মুসলিম শাসন বাংলায় শান্তি ও সমৃদ্ধি আনে
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
মুসলিম শাসনের ফলে গণজীবনে অশান্তি ও ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা ঘটে, এমন প্রোপাগান্ডা চালিয়েছেন অনেকেই। ১২০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দব্যাপী বাংলায় তারা অন্ধকার যুগ দেখতে পান, যা একান্তই সারবত্তাহীন। কথিত অন্ধকার যুগের ১৫০ বছরে যেসব শাসক বাংলা শাসন করেন, তাদের সময়টা ছিলো শান্তিপ্রধান। বখতিয়ার খিলজী একজন সুশাসক ছিলেন। ১২০৫-১২০৬ এ স্বল্পসময়ের শাসনকালে তিনি তাঁর রাজ্যকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করেন এবং সেগুলির শাসনভার তাঁর প্রধান অমাত্য ও সামরিক প্রধানদের ওপর ন্যস্ত করেন। তাদেরকে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা, রাজস্ব আদায় করা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং জনগণের পার্থিব ও নৈতিক উন্নতির দিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বাংলায় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের সীমানা ছিল পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মানদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। বখতিয়ার খিলজি বাংলায় মুসলিম সমাজের নতুন যুগের ভিত্তি স্থাপন করে রাজ্যময় নামাজের জন্য মসজিদ, শিক্ষাদানের জন্য মাদ্রাসা এবং ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে সুফীদের জন্য খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যেমন ছিলেন একজন প্রতিভাবান ও দুঃসাহসিক সেনাপতি, তেমনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ ও প্রজাদরদী শাসক। তিনি বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করায় এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ও মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশের পথ সুগম হয়।
তার শাসনকাল বিশ্লেষণ করে টি আলী দেখান, বখতিয়ার আদৌ রক্তপিপাসু ছিলেন না। তিনি অহেতুক প্রাণহানী পছন্দ করতেন না। বিজিত অধিবাসীদের উপর তিনি কোনো নিপীড়নমূলক আচরণও করেননি। তাঁর অভিযাননীতির প্রধান লক্ষ্য ছিলো অল্পসময়ে ও অল্প রক্তপাতে অধিক লাভবান হওয়া। (টি, আলী, ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ) পুঁথিঘর লি. ঢাকা, নভেম্বর-১৯৭৬,২৯৪)। তিনি তার স্বল্প মেয়াদি রাজত্বকালে রাজ্যের অমুসলিম প্রজাবর্গের প্রতি (হিন্দু-বৌদ্ধ ইত্যাদি) অত্যন্ত সদয় ছিলেন। (মাহবুব সিদ্দিকী, ঐতিহাসিক মাহিসন্তোষের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ তাকি উদ্দীন আল আরাবী, হেরিটেজ রাজশাহী, জানুয়ারি, ২০১৯)।
রাজ্যঘটিত ব্যাপারে তাঁর দ্বারা যেমন রক্তপাত বা হত্যাকা- সংগঠিত হয়নি, তদ্রুপ ভিন্নধর্মীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রেও তিনি অহিংস নীতির পক্ষপাতী ছিলেন। ... দেবকোটের কোচদলপতি, তিব্বত অভিযানের পথপ্রদর্শক ও অনাত্মীয় বখতিয়ারের একমাত্র স্থানীয় বন্ধু আলীমেচ তাঁরই আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সদলবলে স্বেচ্ছায় মুসলমান হন। তাঁর মধ্যে যদি ইসলামপ্রশ্নে অসহিষ্ণু মনোবৃত্তি কিংবা হিংসানীতি অথবা জবরদস্তিমূলক পদ্ধতির অবকাশ থাকতো, তাহলে তাঁর বিজিত রাজ্যের অবস্থা অন্যরূপ হতো এবং পরবর্তী ইতিহাসেও তার প্রতিক্রিয়া হতো সুদূরপ্রসারী। (মেহরাব আলী, দিনাজপুরে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, মার্চ, ১৯৯১)।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির মৃত্যুর পর তাঁর তিন সহযোদ্ধা মুহম্মদ শিরাণ খিলজি, হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খিলজি ও আলী মর্দান খিলজির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়। খিলজি আমির ও সৈন্যরা এ সময় মুহম্মদ শিরাণ খিলজিকে নেতা নির্বাচিত করেন। শিরাণ খিলজি মাত্র এক বছর শাসকের দায়িত্ব পালন করলেও নিজ যোগ্যতাবলে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিদ্রোহী আলী মর্দান তার হাতে বন্দি হলেও কৌশলে পালিয়ে দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নিকট আশ্রয় নেন এবং বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। শিরাণ খিলজির মৃত্যুর পর ইওয়াজ খলজি (১২০৮-১২১০ খ্রি.) দিল্লির অধীনস্থ শাসক হিসেবে দেবকোটের শাসক নিযুক্ত হন। কিন্তু মাত্র দুই বছর পর আলী মর্দান খিলজি দিল্লির সুলতানের সহায়তা নিয়ে দেবকোটে ফিরে আসলে হুসাম উদ্দিন ইওয়াজ খিলজি স্বেচ্ছায় শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেন। আলী মর্দান খিলজি (১২১০-১২ খ্রি.) বিনা বাধায় শাসক নিযুক্ত হন।
আলী মর্দান লাখনৌতি শাসন করেন ১২১০-১২১২ সালে। খিলজীদের মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্ব দমন করে তিনি বাংলায় রাজনৈতিক ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। কুতুবউদ্দীন আইবেকের কর্তৃত্বের অধীনে শাসনকার্য শুরু করলেও, ১২১০ খ্রিস্টাব্দে আইবেকের মৃত্যুর পর তিনি বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘সুলতান আলাউদ্দীন’ উপাধি গ্রহণ করে মুদ্রা জারি করেন। তাঁর মুদ্রার ছবি কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। সুলতান হিসেবে আলী মর্দান যোগ্য এবং শক্তিশালী ছিলেন। রাজত্বকালের প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। তাঁর এ বাহিনী অধিক সংখ্যক খিলজী অভিজাত মুসলিমকে হত্যা করেছিল। তিনি বিচক্ষণতার সাথে উচ্চাভিলাষী ও প্রতিদ্বন্দ্বী খিলজী অভিজাতদের নির্বাসিত করেছিলেন। তার সময়ে রাজবংশে অস্থিরতা থাকলেও অমুসলিম পীড়ন বা হত্যার কোনো নজির নেই।
এরপর ক্ষমতায় আসেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইয়াউজ খিলজী। (শাসনামল: ১২১২-১২২৭)। তার শাসনামলে বাংলায় শান্তি বজায় ছিল। তিনি দেবকোট থেকে গৌড়ে রাজধানী সরিয়ে আনেন। বাংলায় তিনি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। পূর্ববঙ্গ, কামরূপ (আসাম), ত্রিহুত (উত্তর বিহার) ও উৎকলে (উত্তর ওড়িষ্যা) অভিযান পরিচালনা করেন ও এগুলোকে তার করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খিলজি একজন দক্ষ ও সুশাসক ছিলেন। তাঁর সুশাসনে দেশে শান্তি ও শৃংখলা অব্যাহত ছিলো। তিনি ন্যায় বিচারচক ও প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। প্রজাকল্যাণে তিনি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। সামরিক মেধা, কূটনীতি ও প্রশাসনিক দক্ষতার অধিকারী ইওয়াজ খিলজি বাংলায় প্রথম নৌবহর গঠন এবং সর্ব প্রথম রৌপ্য মুদ্রা চালু করেন। তিনি শিল্প-সাহিত্যের একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। জ্ঞানী, সাধক এবং সৈয়দদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিদের তিনি ভাতা প্রদান করেন।
দিল্লীর সম্রাটের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে অধিক। এ লড়াইয়ে সপরিবারে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। জনগণের ঐক্য ছিলো তার জন্য জরুরি। অমুসলিম নাগরিকদের সাথে অসদাচরণ তাঁর বিরুদ্ধেই যেতো। কারণ, রাষ্ট্রে তখন অমুসলিমরাই সিংহভাগ। তিনি বরং তাদের আস্থা অর্জনে ছিলেন যতœবান। তাদের ধর্ম, জান-মালের উপর কোনো বিপদ যেন না আসে, সে ব্যাপারে ছিলেন সজাগ। ঐতিহাসিক বিবরণী তাঁর শাসনামলকে যথার্থই আখ্যা দিয়েছে ‘তাৎপর্যপূর্ণ ও গঠনমূলক‘ অভিধায়।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওয়াজ খিলজি নিঃসন্দেহে খিলজি শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। বখতিয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুসলমান রাজ্যকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজধানী দেবকোট হতে গৌড় বা লখনৌতিতে স্থানান্তরিত করেন। রাজধানীর প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করার জন্য বসনকোটে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়। লখনৌতী নদীতীরবর্তী হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা ছিল। বাংলায় মুসলমান শাসকদের মধ্যে ইওয়াজ খিলজিই নৌ-বাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন। রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য এর তিন পার্শ্বে গভীর ও প্রশস্ত পরিখা নির্মাণ করা হয়। বার্ষিক বন্যার হাত থেকে লখনৌতি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য তিনি বহু খাল খনন ও সেতু নির্মাণ করেন। রাস্তা নির্মাণ করে সৈন্য ও পণ্য চলাচলের বন্দোবস্ত করেন, যা যোগায়োগের উন্নয়ন ঘটায় এবং বার্ষিক বন্যার কবল থেকে জনপদ, ঘরবাড়ি ও শস্যক্ষেত্র রক্ষা করত। কামরূপ, উড়িষ্যা, বঙ্গ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) ত্রিহুতসহ নিকটবর্তী হিন্দুরাজ্যগুলো তাঁর নিকট কর পাঠাতে বাধ্য হয়। লখনৌতির দক্ষিণ সীমান্তের লাখনৌতি শহর শত্রুর কবলে পড়লেও পরে তিনি তা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। সুলতান ইলতুৎমিশ পুত্র নাসিরউদ্দীন মাহমুদ বাংলায় আক্রমণ করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধে ইওয়াজ খিলজি পরাজিত ও বন্দি হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
শিল্প ও সাহিত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইওয়াজ খিলজি। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ের জুমা মসজিদ এবং আরও কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তাঁর আমলে মধ্য এশিয়া থেকে বহু মুসলিম সুফী ও সৈয়দ তাঁর দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সুফী ও সুধীগণ বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করেন। তাঁদের আগমন ও ইওয়াজ খিলজির পৃষ্ঠপোষকতায় লখনৌতি মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইওয়াজ খিলজির মৃত্যুর পর থেকে ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ষাট বছর বাংলা দিল্লির মুসলমান শাসকদের একটি প্রদেশে পরিগণিত হয়। এ সময় দিল্লির সুলতান কর্তৃক মনোনীত ১৫ জন প্রাদেশিক শাসনকর্তা বাংলা শাসন করেন। এদের মধ্যে দশ জন ছিলেন মামলুক বা দাস। তবে তারা সবাই তুর্কি ছিলেন বলে এ যুগকে তুর্কি শাসনামল বলাই যুক্তিসঙ্গত। এরপর বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় বলবনী শাসন (১২৮১-১৩২০ খ্রি.)। বুগরা খান (১২৮৭-১২৯০ খ্রি.) সুলতান রুকন উদ্দিন কায়কাউস (১২৯১-১৩০১ খ্রি.) সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২ খ্রি.) প্রমুখের শাসন শান্তি ও প্রজাকল্যাণে ছিলো নিবেদিত। তখন বাংলা নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়েছে দিল্লির বিরুদ্ধে। এর ফলে শাসনক্ষমতার আসন থেকেছে অস্থির, টলটলায়মান। যে ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছয় বছরের (১৪৮৭-৯৩) হাবশী শাসন।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ১৩৪৫-৪৬ খ্রি: মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় আসেন। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহ সফর করে তিনি প্রথমে দিল্লি ও পরে দিল্লি থেকে বাংলায় ভ্রমণ করেন। তাঁর বাংলায় আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল সিলেট গিয়ে হযরত শাহজালালের (রহ.) সাথে সাক্ষাত করা। সিলেটে কিছুদিন অবস্থান করে তিনি নদীপথে সোনারগাঁও আসেন এবং সেখান থেকে চীনা নৌযান যোগে জাভার পথে যাত্রা করেন।
ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে তখনকার বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। বাংলার প্রাচুর্য ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ইবনে বতুতাকে অবাক করেছিল। তিনি বাংলার খাদ্য সামগ্রীর স্বল্পমূল্য দেখে বিস্মিত হন। স্বল্পব্যয়ে জীবন যাপনের সহজতা প্রত্যক্ষ করেন। তিনি তাঁর বিবরণে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের প্রাচুর্য এবং রমরমা অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলেছেন, বলেছেন দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত চালের উদ্বৃত্ত মজুদ এবং বিদেশে চাল রপ্তানির কথা, আর প্রতিবেশী দেশ চীন ও জাভার সঙ্গে সোনারগাঁয়ের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের কথা। তার বর্ণনায় নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখ আছে। দেশে সুফি সাধক ও ফকিরদের মানবপ্রেম, কল্যাণী ভূমিকা ও অলৌকিকতা কাছ থেকে দেখেন। খাদ্য, পোশাক, বাহন, সেবকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের সহজলভ্যতা, জীবন যাপনের সাবলীলতা আর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ইবনে বতুতাকে আকৃষ্ট করলেও এদেশের আবহাওয়া তাঁর পছন্দ হয়নি। অতিবৃষ্টি ও তার ফলে আর্দ্রতা, বর্ষাকালের কর্দমাক্ত পথঘাট এবং বন্যাজনিত প্লাবনকে তিনি পছন্দ করতে পারেননি। তাই তিনি বাংলাকে ‘দোজখপুর-আয-নিয়ামত’ বা ধনসম্পদে পূর্ণ নরক বলে অভিহিত করেছেন। (ইবনে বতুতা : সফরনামা, এইচ আর গিব সম্পাদিত, মুহাম্মদ নাসির আলী অনূদিত, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা)। ইবনে বতুতা কিংবা তখনকার অন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্যকারের জবানীতে বাংলায় বর্বরতার চিত্রায়ন নেই, উল্লেখমাত্র নেই। আছে বরং শান্ত, নিরাপদ, সমৃদ্ধ জীবনের ভাষ্য, যার প্রতি একজন ভ্রমণকারী ঈর্ষা করতে পারেন।
দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে অব্যাহত লড়াইয়ে এ সময় বহু শাসক জীবন হারিয়েছেন। বন্দি থেকেছেন অনেকেই। প্রসাদষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতাবদলের ঘটনা ঘটতো প্রায়ই। কিন্তু এরই মধ্যে তাদের শাসনের স্বাক্ষর চিত্রিত হয়েছে সুদৃশ্য মুদ্রায়, চারুশিল্প ও হস্তশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে, বহিরাগত ও ফকির-দরবেশদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায়, মসজিদ সমাধিসৌধ ও সড়ক নির্মাণে, বহিরাগত হামলাবাজ, দস্যু ও মগদের অত্যাচার ও লুণ্ঠন থেকে রাজ্যের জনগণের রক্ষণে। তখনকার শাসকরা জনসাধারণের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রাচুর্য এবং পণ্যের সস্তাদর নিশ্চিত করতেন। রাজ্যের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার এবং সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের সুযোগকে প্রসারিত করতে সচেষ্ট থাকতেন।
মুসলিম শাসনামলে বাঙালির বস্তুগত উন্নতি ও জীবনযাত্রার সমৃদ্ধি সম্পর্কে রাজকৃষ্ণবাবুর উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেন, ‘লিখিত আছে যে, হোসেন শাহার রাজ্যারম্ভ সময়ে এতদ্দেশীয় ধনিগণ স্বর্ণপাত্র ব্যবহার করিতেন এবং যিনি নিমন্ত্রিতসভায় যত স্বর্ণপাত্র দেখাইতে পারিতেন, তিনি তত মর্য্যাদা পাইতেন। গৌড় ও পা-ুয়া প্রভৃতি স্থানে যে সকল সম্পূর্ণ বা ভগ্ন অট্টালিকা লক্ষিত হয়, তদ্দ্বারাও তাৎকালিক বাঙ্গালার ঐশ্বর্য্য শিল্পনৈপুণ্যের বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। বাস্তবিক তখন এ স্থাপত্যবিদ্যার আশ্চর্য্যরূপ উন্নতি হইয়াছিল এবং গৌড়ে যেখানে সেখানে মৃত্তিকা খনন করিলে যেরূপ ইষ্টক দৃষ্ট হয়, তাহাতে অনুমান হয় যে, নগরবাসী বহুসংখ্যক ব্যক্তি ইষ্টকনির্মিত গৃহে বাস করিত। দেশে অনেক ভূম্যধিকারী ছিলেন এবং তাঁহাদিগের বিস্তর ক্ষমতা ছিল; পাঠানরাজ্য ধ্বংসের কিয়ৎকাল পরে সঙ্কলিত আইন আকবরিতে লিখিত আছে যে, বাঙ্গালার জমিদারেরা ২৩,৩৩০ অশ্বারোহী, ৮,০১,১৫৮ পদাতিক, ১৮০ গজ, ৪,২৬০ কামান এবং ৪,৪০০ নৌকা দিয়া থাকেন। এরূপ যুদ্ধের উপকরণ যাহাদিগের ছিল, তাহাদিগের পরাক্রম নিতান্ত কম ছিল না।’ (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা, বঙ্গদর্শন, ১২৮৭, অগ্রহায়ণ)।
কথিত অন্ধকার যুগের এই সব শাসনামলে কোনো কোনো শাসকের শাসনপর্বে সাকুল্যে পনের-বিশ বছর দেশে অশান্তি ছিল। বাকিদের শাসনকাল ছিলো শান্তিপূর্ণ। নাগরিকজীবনে সম্প্রীতি, স্থিতি ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনকল্যাণের ধারা অবিচ্ছিন্ন ছিলো। যুদ্ধবিগ্রহ যা হয়েছিলো, তা হয়েছিলো দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে, কিংবা শাসকবংশের মধ্যে। তা ব্যাপকভাবে কখনো ছড়ায়নি এবং গণজীবনে বিপর্যয় ডেকে আনেনি।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের ভাষ্য, ‘মুসলিম শাসন আমল বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গঠনমূলক যুগ হিসেবে ঐতিহাসিকদের বিবেচনা লাভ করেছে। এ জনপদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ যুগেই একটি উন্নত ও সংহত রূপ লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে এ যুগেই বাংলার জনগণ একটি আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্যমঞ্চে সংঘবদ্ধ হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তিও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (মুহাম্মদ আবদুল মান্নান : আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা, কামিয়াব প্রকাশনী লি. বাংলাবাজার ঢাকা, ২০০৬।)।
ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, এখানে মুসলিম বিজয়ীরা না সম্মুখ সমরে কোনো মন্দির দখল বা ধ্বংস করেছেন, না ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনে অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের হানি করেছেন। নিজেদের শাসনাধীন অমুসলিমদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিলো ইসলামনির্দেশিত দায়িত্ব। তাদের জীবন, সম্পদ, সম্মান ও ধর্মপালনের অধিকারকে বরাবরই সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের হত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা ধর্মীয় নিপীড়নের নমুনা তৈরি করেনি মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজ। হিন্দু জাতিসত্তা বরং আপন প্রচলিত নাম ও পরিচিতি পায় মুসলিম শাসনের ফলে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেন, মুসলমান রাজত্বের পূর্বে ‘হিন্দু’ এই জাতীয় নামই ছিল না। ছিল ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি। প্রাচীন বর্ণ মূলত জাতি কিংবা স্বর্ণকার, কর্মকার, তন্তুবায় ইত্যাদি ব্যবসায় মূলত জাতি। কিন্তু ‘হিন্দু’ জাতি ছিল না। হিন্দু ধর্মও ছিল না। ছিল শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-গাণপত্য সম্প্রদায়। (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : বাংলা সাহিত্যের কথা, মধ্যযুগ, মাওলা ব্রাদার্স, অক্টোবর, ১৯৯৮।)। আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে অংশত শ্রী চৈতন্য দেবের (১৪৮৬-১৫৩৩খ্রি.) প্রেমবাদে, বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪খ্রি.) স্বসম্প্রদায় ও স্বদেশপ্রেমে এবং কিছুটা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩খ্রি.) স্বদেশ-স্বজাতির আত্মগ্লানির অনুসন্ধিৎসা থেকে, যার গোড়ায় ছিলো মুসলিম বিজয় ও শাসনের বিপরীতে প্রতিক্রিয়াজাত ধারাবাহিকতা।
লেখক: কবি, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পঞ্চদশ সংশোধনী রায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি
বন্দরে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিজয় দিবস পালন
নির্বাচিত সরকারই সংসদে পরিপূর্ণ সংস্কার করবে : আমীর খসরু
সাংবাদিক সামাদের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
টানা তৃতীয়বার সিডিপির সদস্য হলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
ছিনতাইকারীর কবলে সোনারগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি
খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ পাবে মৌলিক অধিকার
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে ইইউ’র পূর্ণ সমর্থন রয়েছে
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল সাবেক ডিবি প্রধান হারুন ও জাহাঙ্গীর-তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রেল যাত্রীদের ভোগান্তি
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি কমেছে, বেড়েছে ভিয়েতনাম-ভারত থেকে
বাংলাদেশে অংশীদারিত্বে বড় সম্ভাবনা দেখছি সুইডেনের : নিকোলাস উইকস
এশীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে
স্টিভ ব্যাননের দাবি : ট্রাম্প তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হবেন
‘সমগ্র বিশ্ব রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের নাগালে রয়েছে’ : রাশিয়ার পারমাণবিক সুরক্ষা বাহিনীর প্রধান নিহত
ইসরাইলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের
শিক্ষার্থী সীমান্ত হত্যার বিচারের দাবিতে চাষাড়ায় মানববন্ধন
রাণীশংকৈলে ফলিত পুষ্টি বিষয়ক ৩ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের উদ্বোধন
ডিএসইসি'র সদস্যদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ২৩ ডিসেম্বর