা বা বিবাহ বিচ্ছেদের পর সিঙ্গেল ফাদার বা সিঙ্গেল মাদার হয়ে বাকি জীবন একাকি পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসঙ্গতার আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকাতেই প্রতি চল্লিশ মিনিটে একটি করে তালাক হচ্ছে। সাময়িকী ফোর্বস এর তথমতে, আমেরিকায় প্রথম বিবাহের ৪৩ শতাংশ ডিভোর্সে রূপ নেয় এবং পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে তা ৭৩ শতাংশ। উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও নিঃসঙ্গতার হার ব্যাপক আকারেই বেড়ে চলছে। তার প্রমাণ মিলে বৃদ্ধাশ্রমগুলোর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি দেখে।
আমেরিকা বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিছুটা সময় সঙ্গ দেয়ার জন্য ভাড়ায় লোক পাওয়া গেলেও পয়সা বেশি গুনতে হয়। জাপান সরকার কিছু উদ্যোগ নিলেও তাদের মূল পদক্ষেপ হলো কোনো রোবট বা যন্ত্রের মাধ্যমে প্রবীণদের সঙ্গ দেয়ার ব্যবস্থা করা। ভাড়াটে ব্যক্তির চেয়ে জড় বস্তুর যান্ত্রিক সরঞ্জামাদি অনেকাংশেই অর্থনৈতিকভাবে লাভের বৈকি! কিন্তু বাস্তবিক অর্থে জড় বস্তুর মেশিন বা যন্ত্র দিয়ে একজন মানুষের নিঃসঙ্গতাকে কাটানো কখনই পুরোপুরি সম্ভব নয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের প্রবীণদের মাঝেও ইদানিং পারকিনসন্স, ডিমেনশিয়া ও আলজেইমেরসের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে। কিছু নিয়ন্ত্রণকারী ঔষধ থাকলেও স্নায়ু বিশারদ চিকিৎসকদের পরামর্শ এটাই যে, এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে ভালো ফলাফলের জন্য আমৃত্যু ঔষধ সেবনের পাশাপাশি একনিষ্ঠ সঙ্গ দেয়া জরুরি। আর তা যদি হয় বৃদ্ধ বয়সে নিজ সন্তানদের সঙ্গ তা তো সোনায় সোহাগা। প্রবীণদের নিয়মিতভাবে বয়স এবং স্বাস্থ্য উপযোগী বিভিন্ন রকম ব্যায়াম, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদি কর্মকা-ে ব্যস্ত রাখা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ জরুরি। প্রতিদিন অল্প করে হলেও বিশেষভাবে ছুটির দিনগুলোতে নিজ পরিবারের প্রবীণদের জন্য সময় বের করতে হবে। সন্তানরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বিদেশে পাড়ি জমানোর পূর্বে বাধ্যতামূলকভাবে প্রবীণ পিতামাতার সার্বিক বিষয়ের নিরাপত্তা প্রদান ও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তাদের সার্বিক প্রয়োজনের ব্যবস্থাপনার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রবীণ নিবাসগুলোর আসন সংখ্যা ও বয়স্ক ভাতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
পৃথিবীর এই গতিময় যাত্রায় সময়ের পরিক্রমায় আমরাও একসময় প্রবীণ হবো। হয়তো আমাদেরও প্রয়োজন হবে অন্যের সহযোগিতার। তাই বিশ্বনবীর উপদেশ অনুযায়ী নিজেকে পরিচালনা করাটাও অতীব জরুরি। যার সারসংক্ষেপ, ‘তোমার নিকট হতে অন্যের স্ত্রীকে পবিত্র রাখো তোমার স্ত্রীও পবিত্র থাকবে এবং তোমার পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করো তোমার সন্তানরাও তোমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে’। বিধায় ব্যক্তিগতভাবে সর্বময় প্রচেষ্টা বজায় রেখে, সামজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আশু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই নিঃসঙ্গতাকে দূর করে সকল বয়সী মানুষের আনন্দের সাথে বেঁচে থাকা এবং সম্মানের সাথে বিদায় হওয়া দুটোই নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফার্মেসী বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ