ঢাকা   রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কবিতা : শখের বিষয় নয়

Daily Inqilab হোসেইন আহমদ চৌধুরী

২০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০২ এএম

শখের বশে বাগান করা যায়, আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানো যায় কিন্তু কবিতা সৃষ্টি করা যায় না। এখানে শখের কারবার নেই মোটেই। আপনি শুয়ে-বসে, গাড়ি হাঁকিয়ে, কর্পোরেট চেয়ারে কিংবা হাই কমোডে বসে বসে লিখতেই পারেন কিন্তু তা যেন না হয় অপচিত শব্দের জঞ্জাল।

আপাদমস্তক অস্বস্তি নিয়ে কবিকে করতে হয় স্বস্তির খোঁজ, আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে করতে হয় নিজস্ব গরল পান; স্ব প্রণোদিত হয়ে জীবনভর করে যেতে হয় দুঃখের চাষ। টানাপোড়েন অর্থাৎ ক্রাইসিস ছাড়া সবল কবিতা অকল্পনীয়। আহমদ ছফা নাকি একদিন না খেয়ে সারাদিন রিকশায় চড়ে বেড়িয়েছেন। ক্ষুধার্তদের নিয়ে গল্প লিখবেন বলে তাঁর এই অভুক্ত অভিযান। তাঁর সে গল্পটি আদৌ তিনি লিখেছেন কি-না, সেটা আমার জানা নেই। আহমদ ছফা নমস্য জন, তাঁর প্রতি সম্মান রেখেই বলছি– ইনিয়েবিনিয়ে গল্প লেখা আর কবিতা সৃষ্টি এক নয়।

বলে তো দিলাম– সবল কবিতা সৃষ্টির কথা! শিল্প গুণে সমৃদ্ধ কবিতা-ই তো সবল কবিতা। আপনি যদি পূর্ণিমার জোছনা না দেখেন, অমাবস্যার অমানিশা না দেখেন তাহলে আপনার লেখায় আলো-আঁধারির রহস্যময়তা সৃষ্টি হবে কেমন করে? কবিতা তো শব্দের মায়াজাল। ঈশ্বর স্বয়ং প্রেমিক; আপনাকেও প্রেমিক হতে হবে, শব্দপ্রেমিক। কবির শব্দ হবে ঈশ্বরের জন্য আনন্দের শমন আর কবির কাছে দুঃখের সনদ। এই আলো-আঁধারি, আনন্দ-দুঃখ একজন কবির শক্তি। কবিকে শক্তিমান হতে হয়। আলো আর আঁধারের নিষ্পেষ, আনন্দ আর দুঃখের নিষ্পেষ সহ্য করে কবির অধিষ্ঠান। তাই “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”।

ভাব বিবেচনায় ও প্রকাশের ভঙ্গি অনুযায়ী কবিতা অনেক ধরনের হয়ে থাকে। আবৃত্তিধর্মী কবিতা, বিবৃতিধর্মী কবিতা, রস সিঞ্চনের কবিতা, ব্যাঞ্জনাময় কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আজকাল ধ্বনিতাত্তি¡ক চিন্তনের প্রভাবে শব্দের বাহুল্য লক্ষিত। কুজনেইবা নিরলস শ্রম নিবিড় কবিতা সৃষ্টি করে চলেছেন! প্রতিবছর একুশে বইমেলায় হাজার তিনেক কবিতার বই বেরোয়। এটি আমাদের জন্য আশাপ্রদ হলেও পাঠক তৈরিতে আমাদের কবিক‚লের ব্যর্থতা প্রকটিত। তাঁদের নিজেদেরই কবিতা পাঠে অনিহা। এক্ষেত্রে গল্পকার ও উপন্যাসিকেরা অনেকটা এগিয়ে। গল্প উপন্যাসের বই বিক্রির সংখ্যার কাছে কবিতার বই বিক্রির সংখ্যা বড়োই হতদরিদ্র।

ইদানিংকার কবিতায় নতুনত্বের অভাব প্রকটিত। পুরনো আমলের ধরন, শব্দ ও বিষয়ের পুনরাবৃত্তি, ক্রিয়াপদের বাহুল্য, দুর্বল বুননকৌশল প্রভৃতি দুর্বলতা গুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না আমাদের কবিরা। পুরনো ধরন অবলম্বনে কবিতার নির্মাতা হওয়া গেলেও স্রষ্টা হওয়া অকল্পনীয়। স্রষ্টা হতে হলে নতুন কিছু করতে হবে, নতুন ধারা খুঁজতে হবে, নতুন ধারায় লিখতে হবে।

কবিকে মিতব্যয়ী হতে হয় আর কবিতাকে করতে হয় নির্মেদ, তন্বী। কবিতায় অপচয় ত্যাজ্য। এই অপচয় শব্দের অপচয়। কবিতার একেকটি শব্দ হাজারো শব্দের সমান শক্তিধর। মিত শব্দের কারুকাজে সৃষ্ট তন্বী কবিতা আয়ুষ্মান হতে বাধ্য যদি তা সত্যি সত্যি কবিতা হয়। এখানে একটি কথা খোলাসা করা দরকার। আমি বারবার বলে গেলাম কবিতা সৃষ্টি’র কথা। হ্যাঁ, কবিতা নির্মাণ নয়, কবিতা সৃষ্টি করতে হয়। আমাদের কবিরা নির্মাতা হচ্ছেন কিন্তু স্রষ্টা হচ্ছেন কই! অনেকেই উত্তরাধুনিকতা আনতে গিয়ে আর বিভিন্ন ইজম এর টানাটানিতে সৃষ্টির পথ ভুলে নির্মাণের কারিগরি রপ্ত করে চলেছেন আর বগল বাজাচ্ছেন আনন্দাতিশয্যে। অথচ এই আনন্দই নিরানন্দের কারণ হয়ে দাঁড়াবে একসময়। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, আমি বিশেষ কোনো ধারার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বলছি। তা কিন্তু মোটেই নয়। আমি সকল ধারার পক্ষে। তবে কবিদের দলাদলির সম্পূর্ণ বিপক্ষে।

প্রকৃত কবিরা অতৃপ্তিতে ভোগেন সবসময় এবং একটি লেখার বারবার সংশোধন করেন। সংশোধন ও পরিমার্জন শেষেও তাঁদের অতৃপ্তি থেকে যায়। তাঁদের এই অতৃপ্তি-ই আমাদেরকে দিতে পারে পরিশুদ্ধ কবিতার স্বাদ, সমৃদ্ধ করতে পারে আমাদের কাব্য সাহিত্য। কিন্তু ইদানিং কতিপয় অদূরদর্শী পত্রিকা ওয়ালা আমাদের অনেক নবীন কবিকে আঁতুড় ঘরেই ধ্বংস করে ফেলছেন নিজেদের অজান্তেই। অকবিতাকে কবিতার স্বীকৃতি দিয়ে ছাপিয়ে দিচ্ছেন তাদের পত্রিকার সাহিত্য পাতায়। আর নতুন কবিরা অহং নামের পাখায় ভর করে হাওয়ায় ভাসছেন, যা মোটেই কাম্য হতে পারে না। নতুন কবিদের উত্তরণের মাধ্যম হচ্ছে লিটলম্যাগ। কিন্তু তারচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে সাহিত্য আড্ডা ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ / নিবন্ধ পাঠ এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী কবিদের কবিতা পাঠ।

আজকাল শ্রোতার চেয়ে বক্তার সংখ্যা অধিক। এই যেমন, আমি এতক্ষণ এলোমেলো বকবক করে গেলাম। বলতে পারেন, মুর্খের পাÐিত্য প্রদর্শন। বলছিলাম, কবিতা মোটেই শখের বিষয় নয়। আবারও বলছি, শখ করে অনেক কিছু করা গেলেও কবিতা সৃষ্টি করা যায় না। কবিতা গহীনের অনুভ‚তি, বোধের পীড়ন, গভীরের স্ফুরণ। কবির ক্লেশের নিঃসরণ যা শ্রমের নিবিড়তায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে প্রাণবান হয়। সৃষ্টি হয় অবিনাশী কবিতা আর হরণ করে পাঠক হৃদয়।


বিভাগ : সাহিত্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প
গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪ : সাহিত্য সংস্কৃতি ভাবনা
প্রার্থনার মূল কাজ সংযোগ স্থাপন
গ্রাফিতি বাংলাদেশ
তোমাকে
আরও

আরও পড়ুন

যশোরে নাশকতার অভিযোগে আওয়ামীলীগের দুই কর্মী আটক

যশোরে নাশকতার অভিযোগে আওয়ামীলীগের দুই কর্মী আটক

যশোরে ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি সাবেক এসপি আনিসসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা থানায় রেকর্ড

যশোরে ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি সাবেক এসপি আনিসসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা থানায় রেকর্ড

যশোরে একই সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ জাহিদুল

যশোরে একই সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ জাহিদুল

ইমনের সেঞ্চুরির পরও এগিয়ে খুলনা

ইমনের সেঞ্চুরির পরও এগিয়ে খুলনা

টিয়ারশেল-সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সরানো হলো প্রথম আলোর সামনে অবস্থানকারীদের

টিয়ারশেল-সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সরানো হলো প্রথম আলোর সামনে অবস্থানকারীদের

নাইমের ১৮০, মেট্রোর বড় সংগ্রহ

নাইমের ১৮০, মেট্রোর বড় সংগ্রহ

রাজার বোলিংয়ে অলআউট বরিশাল

রাজার বোলিংয়ে অলআউট বরিশাল

দেশের টাকা পাচার করে হাসিনা ও তাঁর দোসররা দেশকে দেউলিয়া করে গেছে পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে কাজ করতে হবে -মাওলানা ইমতিয়াজ আলম

দেশের টাকা পাচার করে হাসিনা ও তাঁর দোসররা দেশকে দেউলিয়া করে গেছে পাচারকৃত টাকা উদ্ধারে কাজ করতে হবে -মাওলানা ইমতিয়াজ আলম

এসডিজি কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’

এসডিজি কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’

বিএনপি’র প্রতিনিধি দলের সাথে ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রামিস সেনের বৈঠক

বিএনপি’র প্রতিনিধি দলের সাথে ঢাকায় নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত রামিস সেনের বৈঠক

৫ বছর পর আয়োজিত হতে যাচ্ছে আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪

৫ বছর পর আয়োজিত হতে যাচ্ছে আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৪

থিতু হয়েও ইনিংস লম্বা করতে পারলেন না শাহাদাত

থিতু হয়েও ইনিংস লম্বা করতে পারলেন না শাহাদাত

গণ-অভ্যুত্থানে ঢাবি ভিসির ভূমিকা কী ছিল? জানতে চান ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক

গণ-অভ্যুত্থানে ঢাবি ভিসির ভূমিকা কী ছিল? জানতে চান ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক

নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করা : রিজভী

নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ হওয়া উচিত অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করা : রিজভী

ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনে দেশে এলো অ্যাপ ‘পারলো’

ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনে দেশে এলো অ্যাপ ‘পারলো’

সীমান্তর লক্ষ্য এসএ গেমসের হ্যাটট্রিক স্বর্ণ জয়

সীমান্তর লক্ষ্য এসএ গেমসের হ্যাটট্রিক স্বর্ণ জয়

বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান

বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান

নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান

নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান

লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন

লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন

১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক

১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক