ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সময়োপযোগী ও বাস্তবোচিত ভাষণ
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর এই ভাষণে জাতীয় ঐকমত্যর ভিত্তিতে আগামী সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি, হাসিনা সরকারের সময়ের দুর্নীতির শ্বেতপত্রের প্রসঙ্গসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের দাবি করে আসছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ না করলেও সম্ভাব্য সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি ভাষণে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এই কমিশনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করা। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে, সেগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করবে এই কমিশন। কমিশন গঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম পর্যায়ে যে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, সেই কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ হবে। এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে। সহসভাপতি হিসেবে থাকবেন সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে নতুন সদস্য কো-অপট করতে পারবে। নতুন কমিশনের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এই কমিশনের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সিদ্ধান্ত জরুরি, সেসব বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং সবার সঙ্গে আলোচনা করে কোন সময়ে নির্বাচন করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে ধারণা দিয়ে তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। এই সময়ের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন করা হয়ত সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ৬ মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কবে হবে, তার একটি সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। এতে নির্বাচন কবে হবে, এ নিয়ে রাজনৈতিক দলসহ জনমনে যে প্রশ্ন ছিল, তার অবসান হয়েছে বলা যায়।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছু ছিল না। ধারাবাহিক লুটপাট ও লাখ লাখ কোটি অর্থপাচারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বিপুল সমর্থন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়েছে বিপর্যস্ত ও ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দেশকে পুনর্গঠন সহজ কাজ নয়। যেকোনো সরকারের জন্য এটি অত্যন্ত কঠিন ও চ্যালেঞ্জের কাজ। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই পতিত শেখ হাসিনা ও মোদির দোসররা একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টা চালায়। ছাত্র-জনতা ও বিএনপিসহ আন্দোলনে থাকা সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় সরকার তা মোকাবেলা করেছে। ক্রমাগত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবেলা করেই সরকার দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি পুনর্গঠনসহ সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজ স্বল্প সময়ে করা সম্ভব নয়, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সময় ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। ব্যর্থ হলে আমরা সকলেই ব্যর্থ হবো। তাঁর বাস্তবোচিত এই বক্তব্য সরকারের প্রতি বড় সমর্থন। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসন আমলের অর্থনৈতিক দুর্নীতির শ্বেতপত্র, গুম কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে মানুষ জানতে পেরেছে শেখ হাসিনা কী নির্মম, নিষ্ঠুর ও সীমাহীন লুটপাট করে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকার অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এ কাজ করেছে। সরকার দায়িত্ব নিয়েই পুলিশ, দুর্নিতী দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও সংবিধান বিষয়ক ছয়টি সংস্কার কমিশন করেছে। পরবর্তীতে আরও প্রয়োজনীয় পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। শেখ হাসিনা যেভাবে রাষ্ট্রের সকল কাঠামো ধ্বংস করেছে, তা সংস্কারে এসব কমিশন গঠন করা ছাড়া বিকল্প ছিল না। শুধু একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পদ্ধতি সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দেশের পুনর্গঠন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রের অন্য কাঠামোর সংস্কার অপরিহার্য। তা নাহলে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেমন হবে না, তেমনি দেশ ফ্যাসিস্ট হাসিনার গড়ে তোলা কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাবে। এতে নতুন বাংলাদেশের সব অর্জন ব্যর্থ হতে বাধ্য। এসব বিষয় সামনে রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন মৌলিক কাঠামোর সংস্কার করছে। পর্যবেক্ষকদের মনে করছেন, এই সংস্কার দ্রুত শেষ করতে চাইলেও এক থেকে দেড় বছরের বেশি সময় লাগবে। এই সময় অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ভাষণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের যে সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছেন, তা এই সময়সীমার মধ্যেই পড়ে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও কয়েক মাস আগে আঠার মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। তাঁর এই সময়ের সাথে প্রধান উপদেষ্টার সময়সীমার সাজুয্য রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার সঠিক পথেই রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছেন। এ সময় পর্যন্ত বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে তাঁকে সহায়তা করতে হবে। এজন্য, এ সরকারের শুরু থেকেই একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হয়ে রয়েছে। বিএনপিও প্রায় দুই বছর আগে ৩১ দফা সংস্কার ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সরকার গঠনের কথা তুলে ধরেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের সাথে মিল রয়েছে। ফলে এ নিয়ে মতদ্বৈততার কারণ নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থই বলেছেন, গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ এবং ভোটার তালিকা যাচাই করার কোনো সুযোগ ছিল না। এ প্রজন্মের তরুণ শ্রেণী ভোট দিতে পারেনি। ফলে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা জরুরি, যাতে তারা ভোট দিয়ে ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রথমবারের মতো প্রবাসীরাও যাতে ভোট দিতে পারে, সে ব্যবস্থাও করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের এই সংস্কার প্রক্রিয়া আবশ্যক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে, তা পুরোনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে সেই উপলব্ধি এবং নতুন বাংলাদেশের পথ রচনার দিকনির্দেশনা রয়েছে। এজন্য, তাঁকে সকল রাজনৈতিক দল ও পক্ষকে সহায়তা করতে হবে। শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়াই নয়, তার ভাষণে অর্থনীতি পুনর্গঠনের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বাস্তবোচিত পদক্ষেপের কথা উঠে এসেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের যে কষ্ট হচ্ছে, তিনি তা স্বীকার করে সমাধানের কথা বলেছেন। তাঁর ভাষণে সরকারের প্রথাগত বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা ছিল না। ছিল, সত্য ও বাস্তবতাকে অকপটে স্বীকারের দৃঢ়তা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পঞ্চদশ সংশোধনী রায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি
বন্দরে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিজয় দিবস পালন
নির্বাচিত সরকারই সংসদে পরিপূর্ণ সংস্কার করবে : আমীর খসরু
সাংবাদিক সামাদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
টানা তৃতীয়বার সিডিপির সদস্য হলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
ছিনতাইকারীর কবলে সোনারগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি
খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ পাবে মৌলিক অধিকার
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে ইইউ’র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল সাবেক ডিবি প্রধান হারুন ও জাহাঙ্গীর-তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রেল যাত্রীদের ভোগান্তি
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি কমেছে, বেড়েছে ভিয়েতনাম-ভারত থেকে
বাংলাদেশে অংশীদারিত্বে বড় সম্ভাবনা দেখছি সুইডেনের : নিকোলাস উইকস
এশীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে
স্টিভ ব্যাননের দাবি : ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবেন
‘সমগ্র বিশ্ব রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালে রয়েছে’ : রাশিয়ার পারমাণবিক সুরক্ষা বাহিনীর প্রধান নিহত
ইসরাইলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের
শিক্ষার্থী সীমান্ত হত্যার বিচারের দাবিতে চাষাড়ায় মানববন্ধন
রাণীশংকৈলে ফলিত পুষ্টি বিষয়ক ৩ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের উদ্বোধন
ডিএসইসি'র সদস্যদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ২৩ ডিসেম্বর