আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন

Daily Inqilab মোবায়েদুর রহমান

২৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০৬ এএম | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০৬ এএম

পাঠকদের হয়তো স্মরণ আছে যে গত ১১ মার্চ মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাবে আমি যে কলামটি লিখেছিলাম সেটির শিরোনাম ছিল, ‘আ. লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে না : কোনো ঐকমত্যও হচ্ছে না : ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের তোড়জোড়’। বাংলাদেশে রাজনীতির প্রবাহ দ্রুত সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছে। কীভাবে হচ্ছে সেটি নিচের আলোচনা থেকেই বোঝা যাবে। 
গত ২০ মার্চ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ দারুণ উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। ঐদিন আমি দুপুর ১২টার দিকে একটি লেখার প্রস্তুতি হিসেবে কয়েকটি দৈনিকের ওপর চোখ বুলাচ্ছিলাম। এমন সময় একটি ফোন এলো। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমাকে বলা হলো, আমি কি হাসনাত আব্দুল্লাহর ফেসবুক পোস্ট পড়েছি কিনা। আমি না বললে বলা হলো, এক্ষুণি পড়–ন। তৎক্ষণাৎ কম্পিউটার ওপেন করে পড়লাম। পড়ে আমি রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাংলাদেশে অনেকগুলো বড় বড় আন্দোলন হয়েছে। সামরিক আইনও জারি হয়েছে কমপক্ষে ৩ বার। কিন্তু ছাত্র-জনতা  এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হতে দেখা যায়নি। বরং ৯০ এর গণআন্দোলনে জেনারেল নূরুদ্দিনের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী আন্দোলনরত জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। তাই সেদিন এরশাদের পতন হয়েছিল। অনুরূপভাবে এতদিন আমরা জানতাম যে, জুলাই অভ্যুত্থানেও সেনাবাহিনী শেষ দিকে অর্থাৎ ৩ আগস্ট থেকে জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণে অস্বীকার করে। যার ফলে ৩ আগস্টই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ৩ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রায় সমস্ত অফিসারকে অ্যাড্রেস করেন আর্মি চিফ জেনারেল ওয়াকার। ঢাকার সেনা অফিসাররা ছিলেন সশরীরে। ঢাকার বাইরে যারা তারা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। সেখানে সেনাবাহিনীর সাধারণ জওয়ান, জুনিয়র অফিসার এবং মিড র‌্যাংঙ্কিং অফিসাররা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে আর গুলি ছুঁড়তে অস্বীকার করেন। জাতিসংঘ এসম্পর্কে যে রিপোর্ট দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে, ১ হাজার ৪০০ আদম সন্তান নিহত হয়েছেন। এসম্পর্কিত জাতিসংঘের ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকে গৃহীত ঈধঁংবং ড়ভ ঢ়ৎড়ঃবংঃ-ৎবষধঃবফ শরষষরহমং এর চিত্র থেকে দেখা যায় যে, শটগানের গুলিতে নিহত হয়েছেন ১২ শতাংশ, পিস্তলের গুলিতে ২ শতাংশ, অন্যান্য ২০ শতাংশ এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ নিহত হয়েছেন ৭.৬২ বোরের গুলিতে। 
৩ আগস্টের সর্বশ্রেণীর সেনা সমাবেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেনা নেতৃত্ব জনগণের ওপর গুলি না ছোঁড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখনই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। 
দৈনিক ইনকিলাবের একটি ডিজিটাল ইন্টারভিউয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি বলেন যে, ৪ আগস্ট রাত ১২টার পর তিনি সেনাপ্রধানের অফিস থেকে একটি ফোন পান যেখানে বলা হয় যে, সেনাপ্রধান তার সরকারি বাসায় পরের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্ট ঠিক সকাল ১০টায় তার সাথে কথা বলতে চান। তদনুযায়ী মেজর জেনারেল ফজলে এলাহি পরদিন কাঁটায় কাঁটায় ১০টায় সেনাপ্রধানের বাসায় গেলে দেখেন যে, সামরিক পোশাক পরিহিত জেনারেল ওয়াকার উজ জামান তার জন্য অপেক্ষা করছেন। জেনারেল ওয়াকার তাকে জানান যে, হাসিনা সরকারের পতন হবে। অতঃপর একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে জেনারেল ফজলে এলাহি যেন তাকে সাহায্য করেন। 
কথাবার্তার এক পর্যায়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান ফজলে এলাহিকে জানান যে, ঠিক সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ভারতীয় সেনাপ্রধান তাকে ফোন করবেন। ফজলে এলাহি সেখানে থাকতে থাকতেই সেই ফোন আসে। জেনারেল ওয়াকার উজ জামান ফজলে এলাহিকে বলেন যে, এই সেই ফোন। তবে ফজলে এলাহি ইচ্ছা করলে থাকতে পারেন। মেজর জেনারেল ফজলে এলাহি সৌজন্য দেখিয়ে তৎক্ষাণাৎ বেরিয়ে আসেন। ॥দুই॥ফিরে যাচ্ছি হাসনাত আব্দুল্লাহর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। এ যেন আমার স্তম্ভিত চেতনার ওপর এক বিদ্যুৎ প্রহার। কিছুক্ষণ পর আরেকটি স্ট্যাটাস দেখলাম। এটি দিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এর মধ্যে ৫ দিন পার হয়ে গেছে। প্রথম দিন ইউটিউবে আসিফ মাহমুদের সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্তসার ছিল। কিন্তু ২২ মার্চ এই সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হয়। হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং আসিফ মাহমুদের স্ট্যাটাস এখন ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এখন এগুলো পরিণত হয়েছে টক অব দি কান্ট্রিতে। আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার সাক্ষাৎকারে রীতিমত তথ্য বোমা ফাটিয়েছেন। 
॥তিন॥এখানে বিষয়গুলি যদি ফিল্টার করি তাহলে দুইটি ইস্যু বেরিয়ে আসে। একটি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন। আরেকটি হলো আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন। এই দুটি ইস্যু নিয়ে ২১ এবং ২২ মার্চ দুই দিন সারাদেশে সৃষ্টি হয় প্রচন্ড রাজনৈতিক উত্তেজনা। দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে দেশপ্রেমিক মহল অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমরা বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। অনেকের আশঙ্কা হয়েছিল যে, এনসিপির নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার সাথে এস্টাব্লিশমেন্টের মতবিরোধ কোন্ পর্যায়ে যায়। সুতরাং দেশপ্রেমিক মহল নেপথ্য থেকে চেষ্টা করেন, তাদের সম্পর্কের আর যেন কোনো অবনতি না হয়। বরং তাদের দূরত্ব যতদূর কমানো সম্ভব কমিয়ে ফেলার জোর নেপথ্য প্রচেষ্টা চলে। এই মুহূর্তে স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলে আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহর মেহেরবানীতে উত্তেজনার পারদ অনেকটা নেমে গেছে। 
॥চার॥এখন সব পক্ষকে চেষ্টা করতে হবে আওয়ামী লীগের প্রশ্নে এমন একটি সমাধানে আসা যেটা সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হয়। দেখা যাচ্ছে যে, ২৪ এর গণবিপ্লবের স্টেক হোল্ডারদের প্রায় সকলেই আওয়ামী লীগকে আর রাজনীতির মাঠে ফেরাতে রাজি নন। সোজা কথা, তারা চান আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক। যদি নির্বাহী আদেশে না হয় তাহলে আওয়ামী লীগ যে কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং একটি সন্ত্রাসী সংগঠন, সেই মর্মে আদালতে মামলা করা হোক। এই মহল মনে করেন যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হাজার হাজার প্রমাণ আছে যার মাধ্যমে অতি সহজেই এটা এস্টাব্লিশ করা যাবে যে, আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। 
আওয়ামী লীগকে যদি ইলেকশন তো দূরের কথা, রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আমার যে অবজারভেশন, সেটা থেকে বলতে পারি, আওয়ামী লীগ মাঠে নামতে চাইলে যেখানেই নামবে সেখানেই মারামারি হবে। সেক্ষেত্রে সারাদেশে আওয়ামী লীগকে কেন্দ্র করে শুধু বিশৃঙ্খলা নয়, মারামারি হানাহানি শুরু হবে। সেজন্য সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিতে হবে সব দল (আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ঘরানা ছাড়া) অবিলম্বে বৈঠকে বসুন। এই মুহূর্তে বিএনপি দেশের বৃহত্তম দল। বড় দল বা বড় ভাই হিসেবে তারাই এই বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করেন না কেন?

Email: journalist15@gmail.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

স্কাউট আন্দোলন জোরদার করতে হবে
ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র : শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার বিএনপি এবং আজকের বিএনপি
গাজাবাসীর ডাকে নো ওয়ার্ক নো স্কুল কর্মসূচি
মিয়ানমারে ভূমিকম্প এবং আমাদের ভয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উচিৎ কথা
আরও
X

আরও পড়ুন

সিরাজগঞ্জে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জরিমানা

সিরাজগঞ্জে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, যৌথ বাহিনীর অভিযানে জরিমানা

বেফাক পরীক্ষায় জামিয়া গাফুরিয়া  ইসলামপুর মাদরাসার সাফল্য

বেফাক পরীক্ষায় জামিয়া গাফুরিয়া  ইসলামপুর মাদরাসার সাফল্য

ঘৃণার বিষ

ঘৃণার বিষ

উল্লাপাড়ায় ১২ টি টিয়ারশেল উদ্ধার

উল্লাপাড়ায় ১২ টি টিয়ারশেল উদ্ধার

গাজা ইস্যুতে কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

গাজা ইস্যুতে কুষ্টিয়ায় ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল

মদ ও মাদক সহ গ্রেফতার পাকিস্তান সেনার একাধিক উচ্চপদস্থের পুত্র-কন্যা

মদ ও মাদক সহ গ্রেফতার পাকিস্তান সেনার একাধিক উচ্চপদস্থের পুত্র-কন্যা

মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসায় আটক, মার্কিন অভিবাসন কেন্দ্রে আত্মঘাতী চীনা মহিলা

মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসায় আটক, মার্কিন অভিবাসন কেন্দ্রে আত্মঘাতী চীনা মহিলা

এবছর একাধিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে ইরান

এবছর একাধিক উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে ইরান

গাজায় গণহত্যা: পাকুন্দিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান

গাজায় গণহত্যা: পাকুন্দিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহবান

ফটিকছড়িতে বিল্ডিং থেকে পড়ে  গ্ৰামীণ ব্যাংক ম্যানেজার নিহত

ফটিকছড়িতে বিল্ডিং থেকে পড়ে গ্ৰামীণ ব্যাংক ম্যানেজার নিহত

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নতুন ৫ দফা

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নতুন ৫ দফা

রাজধানীতে পৃথক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ৩

রাজধানীতে পৃথক স্থানে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত ৩

রিদপুরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে যাওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭, পরিচয় মিলছে সকলের

রিদপুরে যাত্রীবাহী বাস উল্টে যাওয়ার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭, পরিচয় মিলছে সকলের

ঘাটাইলে কৃষি জমির টপসয়েল কাটার অপরাধে ২ জনের জেল

ঘাটাইলে কৃষি জমির টপসয়েল কাটার অপরাধে ২ জনের জেল

আওয়ামীলীগের ধূসররা লুটপাট ও ভাংচুর করছে : টুকু

আওয়ামীলীগের ধূসররা লুটপাট ও ভাংচুর করছে : টুকু

দুই সচিব ও  ডিসি প্রত্যাহার

দুই সচিব ও ডিসি প্রত্যাহার

মঠবাড়িয়ায় ট্রাক চাপায় ইজিবাইকের নারী যাত্রী নিহত

মঠবাড়িয়ায় ট্রাক চাপায় ইজিবাইকের নারী যাত্রী নিহত

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিলেন হাসনাত

শিক্ষার্থীদের সৎ ও ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিলেন হাসনাত

রায়পুরে আধিপত্য বিস্তারে খুনের জেরে তিন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, এলাকায় আতঙ্ক

রায়পুরে আধিপত্য বিস্তারে খুনের জেরে তিন বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, এলাকায় আতঙ্ক

উন্নয়ন সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী

উন্নয়ন সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী