হামাস আরো শক্তিশালী হবে
১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:১১ এএম | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:১১ এএম

ইসরাইল গাজায় পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা করে। ইসরাইলের হামলায় ফিলিস্তিনিরা সবই হারিয়েছে। তারপরও তারা গাজা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়নি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও গাজার অধিবাসীরা গাজাতেই রয়ে গেছে। তারা হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছে কিন্তু ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব, আগ্রাসন এবং নির্যাতনের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সামরিক শক্তির জোরে ইসরাইল যা খুশি তা করলেও, শেষ পর্যন্ত হামাসের সাথেই তাকে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করতে হয়েছে। হামাসের সাথে চুক্তি ছাড়া ইসরাইল একজন জিম্মিকেও উদ্ধার করতে পারেনি। এতে প্রমাণিত হয়েছে, হামাস নির্মূল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে হামাস ছিল, আছে এবং থাকবে।
ইসরাইলি বর্বরতায় গাজা বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলি দীর্ঘ আগ্রাসন এবং অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। এতে কিছু ইসরাইলি মারা যায় এবং কিছু ইসরাইলিকে বন্দি করা হয়। তারপর থেকেই ইসরাইল নির্বিচারে গাজায় হামলা চালায় যার ফলে ৪৮ হাজারের ও বেশি মানুষ মারা যায় এবং লক্ষাধিক মানুষ আহত হয়। হাজারো মানুষ বিভিন্ন অংগ হারিয়ে চিরতরে পংগু হয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কেউই হামলা থেকে রেহাই পায়নি। ইসরাইলি হামলায় হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া, পরবর্তী প্রধান ইয়াহিয়া সিনাওয়ারসহ অনেক শীর্ষ নেতা মারা গেছেন। ইসরাইলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে হাজারো বাড়িঘর, অফিস আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, গির্জা এবং হাসপাতাল মাটিতে মিশে গেছে। গাজার বেশির ভাগ মানুষই আজ উদ্বাস্তু। তারা খোলা আকাশের নিচে বাস করছে এবং ত্রাণের খাবার খেয়েই দিন কাটাচ্ছে। গাজায় মানবতার মৃত্যু হয়েছে। গাজাবাসী হাসিমুখে জীবন দিয়েছে, কিন্তু ইসরাইলি আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করেনি। তাই ইসরাইল বাধ্য হয়ে হামাসের সাথে যুদ্ধ বিরতি করেছে।
হামাসের উত্থানে ফিলিস্তিনের রাজনীতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ফিলিস্তিনের রাজনীতি এবং জনগণ দুভাগে বিভক্ত। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ, অপরদিকে ইসলামপন্থি হামাস। ফাতাহর সাথে রয়েছে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। হামাস হচ্ছে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর বিরোধী। ফাতাহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশ্রস্ত্র সংগ্রামকে পরিত্যাগ করেছে। হামাস সশ্রস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে চায়। ইসরাইলের অস্তিত্বকে ফাতাহ স্বীকার করে, হামাস অস্বীকার করে। ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৬টি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাওয়ায় ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা আতংকিত হয়ে পড়ে। তারা হামাসকে বয়কট করে এবং ফিলিস্তিনের প্রতি সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর হামাসের নিয়ন্ত্রণাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধের লক্ষ্য মার্কিন কংগ্রেসে প্যালেস্টাইনিয়ান এন্টি-টেররিজম অ্যাক্ট ২০০৬ নামের বিল পাস হয়। পশ্চিমাদের মদদে ২০০৭ সালের ১৪ জুন মাহমুদ আব্বাস হামাস সরকারকে বরখাস্ত করে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে হামাস ঐদিনই গাজা দখল করে নেয়। তখন থেকেই গাজায় চলছে হামাসের শাসন আর পশ্চিম তীরে চলছে ফাতাহর শাসন। ইসরাইল তখন থেকেই গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা ফিলিস্তিনকে অন্যায়ভাবে বিভক্ত করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের প্রতি দমন নির্যাতন ও আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। যখন ইচ্ছা আগ্রাসন চালিয়েছে, হত্যা করেছে, বুলডোজার দিয়ে বসতবাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে, যাকে ইচ্ছা ধরে নিয়ে কারাগারে আটকে রেখেছে। ইসরাইলকে রক্ষায় জাতিসংঘে সব সময় যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করেছে। কিন্তু এত নির্যাতন সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আন্দোলন স্তিমিত হয়নি বরং বেগবান হয়েছে। ইয়াসির আরাফাতের ধর্মনিরপেক্ষ ফাতার নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় ইসলামের ভিত্তিতে নতুন ফিলিস্তিন গড়তে ১৯৮৭ সালে শেখ আহমদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ রানতিসি এবং খালেদ মোশলে হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হামাস মোকাবেলা করেছে ইসরাইলের অব্যাহত নির্যাতন ও ষড়যন্ত্র, যাতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করেছে। কিন্তু সকল প্রকার নির্যাতন ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে হামাস কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ইসলামের অনুসরণ, সততা, দায়িত্বশীলতা, চারিত্রিক উৎকর্ষ, শৃংখলা, জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি সর্বোপরি স্বাধীনতা ও ইসরাইলের ব্যাপারে আপোমহীন সংগ্রাম এবং ত্যাগের কারণে হামাসের ওপর ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থন অতিদ্রুত বেড়েছে। হামাসের ওপর যত নির্যাতন এসেছে, সে তত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হামাসের অর্ধশতকেরও বেশি নেতাকে আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে ইসরাইল বহিষ্কার করেছিল এবং তারা দীর্ঘদিন নোম্যান্স ল্যান্ডে তাবু বানিয়ে বসবাস করেছিল। কিন্তু আপোস করেনি। ইসরাইল বিভিন্ন সময়ে শেখ আহমদ ইয়াসিন, আব্দুল আজিজ রানতিসিকে, ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনাওয়ার, মুহাম্মদ দেইফসহ অসংখ্য শীর্ষ নেতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু হামাস নির্মূল হয়নি।
হামাস, স্বাধীনতার জন্য আপোসহীন এক সংগ্রামী দল। দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে হামাসই এখন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। হামাসের ওপর অতিমাত্রায় দমননীতি ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হয়েছে। তারা অর্জন করেছে ব্যাপক আস্থা ও জনপ্রিয়তা। হামাস কিন্তু বাইরের সাহায্য ছাড়াই, জনগণের ভিতর থেকেই গড়ে ওঠা একটি দল। হামাসকে ক্ষমতাচ্যুত, গাজার ওপর অবরোধ এবং সাম্প্রতিক কালে পুরো গাজাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা এবং গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো ধ্বংস করে ও হামাসকে নির্মূল করা যাবে না। জনগণ সবসময় দেশপ্রেমিক এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াইরত দলের প্রতিই সমর্থন জানায়। এটা রাজনীতির ইতিহাসের প্রমাণিত সত্য এবং বাস্তবতা। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত দলকে কখনো নির্মূল করা যায় না। ষড়যন্ত্র এবং নির্যাতনের মাধ্যমে সাময়িকভাবে গতিরোধ করা যায় মাত্র। কিন্তু পরবর্তীতে সেই দল আরো ব্যাপক জনসমর্থন এবং শক্তি নিয়ে আর্বিভূত হয়। নদীর স্বাভাবিক গতি প্রবাহে প্রতিবদ্ধকতা নদীর প্রবাহকে সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখে মাত্র, কিন্তু পরবর্তীতে সেই নদীর প্রবাহ শুধু প্রতিবন্ধকতাকে উৎখাত করে না, বরং পুরো জনপদকেই পানির নিচে ডুবিয়ে ধ্বংস করে। জোর করে মানুষের মন জয় করা যায় না এবং স্বাধীনতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখাও যায় না। হামাস গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বিজয়ী হয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। আধুনিক মারণাস্ত্র এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে ইসলামপন্থি হামাসকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হলেও সেখানকার জনগণের মন এবং বিশ্বাস থেকে ইসলামকে কিছুতেই বিতাড়িত করা সম্ভব নয়। সুতরাং ইসলামপন্থিদের উত্থান সেখানে হবেই। আগ্রাসন এবং নির্যাতনের কারণে ইসলামপন্থি হামাসের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে এবং আরো শক্তি অর্জন করবে। কোন দেশ বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হলে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শক্তিকেই জনগণ সমর্থন জানায়। কোনো দেশের জনগণ পরাধীনতা মানতে চায় না এবং তাবেদার শক্তিকে সমর্থনও করে না। বিদেশি আগ্রাসন জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবোধকেই জাগিয়ে তোলে। বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শক্তিকেই জনগণ সবসময় সমর্থন জানায়। সুতরাং ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থি হামাসের ক্ষয় নেই। অচিরেই তারা আরো বেশি শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হবে।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।
মেইল : omar_ctg123@yahoo.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

সিরাজগঞ্জে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জরিমানা

বেফাক পরীক্ষায় জামিয়া গাফুরিয়া ইসলামপুর মাদরাসার সাফল্য

ঘৃণার বিষ

উল্লাপাড়ায় ১২ টি টিয়ারশেল উদ্ধার

গাজা ইস্যুতে কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

মদ ও মাদক সহ গ্রেফতার পাকিস্তান সেনার একাধিক উচ্চপদস্থের পুত্র-কন্যা

মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসায় আটক, মার্কিন অভিবাসন কেন্দ্রে আত্মঘাতী চীনা মহিলা

এবছর একাধিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে ইরান

গাজায় গণহত্যা: পাকুন্দিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান

ফটিকছড়িতে বিল্ডিং থেকে পড়ে গ্ৰামীণ ব্যাংক ম্যানেজার নিহত

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নতুন ৫ দফা

রাজধানীতে পৃথক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ৩

রিদপুরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে যাওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭, পরিচয় মিলছে সকলের

ঘাটাইলে কৃষি জমির টপসয়েল কাটার অপরাধে ২ জনের জেল

আওয়ামীলীগের ধূসররা লুটপাট ও ভাংচুর করছে : টুকু

দুই সচিব ও ডিসি প্রত্যাহার

মঠবাড়িয়ায় ট্রাক চাপায় ইজিবাইকের নারী যাত্রী নিহত

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিলেন হাসনাত

রায়পুরে আধিপত্য বিস্তারে খুনের জেরে তিন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, এলাকায় আতঙ্ক

উন্নয়ন সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী