অবাধ বাকস্বাধীনতার অপব্যবহারের ঝুঁকি

Daily Inqilab মাহমিয়া আলম শান্ত

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

অবাধ বাকস্বাধীনতা গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম মূল ভিত্তি, তবে এর অপব্যবহার ব্যাপক সামাজিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। মানব মস্তিষ্কের পক্ষপাত, আবেগ এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে এই স্বাধীনতার সঠিক ব্যবহার প্রায়ই ব্যাহত হয়। প্রাচীন গ্রীসের অ্যাথেনিয়ান গণতন্ত্রে বাকস্বাধীনতা ছিল, তবে তা একেবারে সীমিত ছিল এবং শুধুমাত্র নির্বাচিত জনগণের জন্য সংরক্ষিত ছিল (থুকিডিদেস, খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০)। মধ্যযুগের ইউরোপে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান ছিল (ইনকুইজিশনের ইতিহাস, ১৪৭৮)। আধুনিক যুগেও বাকস্বাধীনতা প্রায়শই রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যেমন হিটলারের জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, যেখানে প্রচার ও প্রপাগান্ডার মাধ্যমে জনসাধারণকে দমন করার জন্য বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল (হানাহ আরেন্ট, ১৯৫১)।

গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ তার নিজস্ব বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য গ্রহণ করতে বেশি আগ্রহী, এমনকি সেগুলো ভুল হলেও। ড্যানিয়েল কানেম্যান (২০১১) তার ‘থিংকিং ফাস্ট অ্যান্ড স্লো’ গ্রন্থে বলেছেন, মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়া প্রায়শই অযৌক্তিক এবং পক্ষপাতমূলক হয়, যেখানে তারা তাদের পূর্বধারণা অনুযায়ী তথ্য গ্রহণ করে। সামাজিক মাধ্যমের যুগে, ভুল তথ্য এবং গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ২০১৭ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় জানা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে মিথ্যা তথ্য বেশি ছড়ানোর প্রবণতা রয়েছে, কারণ এখানে মতামত এবং গল্পগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকে তা বিশ্বাস করতে শুরু করে। এর ফলে মানুষ নানা ধরনের ভুল ধারণায় ভুগতে শুরু করে। এছাড়া, আবেগের প্রভাবও খুবই বড় ভূমিকা রাখে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক মিডিয়াতে ক্ষোভ, ঘৃণা এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করা পোস্টগুলো অনেক বেশি শেয়ার এবং ভাইরাল হয়। এই আবেগপ্রবণ পোস্টগুলো প্রায়ই ভুল তথ্য প্রচারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে, যেগুলো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। মানুষ যখন সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি আবেগপ্রবণ থাকে, তখন তারা প্রায়শই যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে অক্ষম হয়, যা ভুল তথ্যের বিস্তারে সহায়ক হয়।

গোষ্ঠীগত চিন্তা বা একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যার মাধ্যমে মানুষ কোনো গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে নিজেদের মতামত গ্রহণ করে, এমনকি তা ভুল হলেও। স্যালোমন অ্যাশের ১৯৫১ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কেউ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে থাকে, তারা সেই গোষ্ঠীর সম্মতি অনুযায়ী মত প্রকাশ করে, যদিও তারা জানে যে এটি ভুল হতে পারে। এর ফলে, ভুল ধারণাগুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং গণতান্ত্রিক বাকস্বাধীনতা তার সঠিক উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রের দিক থেকেও বাকস্বাধীনতা কিছু ক্ষেত্রে সীমিত হয়। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চতম আদালত বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে, যা সমাজে সহিংসতা এবং বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে (যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চতম আদালত, ১৯৬৯)। বিভিন্ন দেশে, যেমন সউদী আরব এবং উত্তর কোরিয়া, সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে বাকস্বাধীনতা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না এবং জনগণ নিজের মত প্রকাশ করতে পারে না। এসব দেশে, রাষ্ট্র জনগণের চিন্তাভাবনার ওপর কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থা আরোপ করে থাকে।

অবাধ বাকস্বাধীনতার বাস্তবায়ন কোথাও পুরোপুরি সম্ভব নয়, কারণ প্রতিটি সমাজে কিছু না কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় যাতে সহিংসতা ও বিভ্রান্তি রোধ করা যায়। বিশেষত, এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত বাকস্বাধীনতা’ রাষ্ট্রগুলো প্রয়োগ করে, যা জনগণের স্বাধীনতা সীমিত করলেও, সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি নিশ্চিত করে যে, স্বাধীনতা কোনও ধরনের সহিংসতা, ঘৃণা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে না। তবে, নোয়াম চমস্কি (১৯৮৮) তার বই ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেপ্ট’-এ বলেছেন, গণমাধ্যমগুলো জনগণের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম এবং মিডিয়ার দায়িত্ব হলো নিরপেক্ষভাবে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা। তার মতে, মিডিয়ার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগণের ভাবনা বিকৃত না করে তাদের যথাযথ তথ্য সরবরাহ করা।

সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি বিতর্কিত ঘটনা ঘটে, যেখানে কিছু ব্যক্তি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে, বিশেষ করে সোহেল হাসান গালিব এবং রাখাল রাহা ওরফে সাজ্জাদুর রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, অপমানজনক এবং অবমাননাকর লেখা লিখে সমালোচিত হয়েছেন। এই ধরনের প্রকাশ স্বাধীনতা যখন অন্যের ধর্মীয় বা সামাজিক অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, তখন এটি শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নয়, সমগ্র সমাজকে বিভক্ত ও অস্থিতিশীল করে তোলে। এমন কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার হয় না, বরং এটি সহিংসতা, ঘৃণা এবং বিভেদের সৃষ্টি করতে পারে, যা সমাজে সংঘাতের জন্ম দেয়। এ ধরনের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি এবং এর মাধ্যমে স্বাধীনতার সীমা ¯পষ্টভাবে নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা ফুটে ওঠে।

মানব মস্তিষ্কের পক্ষপাত, আবেগ এবং গোষ্ঠীগত চিন্তার কারণে অবাধ বাকস্বাধীনতা অবশ্যই অপব্যবহৃত হবে। অবাধ বাকস্বাধীনতা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না, কারণ এটি অসীম মুক্তির এক ভ্রান্ত ধারণা। যখন বাকস্বাধীনতার কোনও সীমা বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন ব্যক্তি তার মতামত প্রকাশের নামে সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। মিথ্যা তথ্য বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের প্রভাব অনেক গভীর হতে পারে; যা মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ, সংঘর্ষ এবং ভীতি সৃষ্টি করে। একদিকে, বাকস্বাধীনতার পূর্ণ অধিকার দেয়ার ফলে কিছু মানুষের কুসংস্কার বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের সুযোগ বাড়ে, অন্যদিকে এটি সমাজে বিভেদ বাড়াতে সহায়তা করে। তাই, অবাধ বাকস্বাধীনতার পরিবর্তে, এটি সীমাবদ্ধ রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে, যাতে কেউ অন্যের অধিকার বা নিরাপত্তা ক্ষুণœ না করে এবং সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় থাকে। এজন্য গণতান্ত্রিক সমাজে বাকস্বাধীনতার সঠিক ব্যবহারের জন্য শিক্ষা এবং তথ্য যাচাইয়ের উপরে গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে হবে, যাতে তারা ভুল তথ্যের বিস্তার রোধ করতে পারে এবং জনগণ সঠিক তথ্য পেতে পারে।

লেখক : শিক্ষার্থী, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: mahimaalamsanta@gmail.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

স্কাউট আন্দোলন জোরদার করতে হবে
ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র : শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার বিএনপি এবং আজকের বিএনপি
গাজাবাসীর ডাকে নো ওয়ার্ক নো স্কুল কর্মসূচি
মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আরও
X

আরও পড়ুন

সিরাজগঞ্জে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জরিমানা

সিরাজগঞ্জে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জরিমানা

বেফাক পরীক্ষায় জামিয়া গাফুরিয়া  ইসলামপুর মাদরাসার সাফল্য

বেফাক পরীক্ষায় জামিয়া গাফুরিয়া  ইসলামপুর মাদরাসার সাফল্য

ঘৃণার বিষ

ঘৃণার বিষ

উল্লাপাড়ায় ১২ টি টিয়ারশেল উদ্ধার

উল্লাপাড়ায় ১২ টি টিয়ারশেল উদ্ধার

গাজা ইস্যুতে কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

গাজা ইস্যুতে কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

মদ ও মাদক সহ গ্রেফতার পাকিস্তান সেনার একাধিক উচ্চপদস্থের পুত্র-কন্যা

মদ ও মাদক সহ গ্রেফতার পাকিস্তান সেনার একাধিক উচ্চপদস্থের পুত্র-কন্যা

মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসায় আটক, মার্কিন অভিবাসন কেন্দ্রে আত্মঘাতী চীনা মহিলা

মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসায় আটক, মার্কিন অভিবাসন কেন্দ্রে আত্মঘাতী চীনা মহিলা

এবছর একাধিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে ইরান

এবছর একাধিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে ইরান

গাজায় গণহত্যা: পাকুন্দিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান

গাজায় গণহত্যা: পাকুন্দিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান

ফটিকছড়িতে বিল্ডিং থেকে পড়ে  গ্ৰামীণ ব্যাংক ম্যানেজার নিহত

ফটিকছড়িতে বিল্ডিং থেকে পড়ে গ্ৰামীণ ব্যাংক ম্যানেজার নিহত

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নতুন ৫ দফা

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নতুন ৫ দফা

রাজধানীতে পৃথক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ৩

রাজধানীতে পৃথক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ৩

রিদপুরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে যাওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭, পরিচয় মিলছে সকলের

রিদপুরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে যাওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭, পরিচয় মিলছে সকলের

ঘাটাইলে কৃষি জমির টপসয়েল কাটার অপরাধে ২ জনের জেল

ঘাটাইলে কৃষি জমির টপসয়েল কাটার অপরাধে ২ জনের জেল

আওয়ামীলীগের ধূসররা লুটপাট ও ভাংচুর করছে : টুকু

আওয়ামীলীগের ধূসররা লুটপাট ও ভাংচুর করছে : টুকু

দুই সচিব ও  ডিসি প্রত্যাহার

দুই সচিব ও ডিসি প্রত্যাহার

মঠবাড়িয়ায় ট্রাক চাপায় ইজিবাইকের নারী যাত্রী নিহত

মঠবাড়িয়ায় ট্রাক চাপায় ইজিবাইকের নারী যাত্রী নিহত

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিলেন হাসনাত

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিলেন হাসনাত

রায়পুরে আধিপত্য বিস্তারে খুনের জেরে তিন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, এলাকায় আতঙ্ক

রায়পুরে আধিপত্য বিস্তারে খুনের জেরে তিন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, এলাকায় আতঙ্ক

উন্নয়ন সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী

উন্নয়ন সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী