বিশ্ব আদিবাসী দিবস
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
ওই ক্রীতদাসী মেয়েটির না-বলা রূপকথা, কালো কালো উপকথা ছুঁয়ে ছোট ছোট দ্বীপগুলোর প্রেক্ষাপট আজও অমলিন প্রাচীন আফ্রিকার চিত্রায়ণে। আফ্রিকার কালো আদিবাসী মানুষের দল আজ সভ্যতার দাসে পরিণত হয়েছে উন্নয়ন আর নগরায়ণের নামে। বৃহৎ আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্তে আজ আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো অস্তিত্ব বিলীনের পথে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের কাছে তাদের প্রতিনিয়তই মার খেতে হচ্ছে যার হিসাব সভ্য সমাজ রাখেনা বললেই চলে। কালো উপকথাগুলো তাই কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় মানবসভ্যতার শেকড়।
কয়েক হাজার বছর ধরে ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চলে বাস করছে আফ্রিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাকা। ইতিহাসবিদদের কাছে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ‘বাকাপিগমি’ নামে পরিচিত। বনকে আশ্রয় করে তারা বেঁচে আছে দীর্ঘদিন। এই বনই তাদের ঘরবাড়ি, তাদের আহার্য, তাদের বিনোদন। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে বেশিদিন এই সুখ ভোগ সম্ভব হয়নি বাকা জনগোষ্ঠীর। খনি কোম্পানিগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য আরসম্পদ আহরণের কারণে বাকা জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন আজ হুমকির মুখে।
বাকাদের সম্পর্কে পুরাতন তথ্যাদির মধ্যে আছে খ্রিস্টপূর্ব ২৭৬ সালের কিছু বক্তব্য। সেই সময় ফারোয়া পেপি দ্বিতীয় বাকা জনগোষ্ঠীর মানুষদের ‘নৃত্যরত বামন’ হিসাবে আখ্যা দেন। ফারোয়া তার দাসবিক্রির দলিলে এই কথাগুলো লিখে যান-অন্যান্য পিগমিদের তুলনায় তারা বেশ লম্বা, তারা বড় ধনুক ব্যবহার করতে পারে।
এই ঘটনার তিনশতক পর খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে গ্রিক পরিব্রাজক হেরোডোটাস লিখেন, তিনি যখন পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন একদল মানুষ দেখতে পান, যাদের পরনে ছিল পামগাছের ছাল। ধারণা করা হয় তিনি আদিবাসী গোষ্ঠী বাকাদের কথাই বলেছিলেন।
ক্যামেরুনের দক্ষিণ পূর্বের নোগয়লা অঞ্চলে বেশকিছু খনি অবস্থিত আর যেখানেই খনি সেখানেই বহুজাতিক কোম্পানি। মাইলের পর মাইল বন উজাড় করে ক্রমেই খনি অঞ্চল বড় করা হচ্ছে। এই বন উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে বাসস্থান হারাচ্ছে বাকাজনগোষ্ঠী। কিছুদিন আগেও তাদের জগৎ বলতেই ছিল গভীরবন। কিন্তু সম্প্রতি বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার কারণে তাদের উঠে আসতে হয়েছে সমতল অঞ্চলে। রাস্তার পাশে, গুচ্ছ গ্রামে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির নির্ধারিত এজেন্টরা। আর এ কাজে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে ক্যামেরুন সর কার। নোগয়লাতে প্রায় ৩৫ হাজার বাকা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বসবাস। সেই জনগোষ্ঠীর এক নারী লিসেত। তার কথাতেই ফুটে উঠে তাদের বর্তমান অস্তিত্ব সংকটের ছবি।
ক্রমশই আমাদের ভয় গ্রাস করে ফেলছে। প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ খনিঅঞ্চলে দেখা যাচ্ছে। আর যতই দিন যাচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের অধিকার আমাদের বনভূমি সব অন্যের করায়ত্তে চলে যাচ্ছে। ক্যামেরুন সরকার এবং কিছু সাদা চামড়ার মানুষ আমাদের বলপূর্বক বনের ভিতর থেকে বের করে দিয়ে একটা গ্রামে নিয়ে এসেছে। এখন আমরা দিনের বেলা বনের ভেতরে যাই আর সন্ধ্যের সময় ফিয়ে আসি। রাতে সেখানে যাওয়ার কোনো অধিকার আমাদের নেই।
লিসেতের পরিবারের মত অনেক বাকা পরিবারকেই বলপূর্বক গ্রামে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যাদের জীবনের শুরু বনের মধ্যে, বনের সঙ্গে যাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ সেই বাকা মানুষেরা কীভাবে সংস্কৃতির গ্রাম সমাজে বসবাস করবে তা প্রশ্নের জন্ম দেয়। বাকা জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের এই নব্য গ্রামীণ জীবনযাপনকে মেনে নিতে পারছেনা। খাবার, পোশাক থেকে শুরু করে তাদের সংস্কৃতি সবকিছুই অরণ্য-নির্ভর। সেই জনগোষ্ঠীকেই এখন রাস্তার পাশে মানবতায় জীবন-যাপন করতে হয়। লিসেতের মতে, পাখি আর পশুর শব্দে যেখানে আগে জীবন অতিবাহিত হত, এখন সেখানে অদ্ভুত সব যন্ত্রের শব্দে প্রতিটা মুহুর্ত পার করতে হয়।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর ন্যাচার নামক একটি সংস্থার প্রধান নির্বাহী ডেভিড হোয়েল বলেন, “বাকা জনগোষ্ঠীর মানুষ ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চলে কয়েক হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। বনজ ঔষধি, গাছপালা এবং পশুপাখি সংক্রান্ত জ্ঞানে তাদের দক্ষতা অবিশ্বাস্য। কিন্তু এটাও ঠিক প্রতিনিয়তই বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে। ক্যামেরুনও উন্নত হচ্ছে। তবে ক্যামেরুন তার উন্নতির পথে খনি কোম্পানিগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করছে তা মূলত বনাঞ্চলবিরোধী।
বাকা পিগমিরা মূলত জাতিগতভাবে শিকারি। ফাঁদ পেতে বন্য প্রানী শিকারে বাকাদের জুড়ি নেই। একটা শিকারের পর তারা জেঙ্গির পূজা করে এবং তার উদ্দেশ্য গান গায়। আর এই শিকারকে কেন্দ্র করে গাওয়া গানকে বলা হয় লুমা। এছাড়াও বাকা সমাজে একজন তরুণকে সত্যিকারের পুরুষ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ারজন্য জেঙ্গির অনুমতি লাগে। আর জেঙ্গি দেবতার অনুমতি তাদের সমাজপতি মারফত আছে। তাই বলে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ মোটেও যুদ্ধংদেহী নয়। এদের রয়েছে হাজার বছরের সংস্কৃতি, যার ¯্রােতধারায় তাদের জীবনযাপন প্রক্রিয়া অনেক সাধারণ ও সাবলীল যা তাদের সংগীতে প্রকাশ পায়। তাদের বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে বাকা ধনুক, লিমবিনদি, গোমবি, ইয়েতা। তাদের গানেই উঠে আসে তাদের শেকড়ের কথা-
‘সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে আসে
গভীরশব্দ
ধেয়ে আসা পুরাতন চেতনা
আমার বিশ্বাস আর গর্ব যেখানে শায়িত
এর কোনো কিছুই তুমি আমার কাছ
থেকে নিয়ে যেতে পারোনা।’
বাকা জনগোষ্ঠির মধ্যে কোনো অন্তর্কোন্দল বা মারামারির ইতিহাস নেই। বিগত কয়েক বছর ধরে কুত্রিমভাবে প্রক্রিয়াজাত মাদকের প্রভাবে তাদের মধ্যে অসরন্তাষ আর হতাশা জন্ম নিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাকা জনগোষ্ঠীর মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সংস্কৃতির অংশ হিসাবে বনের বিভিন্ন লতাপাতা দিয়ে বানানো মদ খেয়ে অভ্যস্ত, যেসব অনেকাংশই উৎসব বা আচারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কৃত্রিমভাবে প্রক্রিয়াজাত মাদকদ্রব্যের ব্যবহার তাদের সমাজে ছিলনা বললেই চলে।
এই জনগোষ্ঠীর মানুষ মূলত তাদের ঈশ্বরসার্কের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। কমবা তাদের অন্যতম দেবতা। এ ছাড়া জোঙ্গি-তাদের বনদেবতা। বাকা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস মতে, জেঙ্গি হল তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতিনিধিত্বকারী এবং অভিভাবক। আর মূল দেবতা কমবার সান্নিধ্য পেতে হলে আগে জেঙ্গিকে সন্তুষ্ট করতে হবে। বাকাদের মধ্যে প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, বনে যারা অনধিকার প্রবেশ করে বা বনকে যারা ধ্বংস করে তাদের শাস্তি দেন বন দেবতা জেঙ্গি। কিন্তু, সাদা চামড়া খনিমালিকদের বিরুদ্ধে দেবতা জেঙ্গিও আজ অসহায়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিষ্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পঞ্চদশ সংশোধনী রায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি
বন্দরে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিজয় দিবস পালন
নির্বাচিত সরকারই সংসদে পরিপূর্ণ সংস্কার করবে : আমীর খসরু
সাংবাদিক সামাদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
টানা তৃতীয়বার সিডিপির সদস্য হলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
ছিনতাইকারীর কবলে সোনারগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি
খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ পাবে মৌলিক অধিকার
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে ইইউ’র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল সাবেক ডিবি প্রধান হারুন ও জাহাঙ্গীর-তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রেল যাত্রীদের ভোগান্তি
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি কমেছে, বেড়েছে ভিয়েতনাম-ভারত থেকে
বাংলাদেশে অংশীদারিত্বে বড় সম্ভাবনা দেখছি সুইডেনের : নিকোলাস উইকস
এশীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে
স্টিভ ব্যাননের দাবি : ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবেন
‘সমগ্র বিশ্ব রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালে রয়েছে’ : রাশিয়ার পারমাণবিক সুরক্ষা বাহিনীর প্রধান নিহত
ইসরাইলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের
শিক্ষার্থী সীমান্ত হত্যার বিচারের দাবিতে চাষাড়ায় মানববন্ধন
রাণীশংকৈলে ফলিত পুষ্টি বিষয়ক ৩ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের উদ্বোধন
ডিএসইসি'র সদস্যদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ২৩ ডিসেম্বর