ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ২ মাঘ ১৪৩১

নাইজারের মানুষ কেন ফ্রান্সের বদলে রাশিয়াকে স্বাগত জানাতে চায়

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

০৩ আগস্ট ২০২৩, ০১:৪৫ পিএম | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৩, ০১:৪৫ পিএম

আফ্রিকার দেশ নাইজারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেদেশে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে বৈরিতা ক্রমশ বাড়ছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ বাজুমের জোরালো সমর্থন আছে এমন এলাকাতেও সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীকে দেখা গেল রাশিয়ার পতাকার রঙে পোশাক পরে গর্বের সঙ্গে নিজেকে প্রদর্শন করতে।

নাইজারে এই অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র বাকযুদ্ধ চলছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাজুম তাদের দেশের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। একই সঙ্গে এসব দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। নাইজারে ফ্রান্সের একটি সামরিক ঘাঁটি আছে। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ইউরেনিয়াম উৎপাদনকারী দেশ নাইজার। পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরির জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। নাইজারে উৎপাদিত ইউরেনিয়ামের এক চতুর্থাংশই রপ্তানি হয় ইউরোপে। এর মধ্যে বেশিরভাগটাই যায় সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সে।

গত ২৬ জুলাই জেনারেল আবদুরাহমানে টিচিয়ানি এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নাইজারের প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর রাস্তায় হঠাৎ করে রুশ পতাকার আবির্ভাব ঘটলো। গত রোববার রাজধানী নিয়ামিতে এক প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয় হাজার হাজার মানুষ। সেখানে অনেক মানুষের হাতে ছিল রুশ পতাকা। সেদিন কিছু মানুষ এমনকি ফরাসী দূতাবাসে আক্রমণ চালায়। এখন মনে হচ্ছে এই ‘আন্দোলন’ এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

রাজধানী থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরের এক শহর জিন্দেরের যে ব্যবসায়ী রুশ পতাকার রঙে পোশাক পরেছিলেন, নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি তার নাম প্রকাশ করেননি, এবং ছবিতে তার মুখ ঝাপসা করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ‘আমি রুশ-পন্থী এবং আমি ফ্রান্সকে পছন্দ করি না,’ বলছিলেন তিনি, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি ফ্রান্সের বিপক্ষে। ওরা আমাদের দেশের সব সম্পদ শোষণ করেছে- ইউরেনিয়াম, পেট্রোল এবং স্বর্ণ থেকে সবকিছু। এই ফ্রান্সের কারণেই আমার দেশের গরীব মানুষেরা তিন বেলা খেতে পায় না।’

এই ব্যবসায়ী বলেন, জিন্দের শহরে সোমবার সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থনে যে বিক্ষোভ হয়েছে, তাতে হাজার হাজার মানুষ যোগ দেন। তিনি জানান, স্থানীয় এক দর্জিকে তিনি বলেছিলেন রাশিয়ার পতাকার রঙ সাদা, নীল এবং লাল কাপড় দিয়ে তাকে একটি পোশাক তৈরি করে দিতে। দুটি রুশপন্থী গ্রুপ এই পোশাক তৈরির অর্থ দিয়েছে এমন কথা তিনি অস্বীকার করেন। নাইজারের জনসংখ্যা ২ কোটি ৪৪ লাখ। দেশটির প্রতি পাঁচ জনের দুজন চরম দারিদ্রের মধ্য বাস করে।

প্রেসিডেন্ট বাজুম ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০২১ সালে এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এটিকে দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতাবদল বলে বর্ণনা করা হচ্ছিল। কিন্তু তার সরকার ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এবং আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত জঙ্গিদের হামলার টার্গেটে পরিণত হয়। সাহারা মরুভূমির একাংশ এবং দক্ষিণের সাহেল অঞ্চলের আধা-শুষ্ক অঞ্চলে এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা আছে। নাইজারের প্রতিবেশী দুটি দেশ মালি এবং বারকিনা ফাসোও সাবেক ফরাসী উপনিবেশ। এই দুটি দেশও জঙ্গিদের হামলার মোকাবেলায় হিমসিম খাচ্ছিল। এই দুটি দেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে বলে যুক্তি দেয়া হয়।

নাইজারের মতো এই দুটি দেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ফরাসী সেনা মোতায়েন ছিল। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফরাসী সেনারা সাহায্য করছিল। কিন্তু জঙ্গিদের হামলা অব্যাহত থাকলে সেখানে ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। এই তিনটি দেশের মানুষই অভিযোগ করতে থাকে যে, ফ্রান্স আসলে জঙ্গিদের দমনে যথেষ্ট সাহায্য করছে না। মালিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর সেখান থেকে ফ্রান্সের সৈন্যদের বের করে দেয়। এরপর তারা রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার গ্রুপকে ডেকে আনে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী দলকেও দেশত্যাগের জন্য চাপ দিচ্ছে মালি।

মালিতে অবশ্য জঙ্গিদের হামলা অব্যাহত আছে। এদিকে বারকিনা ফাসোর সরকারও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে থাকে এবং শত শত ফরাসী সৈন্যকে বহিষ্কার করে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বাজুমের সরকার নাইজারে ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ প্রায়শই নিষিদ্ধ ঘোষণা করতেন। গত বছরের মাঝামাঝি হতে নাইজারের কিছু নাগরিক সংগঠন ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। মালি থেকে যখন ফরাসী সৈন্যদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়, তখন বাজুমের প্রশাসন এই সৈন্যদের নাইজারে মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারপরই এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।

এসব নাগরিক সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটির নাম এম-৬২ আন্দোলন। একদল রাজনৈতিক কর্মী ২০২২ সালের অগাস্টে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলন এবং ট্রেড ইউনিয়নকে জোটবদ্ধ করার মাধ্যমে। তারা নাইজারে জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, দুঃশাসন এবং ফরাসী সৈন্যদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়। কিন্তু এই জোটের বিভিন্ন বিক্ষোভ হয় নিষিদ্ধ নয়তো সহিংস বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে নাইজারের সরকার। আন্দোলনের নেতা আবদোলায়ে সেইদুকে গত এপ্রিল মাসে আটকের পর ‘জন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগে তাকে নয় মাসের জেল দেয়া হয়।

প্রেসিডেন্ট বাজুম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এম-৬২ এখন নতুন করে চাঙ্গা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এই সংগঠনের কর্মীদের সামরিক জান্তার পক্ষে জনগণকে সংগঠিত করার ডাক দিতে দেখা গেছে। একই সঙ্গে তারা অভ্যুত্থানের কারণে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞারও সমালোচনা করেছেন। নাইজারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সেইফগার্ডিং দ্য হোমল্যান্ডের (সিএনএসপি) সঙ্গে বা রাশিয়ার সঙ্গে এই এম-৬২র কী সম্পর্ক তা স্পষ্ট নয়।

তবে রবিবার রাজধানীতে যে বিক্ষোভ হয়, তার মূল আয়োজক ছিল এই সংগঠন। সেখানে অন্যান্য নাগরিক সংগঠনও অংশ নেয়, যাদের মধ্যে ছিল ‘কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর দ্য ডেমোক্রেটিক স্ট্রাগল (সিসিএলডি), বাকাটা এবং ইয়ুথ একশন ফর নাইজার। জিন্দের শহরের রুশ-পন্থী ব্যবসায়ী অবশ্য আশাবাদী যে তার দেশকে মস্কো সাহায্য করতে পারবে। ‘আমি চাই রাশিয়া আমার দেশকে খাদ্য এবং নিরাপত্তা দিয়ে সাহায্য করুক,’ বলছেন তিনি, ‘রাশিয়া আমাদের কৃষির উন্নতিতেও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে পারে।’ সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত
শেষ তিন মাসে রেকর্ড বাজেট ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের
বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একত্রে কাজ করলেই সফল হবে জাতিসংঘ
এলোপাতাড়ি গোলাবর্ষণে ১২০ নিহত সুদানে
ভারতীয়দের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ সউদীর
আরও

আরও পড়ুন

বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪

বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪

মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫

সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই

সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই

ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের

ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের

গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি

গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের

শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা

শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা

বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা

বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা

এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা

দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম

দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম

বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের

বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের

ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?

ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?

আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু

আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু

বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ

বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ

রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী

রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী

ধূমপানকে না বলুন

ধূমপানকে না বলুন

জালিমের পরিণতি ভালো হয় না

জালিমের পরিণতি ভালো হয় না

অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি

অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি

মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়

মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত

১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত