বিরোধ-বিসংবাদ শঙ্কা জাগাচ্ছে
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। বলতে গিয়ে কথার মাঝে সম্মান-শ্রদ্ধার লেশমাত্রও থাকছে না কখনো কখনো। সেইসঙ্গে কারো কারো বডি ল্যাঙ্গুয়েজও আপত্তিজনক। কখনো কখনো সরকারকেও পক্ষ করে ফেলা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেই ফেলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার যেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখে সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। মোটকথা, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ নয়, তা বলতে বেশি রাখেননি।
মির্জা ফখরুলের এমন কথার প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি করেননি সরকারের শরীক ছাত্রদের প্রতিনিধি সদ্য পদত্যাগকারী তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিএনপি মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটা ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে অভিযোগ করেছেন নাহিদ। ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে সামনে আরেকটা ১/১১ সরকার, সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা এবং গুম-খুন ও জুলাই হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ার আভাস রয়েছে। নাহিদ ইসলামের পোস্ট শেয়ার করে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, আন্দোলনের ডাক দিয়ে, যারা মাঠ থেকে সরে যেত, তারাই আঁতাতের রাজনীতি করছে।
যেকোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাকেন্দ্রিক লড়াই হয় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ বিপ্লবে শামিল হওয়ায় এমনটা হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হয়েছে। বিপ্লবের পর বিভাজন রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই স্বাভাবিক ঘটনা, এই বিভাজন এড়িয়ে যেতে পারাটাই কাক্সিক্ষত। সেখানে বড় হতাশা। তাদের এ বাহাস ও খোঁচা-খোঁটা চলমান রাজনীতিতে নতুন ঝড়-ঝঞ্জার শঙ্কা জাগাচ্ছে। নিজেদের মাঝে বিবাদের পাশাপাশি ফ্যাসিস্টদের ফিরে আসার পথঘাট তৈরি হচ্ছে বলেও আভাস পাচ্ছেন রাজনীতির বোদ্ধারা। মির্জা ফখরুল যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই বলেছেন, যেহেতু ছাত্ররা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করছে। এখানে সরকারে যদি ছাত্রদের প্রতিনিধি থাকে, তাহলে তো সরকার নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না। বলা চলে, এটি সরকারকে সতর্কবার্তা বা এক ধরনের প্রেশারে রাখার বক্তব্য। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কাছে তা এরকম নয়। তাদের জবাব আক্রমণাত্মক।
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও এখন একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়েছে। ছোটখাটো সংঘাতও বেঁধেছে তাদের মধ্যে। বাংলামোটরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় অফিসে হামলা, মারামারি হয়েছে। এর পূর্বাপরে, ভেতরে-বাইরে রয়েছে নানা অঘটন। নমুনাও ভালো নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন সার্বজনীন কোনো সংগঠন নয়। রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীদের অনেকেই এ প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেছে। জুলাই অভ্যুত্থানে সবচেয়ে ঝুঁকি নেওয়া কড়াই থেকে চুলায় পড়ে যায় কি না, এমন জিজ্ঞাসার মাঝে একটু একটু জবাবও মিলছে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তাদের কেবল শিক্ষাজীবন নয়, জীবনই ‘নাই’ হয়ে যেত। তাদের সেই শক্তি এখন আর নেই। জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে তাদের যে অংশটি নতুন দল গঠনে মাঠে সক্রিয় তাদেরও রয়েছে অনেক অব্যক্ত কথা। জাতীয় নাগরিক কমিটি জুলাই ফাউন্ডেশন সম্পর্কে যে অভিযোগ করেছে তাও গুরুতর। ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দিয়েছেন আলোচিত আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম। এর কারণ হিসেবে বলেছেন, তিনি এখন আর এ কাজে সময় দিতে পারছেন না। পুরো বিষয়টিই গোলমেলে। অথচ, তারা বিশ্বময় আলোচিত-প্রশংসিত। দেশেও সমাদৃত-আদরণীয়। সেইসঙ্গে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। এমন একটি গরম সময়ে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ। আবার আন্দোলনের মাঠকে বিজয়ের উপযুক্ত করে দেওয়ার সুপার পাওয়ার বিএনপির সঙ্গে তাদের বিরোধ। এর মাঝে অদৃশ্য সুতার টান ধারণা করছেন কেউ কেউ। সেটাও আবার নির্বাচনী ট্রেনের হুইসেল বাজার সময়ে।
গণতান্ত্রিক সমাজে নিজের মত প্রকাশ করার ও দল করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। কিন্তু সেই দলের সঙ্গে রাষ্ট্র বা প্রশানযন্ত্রের কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তাই সেই প্রশ্ন উঠেছে। আর এই করণেই কি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ছাত্র-জনতার উদ্যোগে গঠিত হতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দলের হাল ধরতে পারেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। এছাড়া আগামী জুন মাসে আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও নাকি পদত্যাগ করতে পারেন। এদিকে, ছাত্রদের নতুন দলের গঠনতন্ত্রের কাজ চলমান রয়েছে। দেশের ও দেশের বাইরে বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যেসব রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে সেসব দলের গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এই তালিকায় আছে তুরস্কের এরদোয়ানের একে পার্টি, পাকিস্তান তেহরিক ইনসাফ পার্টি, ইন্দোনেশিয়ার আন্না হাদা পার্টির গঠনতন্ত্র।
মাত্র কদিন আগে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলসহ তাদের একসঙ্গে দেখলে তিনি সাহস পান। অথচ, সেখানে এখন প্রধান উপদেষ্টার ‘সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে দেখা’র অভিপ্রায়ে গোলমাল দেখা দিয়েছে। মির্জা ফখরুল তার শঙ্কার কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নির্বাচন যদি দ্রুত না হয়, সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে অন্যান্য শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। তখন জনগণের যে চাহিদা, সেই চাহিদা থেকে তারা পুরোপুরিভাবেই বঞ্চিত হয়।’
বলার তো অপেক্ষা রাখে না, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন ছিল। কিন্তু মাত্রমাস কয়েকে সেই মনোজগতে পরিবর্তন। জনমনেও নানা সংশয়-শঙ্কা। ৫ আগস্টের আগে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক দলের অভিন্ন প্রতিপক্ষ ছিল স্বৈরাচারী সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকার বিদায় নেওয়ার পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল, আন্দোলনকারী সব পক্ষের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবে। অন্তত তারা জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে ব্রতী হবে। কিন্তু বাস্তবটা দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব ও একাধিক উপদেষ্টা-ছাত্রনেতার মধ্যে চলমান বাহাস এ শঙ্কাকে কেবলই ভারি করছে। পাশাপাশি সরকারের গ্রহণযোগ্যতায়ও দিনে দিনে কিছুটা ভাটা পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি আনতে পারেনি সরকার। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল বিরক্ত।
গণহত্যাকারী পুলিশ, র্যাব, গুমকারী ও আয়নাঘরের সঙ্গে জড়িত সেনাসদস্যদের বিচার দেখতে চায় মানুষ। এসব বিষয়ে সরকারের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়। বিএনপির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংস্কার নিয়েও মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি চায় প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচিত সরকারের হাতে বাদবাকি সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হোক। সরকার সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন করেছে। সংস্কারের জন্য এই কমিশনের গঠনের ধারণাও বিএনপির। অনেক আগেই তারা ৩১ দফায় এসব কথা বলেছিল। সংস্কার কমিশনগুলো যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার অধিকাংশই বিএনপি অনেক আগেই ঘোষণা করেছে যে তারা ক্ষমতায় গেলে এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। বিএনপি এ-ও বলেছে, নির্বাচিতদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। ওই নির্বাচিত সরকার সবাইকে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে। বিএনপির এসব প্রস্তাব ছাত্রদের পছন্দ নয়। তাদের ধারণা নির্বাচনে জয়ের পর বিএনপি এসব ভুলে যাবে। তখন বিএনপিও ছাত্রদের সাথে ওই আচরণই করবে, যা আওয়ামী লীগ করেছে। আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে না পারার জন্যও তারা বিএনপিকে দূষছে। বিএনপি এ নিয়ে অতি রাজনীতি করেছে, ক্ষমতায় গেলে আরো করবে বলে অনেকটা নিশ্চিত ছাত্ররা।
অন্তর্বর্তী সরকারেরও এ নিয়ে কোনোপক্ষে অবস্থান নেয়ার অবস্থা এখন আর নেই। বরং সরকারই ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন মহল থেকে সরকারে বিরুদ্ধে কটু কথা বলার চর্চাও চলছে। গোটা বিষয়টি খারাপ নজির তৈরি করছে। তার ওপর বাজার পরিস্থিতির জন্য মানুষ নানা সমালোচনায় সরকারের ছালবাকলা তুলে ফেলতে শুরু করেছে। এ দেশ ও প্রকৃতির নিয়মও বড় কঠিন। প্রকৃতি বদলায় মাস-মাসান্তরে, মানুষের মনোজগত বদলায় সকাল-সন্ধ্যায়। এই নিয়মে এখানে কাউকে নিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দিতে তত সময় লাগে না। মাথায় তুলতে সময় নেয় না, ছুড়ে ফেলে পায়ের তলায় নিতেও সময় লাগে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

সিরাজগঞ্জে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জরিমানা

বেফাক পরীক্ষায় জামিয়া গাফুরিয়া ইসলামপুর মাদরাসার সাফল্য

ঘৃণার বিষ

উল্লাপাড়ায় ১২ টি টিয়ারশেল উদ্ধার

গাজা ইস্যুতে কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

মদ ও মাদক সহ গ্রেফতার পাকিস্তান সেনার একাধিক উচ্চপদস্থের পুত্র-কন্যা

মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসায় আটক, মার্কিন অভিবাসন কেন্দ্রে আত্মঘাতী চীনা মহিলা

এবছর একাধিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে ইরান

গাজায় গণহত্যা: পাকুন্দিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান

ফটিকছড়িতে বিল্ডিং থেকে পড়ে গ্ৰামীণ ব্যাংক ম্যানেজার নিহত

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নতুন ৫ দফা

রাজধানীতে পৃথক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ৩

রিদপুরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে যাওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭, পরিচয় মিলছে সকলের

ঘাটাইলে কৃষি জমির টপসয়েল কাটার অপরাধে ২ জনের জেল

আওয়ামীলীগের ধূসররা লুটপাট ও ভাংচুর করছে : টুকু

দুই সচিব ও ডিসি প্রত্যাহার

মঠবাড়িয়ায় ট্রাক চাপায় ইজিবাইকের নারী যাত্রী নিহত

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিলেন হাসনাত

রায়পুরে আধিপত্য বিস্তারে খুনের জেরে তিন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, এলাকায় আতঙ্ক

উন্নয়ন সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী