ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১

প্রত্যেক জাতিকে নিজ যোগ্যতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৮:১০ পিএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০২ এএম

প্রগতি প্রত্যেক জাতির অধিকার হলেও এ অধিকার রক্ষার বিষয়টি তখনই যৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে, যখন কোনো জাতি সভ্যতার পথে নিজ যোগ্যতা ও সৃজনশীলতায় এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করবে। তা না করে কোনো জাতি যদি কুড়িয়ে পাওয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির পথে এগিযে যায়, তখন তাকে প্রগতি বলা যাবে না, বলতে হবে অধোগতি।

প্রগতি ওপরে ওঠার সময় যদি সিঁড়ি ব্যবহার করে, তবে অধোগতি নিচে নামার সময় ব্যবহার করবে লিফ্ট। কাজেই পৃথিবীর সব জাতির জন্য অভিন্ন সতর্কবার্তা হলো, প্রগতির পথ যত মসৃণ মনে হোক, তা মোটেই মসৃণ নয়। বরং এ পথ এমনই পিচ্ছিল যে, হিসাবের সামান্য গরমিল হলেই পদস্খলনের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

পৃথিবী জুড়ে চলমান অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও হিংস্রতাসহ যাবতীয় সাংঘর্ষিক কর্মকা-ে কলকাঠি নাড়ছে প্রগতির অনিয়ন্ত্রিত গতি যদিও তা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতার পৌনঃপুনিক ব্যবচ্ছেদ করলে যা বলা হলো, তারই প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। এ নির্মম বাস্তবতার ভিতকে মজবুত অবস্থায় নিযে যেতে নেপথ্য ভূমিকা পালনকারী হিসাবে যাকে সর্বাগ্রে দায়ী করা যায়, তার নাম ‘বিশ্বায়ন’। বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশনের পিঠে সওয়ার হয়ে পৃথিবী আজ সুখ, শান্তি ও স্বস্তিহীনতার দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। মানবতা বিপন্নের ঘটনা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে এ প্রশ্ন জাগা অযৌক্তিক নয়, আমরা কি সভ্যতার পথে এগিয়ে যাচ্ছি?

বিশ্বায়ন কেবল প্রগতির গতিকেই যে অনিয়ন্ত্রিত করছে, তা নয়; পৃথিবীর অধিকাংশ জাতির দিকভ্রষ্ট হওয়ার পেছনেও অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। আধুনিক সাজতে গিয়ে বিষবৃক্ষের যে বীজ কয়েক দশক আগে অনেক জাতিই রোপণ করেছিল, তা আজ ফলবতী হয়ে এর মধ্যেই ফল দিতে শুরু করেছে। এ ফল জাতির মজ্জা কীভাবে চুষে খাচ্ছে, তা হতবাক হয়ে দেখছে সবাই। তবে যা দেখছে না অর্থাৎ অশুভ আগামী, তার চিত্র ভয়াবহ। জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তো অকপটে বলেছেন, পৃথিবীতে মানুষকে স্বস্থিতে বসবাসের জন্য ভিন্ন গ্রহের সন্ধানে ফিরতে হবে।

চলমান এ অবক্ষয়ের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য প্রথমেই যে বিষয়কে উপলব্ধির গন্ডিতে আনতে হবে, তার নাম ‘প্রকৃতি’। অথচ প্রকৃতিকে নিয়ে আমরা বিন্দু পরিমাণ মাথা ঘামাই না। প্রকৃতি কী, এ প্রশ্ন কেউ করি না। প্রকৃতি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা নির্মিত মহাশ্চর্য কম্পিউটার। এ মহাজাগতিক অদৃশ্য যন্ত্রে সব প্রোগ্রাম করা আছে, সে অনুযায়ীই চলছে বিশ্ব। কাজেই একটি জাতি সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রেখে সভ্যতার পথে কী গতিতে এগিয়ে যাবে, তা নিয়ন্ত্রণের ভার একান্ত প্রকৃতির। প্রকৃতিই একটি জাতিকে এগিয়ে নেয়। এখানে স্বগতিতে চটজলদির কোনো অবকাশ নেই। বরং এ জাতীয় কার্যকলাপ কালের বিচারে ক্ষতিকেই বরণ করে। এর নজির পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। প্রকৃতির সীমারেখা লঙ্ঘন করে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পরিণতি হিসেবে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো ও পম্পেই নগরীকে প্রকৃতির পদতলে স্থান দিতে হয়েছে।

কোনো জাতি তার যোগ্যতা বিচারে কোন সময়ে কোন উপকরণ পাবে, তা প্রকৃতি যথাসময়ে তার হাতে তুলে দেয়। এ-নিয়ে শিশুসুলভ ধৈর্য্যচ্যুতি কখনোই শুভ ফল বয়ে আনে না। ঘোড়ার খামারে একজন কিউরেটর দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাসের ওপর ভর করে ঘোড়ার লেজের তলায় হস্ত সঞ্চালন করতে পারে। এ দৃশ্য দেখে কোনো আনাড়ি যদি হস্তসঞ্চালনে উদ্যত হয়, তাহলে তার কপালে জোড়া পায়ের ফ্লাইং কিক্ ছাড়া কিছুই জুটবে না। উন্নত বিশ্বের একটি দেশ কনকর্ড বিমান তৈরি করে দীর্ঘদিন ব্যবহারের পর খরচ বেশি হওয়ার কারণে তা বন্ধ রেখেছে। তাদের হাতে শোভনীয় সভ্যতার কোনো উপকরণ দেখে পদব্রাজক দেশের যদি কেউ তা তুলে নেয়, তাহলে তার কপালেও জোড়া পায়ের ফ্লাইং কিক্ অনিবার্য। কে কোনো পর্যায় অতিক্রম করার পর,কোন পরিস্থিতিতে কী ব্যবহার করছে তার প্রেক্ষাপট যাচাই না-করে অন্য কেউ তা হুট করে ব্যবহার শুরু করলে এ দুর্ভোগ অদৃষ্টের লিখন হয়ে ধরা দেবেই। কাজেই, সভ্যতার কোনো উপকরণ হাতে নেওয়ার আগে প্রত্যেক জাতির নিজ নিজ অবস্থানের কথা ভাবতে হবে। তবে এ বিষয়গুলো সুরাহা নির্ভর করবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি উন্নত বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি মূলত ব্যবসা নীতির ওপর।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিজ যোগ্যতায় বিকশিত হওয়ার পথ বন্ধ করার মাধ্যমে তাদের সেবাদাস বানানোর হীন প্রবৃত্তি থেকে উন্নত বিশ্বকে সরে আসতে হবে। তাদের অতিমাত্রিক ব্যবসায়িক মনোভাবের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। তাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সৃষ্ট ক্ষয়-ক্ষতির মুখোমুখি শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেই হতে হবে তা নয়, এর ফল তাদেরও ভোগ করতে হবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যদি সত্যিকার অর্থে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় কিংবা কৌশলে তাদের সে ধারা থেকে বিপথগামী করা হয়, তাহলে এর দায়ভার উন্নত বিশ্বের ঘাড়েই গিয়ে র্বতাবে। কেননা উন্নত দেশের দিকে ছুটে চলা অনুন্নত দেশের সেবাদাসরা সেদেশে গিয়েও স্বদেশী অনাচারের বীজ স্বভাবগতভাবে রোপন করবে। কালের আবর্তে তা ফলবতী হয়ে সেখানেও দেওয়া শুরু করবে বিষফল। শুরু হবে সামাজিক অবক্ষয় ও অনাচার। এর চলমান ধারা গোটা বিশ্বকে সুখ, শান্তি ও স্বস্তিহীন সরোবরে চুবিয়ে মারছে।

মানবতার নীরব ঘাতকের তালিকায় বেশ শক্ত অবস্থানে থাকা আরো একটি বিষয়ের উেেল্লখ না করলেই নয়, তা হল অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতি একটি জাতির সুরক্ষাঢাল। অনেকেই ধর্ম ও সংস্কৃতিকে এক করে ফেলে। কিন্তু ধর্ম ও সংস্কৃতি হুবহু এক নয়। ধর্ম মনের ওপর আরোপিত আলো । সংস্কৃতি মন থেকে উপচে পড়া আলো। মানব মনে ধর্মবোধ ও সংস্কৃতিবোধের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। একটি জাতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদি তার সংস্কৃতির ওপর কেউ আঘাত হানে। কোনো জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির ভেতর ভিন্ন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হলে সে জাতিকে ধ্বংসের জন্য পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন হয় না। চলমান ও আরোপিত সংস্কৃতির দ্বন্দ্বই তাকে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। জাতির সুখ-স্বস্তির সংরক্ষণ নির্ভর করে তার নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণের ওপর। দেখা যায় পৃথিবীর আধিকাংশ জাতিই আজ নিজস্ব তথা সুরক্ষাঢাল থেকে সরে গেছে।

কাজেই ধার করা চটকদার সভ্যতা ও সংস্কৃতি দিয়ে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়া মানে কেবল নিজস্ব প্রগতির পথকেই বন্ধ করা নয়, বরং জাতিকে একটি অনিয়শ্চতার দিকে ঠেলে দেওয়া। কোনো জাতি ধার করা সভ্যতার পথে যত দূরেই যাক না কেন,আদি অবস্থা কখনও তার পিছু ছাড়বে না। অর্থাৎ আঁস্তাকুড়ে সভ্যতার স্নো-পাউডার সে যতই মাখুক, ভেতরের আদি অসভ্যতা সুযোগ পেলেই তাকে দংশন করবে।
সুতরাং, এ সত্য আর অনুদ্ঘাটিত থাকার অবকাশ নেই, প্রগতির পথে দৌড় দিতে গিয়ে মানুষ নিজেই নিজের ফাঁদে আটকে পড়ছে। জাতি তার মৌলিকত্ব হারিয়ে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতায় হয়ে উঠেছে শেকড়হীন। ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে সীমাহীন বিশৃঙ্খলা ও লাগামহীন অনাচার। এসব দূর করতেই প্রকৃতি সংহারমূর্তি ধারণ করছে। তাই অশান্ত প্রকৃতির হিংস্র থাবা থেকে বাঁচতে হলে সমাজের হারানো শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্য প্রগতির অনিয়ন্ত্রিত গতির লাগাম টেনে ধরা জরুরি । এ কাজে ব্যর্থ হলে বাসযোগ্য এ পৃথিবী একদিন জ্যান্ত ভাগাড়ে পরিণত হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ধূমপানকে না বলুন
জালিমের পরিণতি ভালো হয় না
অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি
মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়
সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি
আরও

আরও পড়ুন

বাবরের মুক্তির অপেক্ষায় কারাগারের সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়

বাবরের মুক্তির অপেক্ষায় কারাগারের সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়

ব্যাংক খাত নিপুন কারিগরের মতো যেভাবে ধ্বংস করেন এসকে সুর

ব্যাংক খাত নিপুন কারিগরের মতো যেভাবে ধ্বংস করেন এসকে সুর

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আজকের বৈঠক বর্জন করবে লেবার পার্টি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আজকের বৈঠক বর্জন করবে লেবার পার্টি

দেশে ফিরতে চান মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া অভি

দেশে ফিরতে চান মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া অভি

দুর্নীতির মাধ্যমে পুতুলের ডব্লিউএইচও'র পদ পাওয়ার অভিযোগ:  দুদকের অনুসন্ধান শুরু

দুর্নীতির মাধ্যমে পুতুলের ডব্লিউএইচও'র পদ পাওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু

বাড়িতে ঢুকে সাইফ আলিকে ৬ বার ছুরিকাঘাত, হাসপাতালে ভর্তি

বাড়িতে ঢুকে সাইফ আলিকে ৬ বার ছুরিকাঘাত, হাসপাতালে ভর্তি

রাজশাহী জেলা ছাত্রদল নেতার পিতা বাচ্চু সরকারের দাফন সম্পন্ন

রাজশাহী জেলা ছাত্রদল নেতার পিতা বাচ্চু সরকারের দাফন সম্পন্ন

মোংলায় সড়কের ওপর রাখা পাথরের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ভটভটিতে থাকা দুই যাত্রীর মৃত্যু, আহত ৪

মোংলায় সড়কের ওপর রাখা পাথরের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ভটভটিতে থাকা দুই যাত্রীর মৃত্যু, আহত ৪

গাজায় ঐতিহাসিক পরাজয় ইসরাইলের

গাজায় ঐতিহাসিক পরাজয় ইসরাইলের

১৭ বছর পর আজ দুপুরে কারামুক্ত হচ্ছেন বাবর

১৭ বছর পর আজ দুপুরে কারামুক্ত হচ্ছেন বাবর

দীর্ঘ এক যুগ পর কারামুক্ত হলেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান

দীর্ঘ এক যুগ পর কারামুক্ত হলেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান

আজ কুড়িগ্রামে মার্চ ফর ফেলানী, নেতৃত্বে সারজিস আলম

আজ কুড়িগ্রামে মার্চ ফর ফেলানী, নেতৃত্বে সারজিস আলম

বাংলাদেশে আসছেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল সাহির শমসদ

বাংলাদেশে আসছেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল সাহির শমসদ

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরাইলের ‘ঐতিহাসিক পরাজয়’: হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরাইলের ‘ঐতিহাসিক পরাজয়’: হামাস

যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরও গাজায় হামলা ইসরাইলের, নিহত অন্তত ৩০

যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরও গাজায় হামলা ইসরাইলের, নিহত অন্তত ৩০

জুলাই ঘোষণা : কারা যাচ্ছেন আজকের বৈঠকে

জুলাই ঘোষণা : কারা যাচ্ছেন আজকের বৈঠকে

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল

যে সব শর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতি

যে সব শর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতি

এনসিটিবির সামনে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

এনসিটিবির সামনে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

নোয়াখালীর সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু আটক

নোয়াখালীর সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু আটক