ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১

জালিমের পরিণতি ভালো হয় না

Daily Inqilab জালাল উদ্দিন ওমর

১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম

খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিশ্বের দুটি দেশে স্বৈরসাশকের পলায়নের ঘটনা ঘটেছে। একটি হচ্ছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন এবং অপরটি হচ্ছে একই বছরের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পলায়ন। এরকম ঘটনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আরো ঘটেছে। ২০২২ সালের ১৩ জুলাই শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ এবং ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি পলায়ন করেন। ২০১১ সালে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেনআলী পালিয়ে যান এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধেই এরা সবাই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এদের সবারই পরিণতি হয়েছে অত্যন্ত নির্মম, অপমানজনক এবং শোচনীয়। কারণ, এরা সবাই জালিম এবং স্বৈরশাসক ছিলেন। এদের কেউ কেউ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছেন। এরা জনগণের প্রতি জুলুম করেছেন এবং আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন। আজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য এরা জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেছেন এবং জনগণের ওপর চরম নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছেন। কিন্তু কারোই শেষ রক্ষা হয়নি। জুলুম-নির্যাতন এবং দমননীতি চালিয়ে ক্ষমতাকে কিছুদিনের জন্য দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধে চরম অপমানের সাথে বিদায় নিয়েছেন। কারণ, জালিমের পরিণতি কখনো ভালো হয় না। এটা ইতিহাসের অনিবার্য সত্য এবং নির্মম বাস্তবতা।

এই পৃথিবীতে আমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সবাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে পৃথিবী ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যায়। অর্থ, বিত্ত, আভিজাত্য, ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি কোনটাই মানুষের সংগে যায় না। খালি হাতেই পৃথিবীতে মানুষের আগমন এবং খালি হাতেই পৃথিবী থেকে বিদায়। একজন ভিখারীর বিদায় এবং একজন প্রেসিডেন্টের বিদায়ও একই রকম। তবু কিছু মানুষ এই চিরন্তন সত্যকে ভুলে যান। তারা এই পৃথিবীতে প্রভাব-প্রতিপ্রত্তি এবং ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যান। তারা সত্যকে মানেন না, আইনকে মানেন না এবং অপরের অধিকার হরণ করেন। নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে গিয়ে অন্য মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেন। মানুষের ওপর জুলুম করে নিজেরা জালিমে পরিণত হন। তারা মনে করেন, তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী এবং কখনো তার পতন হবে না। দম্ভ এবং অহংকারে অনেকেই মাটিতে পা ফেলতে চান না এবং মানুষকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। তারা যা ইচ্ছা তাই করেন এবং শক্তির জোরে মানুষকে শাসন করেন। কিন্তু এর মাধ্যমে তারা যে নিজেকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছেন তা তারা বুঝতে চান না। অবশেষে একদিন ধ্বংসের মুহূর্তটি এসে যায় এবং তিনি ধ্বংস হয়ে যান। সব কিছু হারানোর পর তিনি ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু তখন তো আর শোধরানোর সময় থাকে না। ধ্বংসই হয় তার জীবনের অনিবার্য পরিণতি, যা তাকে ভোগ করতেই হয়।

সৃষ্টির সূচনা থেকেই এই পৃথিবীতে মানুষের মাঝে সত্য-মিথ্যার লড়াই বিদ্যমান। কিছু মানুষ মনুষ্যত্ব ও বিবেককে বিসর্জন দিয়ে ন্যায় ও সত্যকে বর্জন করে এবং অন্যায় ও মিথ্যার পথে চলেন। আবার কিছু মানুষ মনুষ্যত্ব এবং বিবেককে ধারণ করে অন্যায় ও মিথ্যাকে বর্জন করে এবং ন্যায় ও সত্যের পথে চলেন। ন্যায় ও সত্যপন্থীদের সাথে অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীদের সব সময় দ্বন্দ্ব সংঘাত চলে। অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীরা তাদের প্রভাব-পতিপত্তি ও ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সব সময় ন্যায় ও সত্যের অনুসারীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ন্যায় ও সত্য পন্থীদের বিজয় হয় এবং অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীদের পরাজয় হয়। অন্যায় ও মিথ্যার অনুসারীদের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়, অপমান এবং লাঞ্চনা। ইতিহাসের এই নিয়ম বহতা নদীর মতই বয়ে চলছে। ফেরআউন সব সময় মুসা (আ.) এবং তার অনুসারীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেরআউন চরম পরিণতি ভোগ করেছে। নমরুদ সব সময় ইবরাহিম (আ.) এবং তার অনুসারীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নমরুদ করুণ পরিণতি ভোগ করেছে। আবু জেহেল এবং আবু লাহাবরা সব সময় মুহাম্মদ (সা.) এবং তার অনুসারীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করেছে। কিন্তু আবু জেহেল এবং আবু লাহাবরা জীবনে করুণ পরিণতি ভোগ করেছে। শুধু তাই নয় ফেরআউন, নমরুদ, আবু জাহেল এবং আবু লাহাবরা ইতিহাসের পাতায় অভিশপ্ত এবং ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। যুগে যুগে সকল জালিমেরই এরকম করুণ পরিণতি হয়েছে এবং তারা সবাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তারা মানুষের ভালবাসা এবং সম্মান অর্জন করতে পারেনি। বরং ঘৃণা এবং অসম্মানই অর্জন করেছে।

কিছু মানুষ সব সময় জীবনে বিজয়ী হতে চায়। বিজয়ী হবার জন্য তারা সবসময় আইন কানুনকে লংঘন করে এবং সত্যকে হত্যা করে। কিন্তু সব বিজয় আসলে বিজয় নয় এবং সব পরাজয় আসলে পরাজয় নয়। কিছু কিছু বিজয় আসলে পরাজয় এবং কিছু কিছু পরাজয় আসলে বিজয়। কেউ যদি সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে পরাজিত হয়, তা আসলে তার জন্য বিজয়ই বটে। আবার কেউ যদি মিথ্যা ও অন্যায়ের পথে চলে বিজয়ী হয়, তা আসলে তার জন্য পরাজয়ই বটে। কারবালার ময়দানে ইয়াজিদ বিজয়ী হলেও, সে আসলে পরাজিতই হয়েছে। এজন্য বিশ্বজুড়ে ইয়াজিদ আজ একটি ঘৃণিত নাম এবং কোনো পিতা-মাতা তার সন্তানের নাম ইয়াজিদ রাখে না। কিন্তু ইমাম হোসেন (রা.) সেদিন পরাজিত এবং মৃত্যু বরণ করলেও তিনি বিশ্বজুড়ে এক অতি সম্মানিত নাম এবং পিতা-মাতারা শ্রদ্ধার সাথে তাদের সন্তানের নাম ইমাম হোসেন রাখেন। একইভাবে পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফর বিজয়ী হলেও সে আসলে পরাজিতই হয়েছে। এজন্য বিশ্বজুড়ে মীর জাফর আজ একটি ঘৃণিত নাম এবং কোনো পিতা-মাতা তার সন্তানের নাম মীর জাফর রাখেন না। কিন্তু সিরাজ উদ্দৌলা সেদিন পরাজিত এবং মৃত্যু বরণ করলেও, তিনি আজ বিশ্বজুড়ে এক অতি সম্মানিত নাম এবং পিতা-মাতারা শ্রদ্ধার সাথে তাদের সন্তানের নাম সিরাজ উদ্দৌলা রাখেন। ইতিহাসের এই বাস্তবতা থেকে আজ আমাদের সবারই শিক্ষা নিতে হবে।

প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা সব সমাজেই প্রচলিত আছে। মানে হচ্ছে, আপনি যদি অন্য মানুষের ওপর জুলুম, নির্যাতন, অবিচার করেন এবং তার অধিকার হরণ করেন, তাহলে এর পরিণতি আপনাকে ভোগ করতেই হবে। যেভাবেই হোক, এর প্রায়শ্চিত্ত আপনাকে জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে করতেই হবে। সুতরাং মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন করে পার পাবার কোনো সুযোগ নাই। সেটা পৃথিবীর অতীত ইতিহাসের যেমন প্রমাণিত সত্য, ঠিক তেমনি আগামী দিনেরও অনিবার্য বাস্তবতা। সুতরাং প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ অবস্থানে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা এবং মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করা উচিত। জুলুম এবং অবিচার যে কেবল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এবং সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাই করে, তা নয়। সবাই কিন্তু নিজ নিজ অবস্থানে ক্ষমতাবান। কারো ক্ষমতা ছোট এবং কারো ক্ষমতা বড়। তাই আমাদের সবাইকে আমাদের নিজস্ব পরিমন্ডলে এবং আমাদের অধীনস্ত মানুষগুলোর প্রতি ন্যায়বিচার করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান থেকে এমপি-মন্ত্রী, প্রেসিডেন্টÑ সবারই দায়িত্বশীল হতে হবে। জনগণ যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা যাবে না এবং মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। বরং ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ধূমপানকে না বলুন
অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি
মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়
সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ সময়ের দাবি
ফুলতলী ছাহেব কিবলা মানুষকে জীবনভর আল্লাহর পথে ডেকেছেন
আরও

আরও পড়ুন

বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪

বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪

মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই

সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই

ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের

ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের

গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি

গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের

শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা

শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা

বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা

বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা

দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম

দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম

বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের

বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের

ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?

ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?

আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু

আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু

বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ

বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ

রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী

রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী

ধূমপানকে না বলুন

ধূমপানকে না বলুন

অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি

অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি

মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়

মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত

শেষ তিন মাসে রেকর্ড বাজেট ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের

শেষ তিন মাসে রেকর্ড বাজেট ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের